ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া
প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০২৪, ০৩:০৬ এএম
আপডেট : ১৩ মার্চ ২০২৪, ০৮:২০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ব্যবসায়ীরা জনগণের খাদেম হবে কবে

ব্যবসায়ীরা জনগণের খাদেম হবে কবে

ব্যবসা-বাণিজ্য একটি সমাজ ও দেশের চালিকাশক্তি। সমাজ বা রাষ্ট্রে বসবাসকারী জনগণের জীবিকা উপার্জনের একটি অন্যতম মাধ্যমও বটে। ব্যবসার মাধ্যমেই মূলত একজনের পণ্যসামগ্রী অন্যের কাছে পৌঁছে এবং মানুষের প্রয়োজন পূর্ণ হয়। সমাজের একটি বড় অংশ ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে নিজের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। যে কোনো ধর্মের নির্দেশনানুযায়ী সততা ও আমানতদারির সঙ্গে মানুষের কল্যাণকামী হয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারলে সন্দেহাতীতভাবে তা কল্যাণকর কাজ হিসেবে গণ্য হয়। তবে ব্যবসা হতে হবে অবশ্যই হালাল বা বৈধ। কারণ হালাল ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যবসায়ী ও তাদের পরিবারের পাশাপাশি সমাজের সব শ্রেণির মানুষের জন্যই কল্যাণকর। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ব্যবসায়ের মাধ্যমে নিজেদের কল্যাণ সর্বোচ্চকরণের পাশাপাশি সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করা। আর হালাল ব্যবসা-বাণিজ্য সমাজ বা রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা করতে যারা ব্যবসায়ী তাদের হতে হবে একান্ত সৎ ও মানবিক। সহজ কথায়, ব্যবসায়ীদের হতে হবে জনগণের খাদেম বা জনগণের সেবক।

পক্ষান্তরে মানুষকে কষ্ট দিয়ে, ধোঁকা-প্রতারণা ও মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে এবং পণ্য মজুত করে অস্বাভাবিক দাম বাড়িয়ে দেওয়ার নাম ব্যবসা নয়, বরং এটি প্রকাশ্য জুলুম ও মানুষ ঠকানো। আর এ অসৎ ব্যবসা সমাজ ও রাষ্ট্র উভয়ের জন্য অকল্যাণকর। ব্যবসায়ীরা যখনই জনগণের খাদেম হতে পারবে মানে জনগণের কল্যাণে নিজেদের সম্পৃক্ততা আরও বেশি বাড়াতে পারবে, তখনই সমাজ বা রাষ্ট্রে হালাল ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই লক্ষ্যে প্রথমেই আমাদের ব্যবসায়ীরা নিজেদের জনগণের একজন খাদেম হিসেবে চিন্তা করতে হবে। যতদিন তা না হবে ততদিন মুদ্রাস্ফীতি নামক অভিশাপ থেকে আমাদের দেশের সাধারণ জনগণ রেহাই পাবে না।

ব্যবসায়ী নামক বাংলাদেশের সব কালোবাজারি, মুনাফাখোর, মজুতদার প্রভৃতির কারণে খাদ্যদ্রব্য, চাল, ডাল, তেল, লবণ, মরিচ, চিনি, দুধ থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য দ্রব্যগুলোর মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিদিন এবং ক্রমে এসব পণ্য সংগ্রহ কঠিনতর হচ্ছে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষগুলোর জন্য। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সীমাকে অতিক্রম করে দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে প্রতিটি পণ্যের মূল্য। বাজার ব্যবস্থায় যেন পুঁজিবাদ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। ধনীরা আরও ধনী হয়ে উঠছে আর সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষরা কোনোরকমে খেয়েপড়ে জীবনের সঙ্গে নিত্যযুদ্ধ করে চলেছে। এ যুদ্ধ যেন থামার নয়। বৈষম্য ক্রমেই বেড়ে চলেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সাধারণ জনগণ আজ সীমাহীন ভোগান্তিতে আছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বর্তমানে দেশের জাতীয় সমস্যাগুলোর অন্যতম। অসাধু ব্যবসায়ীদের অপপ্রচেষ্টায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সাধারণ মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ নিত্যপণ্যের মূল্যই এখন নিম্ন-আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।

সারা বছর স্বাভাবিকভাবে অসাধু ব্যবসায়ীদের একটা প্রভাব তো দ্রব্যমূল্যের ওপর থাকেই। তার বাইরে গিয়ে রমজান মাসে এদের অসাধু কর্মকাণ্ডের মাত্রা আরও বেশি বেড়ে যায়। পবিত্র রমজান মাস শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে নিত্যপণ্যের বাজার বেসামাল হতে শুরু করেছে। প্রতি বছরই রোজার আগে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বৈঠক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, খাদ্যদ্রব্যের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে বাংলাদেশে। পণ্যের মজুত পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও দ্রব্যমূল্যের এমন আকাশচুম্বী ঊর্ধ্বগতির পেছনে কারণ খুঁজতে গেলে কারণ হিসেবে বের হয়ে আসে অসাধু ব্যবসায়ীদের ভূমিকা। রোজার সময় যত কাছাকাছি হয়, পণ্যমূল্য তারা তত বাড়াতে থাকে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, রোজা আসার আগে থেকেই অসাধু ব্যবসায়ীরা কারসাজির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। অবৈধভাবে বাড়ায় মজুত। সৃষ্টি করে কৃত্রিম সংকট। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতি বছর রমজান এলেই জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। এমনকি কিছু পণ্যের দাম ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে যায়। অসাধু ব্যবসায়ীরা যেন ওতপেতে থাকে রমজান মাসের জন্য। এসব অসাধু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে একাধিক বৈঠক করে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। কঠোর হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়, নেওয়া হয় নানা উদ্যোগও। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা খুবই চতুর, তারা সবসময়ই থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সরকারের পক্ষ থেকে রোজায় বাজার নিয়ন্ত্রণের হাঁকডাক দেওয়া হলেও অসাধু ব্যবসায়ীদের হটকারিতার ফলে একা সরকারের পক্ষে বাজার নিয়ন্ত্রণ করাটা অনেক অসম্ভব হয়ে ওঠে। বাজার নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ-প্রতিশ্রুতিগুলো কাগজে-কলমেই থেকে যায়।

দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে আমাদের জীবনযাত্রার সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি পরিবার কীভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবন নির্বাহ করবে তা নির্ভর করে তাদের আয়, চাহিদা এবং দ্রব্যমূল্যের ওপর। প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের মূল্য যখন সহনীয় পর্যায়ে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে তখন তাদের জীবন কাটে স্বস্তিতে। অন্যদিকে নিত্যপণ্যের মূল্য যখন সাধারণ মানুষের আর্থিক সংগতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায় তখন দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র পরিবারে চলে অর্ধাহার, অনাহার এবং পারিবারিক অশান্তি। তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে একদিকে জনজীবনে নেমে আসে কষ্টের কালো ছায়া। অন্যদিকে মুনাফাখোর, কালোবাজারিদের কারণে দেশে বিরাজ করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। এ বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে দেশ এবং দেশের মানুষকে রক্ষা করতে ব্যবসায়ীদের সব ধরনের অসাধু কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখতে হবে যে কোনোভাবে। এ ক্ষেত্রে সরকার, সমাজ, ধর্ম এবং জনগণকে একযোগে কাজ করতে হবে।

অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সরকার এখন খুব কঠোর অবস্থানে রয়েছে। জনগণের কল্যাণার্থে জনগণের সমর্থিত আওয়ামী লীগ সরকার এই অসৎ ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে এরই মধ্যে অনেক কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ ক্ষেত্রে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। অসাধু ব্যবসায়ী যারা সরাসরি দুর্নীতি ও অপকর্মের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য অন্য সব ব্যবসায়ীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এর পাশাপাশি অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সাধারণ জনগণের সর্বশেষ ভরসাস্থল আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। সরকারের কঠোর অবস্থানের পাশাপাশি প্রতিটি ধর্মের ধর্মীয় প্রধানদেরও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। সে ক্ষেত্রে প্রতিটি ধর্মের যারা ধর্মীয় প্রধান আছে তাদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। এ দেশের অসাধু ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণকে অসৎ ব্যবসার কুফল সম্পর্কে ধর্মীয় আলোচনার মাধ্যমে অবগত করতে হবে। অসৎ ব্যবসার ভয়াবহ পরিণাম কী হতে পারে তার ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করতে হবে। পণ্য বিক্রির জন্য মিথ্যা শপথ করা যাবে না। মিথ্যা মানবতাবোধকে লোপ করে, নৈতিক চরিত্রের অবক্ষয় ঘটায়। মিথ্যাবাদীর ওপর আল্লাহর অভিশাপ। মিথ্যা বলে বা মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রি করার পরিণতি যে খুবই ভয়াবহ, সে সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করতে হবে।

সবশেষে, সরকার ও ধর্মীয়প্রধানদের পাশাপাশি এখন সময় এসেছে অসাধু ব্যবসায়ীদের উৎখাত করার মাধ্যমে উচ্চদ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে বাঙালি জনগণকে কালোবাজারি, মজুতদার এবং দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তোলার। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে মুষ্টিমেয় অসাধু ব্যবসায়ীদের সমূলে উপড়ে ফেলে দিতে হবে। বাঙালি সাহসী জনগণ বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী এই মজুতদার এবং দুর্নীতিবাজ অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলেই তাদের ভিত নড়েচড়ে উঠবে। তারা তখন উপলব্ধি করতে পারবে যে জনগণের খাদেম বা সেবক না হয়ে ব্যবসা করা কখনো সম্ভব হবে না বা সেটা তাদের নিজেদের জন্যও কল্যাণকর হবে না।

লাখ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে সাধারণ জনগণের প্রতারণা করে নয়, বরং জনগণের খাদেম হয়েই ব্যবসায়ীদের সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে হবে। জনগণের সমর্থন নিয়ে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়টিতে সম্পূর্ণ আপসহীন। জনগণের স্বার্থকে মাটিচাপা দিয়ে যারা ব্যবসা করছে বা করবে তাদের অবশ্যই দুনিয়ায় এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে কঠিন বিচারের সম্মুখীন হতে হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। যে ব্যবসায়ীরা জনগণের খাদেম হয়ে জনগণের বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে ব্যবসা পরিচালনা করবে, তারাই শুধু অদূর ভবিষ্যতে টিকে থাকবে এবং বাকি অসাধু ব্যবসায়ী সরকার, ধর্ম এবং জনগণের সম্মিলিত প্রয়াসে অতীতের মতো ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যাবে।

লেখক: উপাচার্য, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কালবেলায় সংবাদ প্রকাশ / বেশি দামে মসলা বিক্রির সত্যতা পেল ম্যাজিস্ট্রেট

জান্তার হেলিকপ্টার ভূপাতিতের দাবি মিয়ানমারের বিদ্রোহীদের

বাজারে যাওয়ার পথে সাপের কামড়ে বৃদ্ধের মৃত্যু

আন্দোলন নিয়ে নতুন বার্তা কর্নেল অলির

‘নো হেলমেট, নো ফুয়েল’ বাস্তবায়নে মাঠে ফেনী পুলিশ

পরিবেশ রক্ষায় জবি শিক্ষার্থীর একক পদযাত্রা

জীবন দিয়ে দেশবিরোধী অপশক্তিকে মোকাবিলা করব : নাছিম 

মহানন্দা নদীতে ডুবে দুজনের মৃত্যু

গোষ্ঠীতন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তরুণদের রুখে দাঁড়াতে হবে: মেনন

বিএনপি অধ্যুষিত জয়পুরহাটে সর্বোচ্চ ভোট, সমীকরণ মিলছে না

১০

গাজায় গণহত্যার বিরুদ্ধে এবি পার্টির বিক্ষোভ 

১১

নতুন ভবনে নতুন আঙ্গিকে গণহত্যা জাদুঘর

১২

তাপপ্রবাহের সতর্কবার্তা প্রত্যাহার, ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস

১৩

ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত রেলপথ চালু হবে অক্টোবরে : রেলমন্ত্রী

১৪

পেঁয়াজ চুরির অভিযোগে সাবেক ইউপি সদস্যকে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন

১৫

গ্রীন লাইফ হাসপাতালে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ

১৬

ফরিদপুরের ডিসি / ‘বুলেট থাকতে ব্যালটে কেউ হাত দিতে পারবে না’

১৭

হেরে যাচ্ছে ইসরায়েল, বিস্ফোরক মন্তব্য মোসাদের সাবেক উপপ্রধানের

১৮

যে কারণে ডিবিতে এসেছিলেন মামুনুল হক

১৯

অর্থনীতিকে ধারণ করার সক্ষমতা হারাচ্ছে ব্যাংকিং খাত : ফাহমিদা খাতুন

২০
X