দেশের অর্থনীতিতে ওষুধ শিল্পের ভূমিকা অনেক। চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিনিয়ত বাড়ছে এর সক্ষমতা। দেশের প্রায় ৯৮ ভাগ ওষুধের চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণে চলছে নিরন্তর প্রয়াস। যার নেপথ্যে রয়েছেন দেশের ফার্মাসিস্টরা। তারাই ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফার্মাসিস্ট। এ খাতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে দক্ষ জনবলের চাহিদা। সম্প্রসারিত হচ্ছে কাজের সুযোগও। ওষুধ উৎপাদন থেকে শুরু করে মান নিয়ন্ত্রণ, বাজার ব্যবস্থাপনাসহ আরও অনেক বিষয়েই আছে তাদের পদচারণা। এ পেশার বিস্তারিত নিয়ে লিখেছেন একটি দেশীয় ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ফার্মাসিস্ট নাজমুল ইসলাম আবির—
এ প্রতিবেদনে মূলত কারখানা বা প্ল্যান্টের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে ফার্মাসিস্টদের কাজের সুযোগ ও চাকরি প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা তুলে ধরব। প্রথমেই কাজের ক্ষেত্র ও ধরন নিয়ে আলোচনা করা যাক।
আরঅ্যান্ডডি
প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট বা আরঅ্যান্ডডি ডিপার্টমেন্ট মূলত
নতুন একটি ওষুধ উৎপাদনের জন্য ওষুধটির ফর্মুলেশন ডেভেলপ করে থাকে। এজন্য সব ইনিশিয়াল রিসার্চ ও ইমপ্লিমেন্টেশনের কাজ করে থাকে। আরঅ্যান্ডডি ডিপার্টমেন্টই মূলত প্রথম কোনো ওষুধ ছোট পরিসরে তৈরি করে এবং পরে সেটাকে উৎপাদন বিভাগ বড় পরিসরে তৈরি করে। নতুন পণ্য বাজারে নিয়ে আসার চাহিদা প্রদান করে মার্কেটিং বিভাগ। কিন্তু এর জন্য যে ফর্মুলা তৈরি ও অন্যান্য অ্যানালিটিক্যাল প্রক্রিয়া তৈরি করতে হয়, তা করে আরঅ্যান্ডডি বা প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্ট। এর দুটি অংশ থাকে। একটি ফর্মুলেশন আরেকটি অ্যানালিটিক্যাল।
উৎপাদান
প্রোডাকশন ডিপার্টমেন্ট ওষুধ তৈরিতে সরাসরি যুক্ত। এ বিভাগে সবচেয়ে বেশি জনবল কাজ করে। প্ল্যান্টের প্রায় সব বিভাগই মূলত প্রোডাকশন ডিপার্টমেন্টের সহায়ক হিসেবে কাজ করে। প্রোডাকশন ডিপার্টমেন্টে প্রোডাকশন প্ল্যান থাকে এবং সে অনুযায়ী উৎপাদন কাজ চলে।
মান নিশ্চিতকরণ বিভাগ
কোয়ালিটি অ্যাশিওরেন্স তথা গুণগত মান নিশ্চিতকরণ বিভাগের মূল কাজ হলো পণ্যের কোয়ালিটি ঠিক আছে কি না তা যাচাই করা। এ নিয়ে কোনো বিশেষ ইস্যু তৈরি হলে তার জবাবদিহি করতে হয় কিউএ ডিপার্টমেন্টকেই।
কোয়ালিটি কন্ট্রোল
কোয়ালিটি কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্ট উৎপাদিত ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। সেইসঙ্গে কাঁচামাল ও প্রস্তুতকৃত ওষুধের মান পরীক্ষা করে। র ম্যাটারিয়ালগুলোর স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী সব ঠিকঠাক আছে কি না, ইন্টারমিডিয়েট বা বাল্ক প্রোডাক্টের টেস্ট এসবও এ বিভাগের কাজ। কোয়ালিটি কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টে একদম জটিল কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করে। তাই এখানে মেশিনারিজের কাজ শেখার সুযোগ থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে কমন হচ্ছে এইচপিএলসি। মোটামুটি সব কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাবের সাধারণ যন্ত্র এটি। এ ছাড়া আরও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি থাকে। এটা নির্ভর করে কোন ধরনের ম্যাটারিয়াল টেস্ট করা হবে তার ওপর। কোয়ালিটি কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্ট থেকে রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট/প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট (অ্যানালিটিক্যাল) বিভাগে সহজে চাকরি পরিবর্তন করা যায়। এ ছাড়া ওয়্যারহাউস বা পিপিআইসি, ভ্যালিডেশন ডিপার্টমেন্ট থাকে যেখানে ফার্মাসিস্টদের কাজের সুযোগ রয়েছে।
ফার্মাসিস্টদের চাকরির প্রস্তুতি
প্ল্যান্টে মূলত এ ডিপার্টমেন্টগুলোতেই ফার্মাসিস্টদের কাজ করার জায়গা বেশি। এজন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা বি.ফার্ম, বি.ফার্ম প্রফেশনাল, এম.ফার্ম প্রয়োজন হয়। কিছুক্ষেত্রে এম.ফার্ম ও পূর্ব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রার্থীদের প্রাধান্য দেওয়া হয়।
নিয়োগ পদ্ধতি : প্ল্যান্ট জবের ক্ষেত্রে নিয়োগ পদ্ধতি এক কোম্পানিতে একেক রকম। ফ্রেশারদের নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রথমে বিভিন্ন পদ্ধতিতে সিভি সংগ্রহ করা হয়। তারপর সর্টিং করে যোগ্য প্রার্থীরা লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণে সুযোগ দেওয়া হয়।
লিখিত পরীক্ষায় ভালো করা প্রার্থীরা প্রথম ভাইভাতে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। প্রথম ভাইভাতে মূলত একাডেমিক ও পারসোনাল বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়। সবশেষে চূড়ান্ত ভাইভার জন্য ডাকা হয়। সেখানে স্যালারি নেগোসিয়েশন, কোম্পানি পলিসি, সুযোগ-সুবিধা, কাজ সম্পর্কিত বিষয় প্রাধান্য পায়। কিছু ক্ষেত্রে বা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রার্থীদের ক্ষেত্রে লিখিত ও একটি ভাইভা অথবা শুধু ভাইভা নিয়েও নিয়োগ দেওয়া হয়।
লিখিত পরীক্ষা : বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদ্ধতিতে লিখিত পরীক্ষা হয়। কোথাও শর্ট নোটস আকারে, এমসিকিউ, কিছু ক্ষেত্রে অনলাইনে আবার কিছু প্রতিষ্ঠানে সিঙ্গেল বা গ্রুপ প্রেজেন্টেশনও নেওয়া হয়।
চাকরির সার্কুলার : চাকরির সার্কুলারগুলো বিভিন্ন জব পোর্টালে দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে বিভিন্ন কোম্পানির নিজস্ব ওয়েবসাইটের ক্যারিয়ার অংশে, লিংকড-ইন পেজ ও জব রিলেটেড বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপ থেকেও পাওয়া যায়। কিছু ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের মাধ্যমেও সোর্স করা হয়। এ ক্ষেত্রে নিজ ক্যাম্পাসের অ্যালামনাইরা সহায়তা করতে পারেন।
চাকরির প্রস্তুতি
প্ল্যান্ট জবের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে বি.ফার্ম সিলেবাসের বিভিন্ন কোর্স যেমন—ফার্মাসিউটিক্যাল টেকনোলজি, ফার্মাসিউটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, অ্যানালিটিক্যাল কেমিস্ট্রি, কোয়ালিটি অ্যাশিওরেন্স এসব বিষয়ের ওপর ভালো দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। এ ছাড়া ডিপার্টমেন্ট ভেদে জবের প্রস্তুতির জন্য আলাদাভাবে বিভিন্ন কোর্স, টপিক নিয়ে বিভিন্ন রিসোর্স পাওয়া যায় ইন্টারনেটে, সেগুলোর সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
এ পেশার সম্ভাবনা অনেক। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ১৬ শতাংশ এবং রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ২৫ শতাংশ। যদিও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তারপরও এ দ্রুত বর্ধনশীল শিল্প খাতে দক্ষ জনবলের চাহিদা প্রচুর।
অনুলিখন : নাজমুল ইসলাম
মন্তব্য করুন