দীর্ঘ এক দশক পর এবং জাতীয় নির্বাচনের মাত্র ছয় মাস আগে পুলিশের মৌখিক অনুমতি পেয়ে গত শনিবার রাজধানীতে বড় সমাবেশ করেছে জামায়াতে ইসলামী। রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে দলটির বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী উপস্থিত হয়েছিলেন। হঠাৎ করে পুলিশের অনুমতি ও জামায়াতের সমাবেশের ঘটনায় রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্ক। বিশেষ করে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রকাশ্যে জামায়াতের বড় সমাবেশকে বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা ভিন্ন ভিন্ন কথা বলছেন। তাদের দাবি, বিএনপি জামায়াতকে রাজপথে নামিয়েছে। তবে বিএনপি বলছে, যারা অনুমতি দিয়েছে, তারাই তো জামায়াতকে মাঠে নামিয়েছে। আর জামায়াত বলছে, জামায়াত নিজস্ব সিদ্ধান্তে পরিচালিত একটি বৃহৎ সুশৃঙ্খল দল। এখানে নামানো-উঠানো এবং সরকারের সঙ্গে আঁতাতের কোনো প্রশ্নই আসে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসা নীতি ঘোষণার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কারণ, শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ ও মতপ্রকাশে বাধা না দেওয়ার কথা বলা আছে ভিসা নীতিতে। ফলে সমাবেশের অনুমতি না দিলে মার্কিন ভিসা নীতির পরিপন্থি হতে পারে। সেজন্যই অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকারের নীতিনির্ধারকরা এ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলছেন না।
জানা গেছে, ১৯৯৪-৯৬ সালে জামায়াতের সঙ্গে জোট করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করেছিল আওয়ামী লীগ। পরে ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়তে গিয়ে বিএনপি-জামায়াতসহ চারদলীয় জোট গঠিত হয়, যা পরে ২০ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়। বর্তমান সরকারবিরোধী চলমান যুগপৎ আন্দোলনের আগে ২০২২ সালের ৯ ডিসেম্বর ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেওয়া হয়। এর পরই বিএনপি-জামায়াত ‘দূরত্ব’ প্রকাশ্যে আসে।
সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্য : জামায়াতের সমাবেশ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত শনিবার রাজধানীতে এক শান্তি সমাবেশে বলেন, ‘জামায়াত মাঠে নামেনি, তাদের নামানো হয়েছে। মাঠে নামিয়েছে তাদের বিশ্বস্ত ঠিকানা বিএনপি। তিনি বলেন, জামায়াত নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত দল নয়। এর পরও তাদের মাঠে নামানোর অর্থ হচ্ছে—বিএনপি আবারও আগুন সন্ত্রাসের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আগুন সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতার বিশ্বস্ত ঠিকানা বিএনপি। গতকাল রোববার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘জামায়াত একটি অনিবন্ধিত দল। তারা মাঝেমধ্যেই বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে ও বিভিন্ন ইনডোরে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে। দলটি মাঠে অনুষ্ঠানের জন্য আবেদন করেছিল। কিন্তু তারা অনুমতি দেননি। দলটি আবদ্ধ স্থানে ইনডোরে মিটিং করতে চেয়েছে, তারা তা দেননি। পরে মৌখিকভাবে কমিশনার (ডিএমপির) অনুমতি দিয়েছেন। এতে আওয়ামী লীগের নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি।’
এ ছাড়া গতকাল রোববার ল রিপোর্টার্স ফোরামের (এলআরএফ) এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রীর কাছে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ‘আপনারা একদিকে জামায়াতকে দল হিসেবে নিষিদ্ধ করতে আইন সংশোধন করছেন, অন্যদিকে ১০ বছর পর সমাবেশ করতে মাঠে নামার সুযোগ করে দিয়েছেন। এটা সাংঘর্ষিক কি না? জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি সাংঘর্ষিক মনে করেন না। চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত জামায়াতকে দোষী বলা যাবে না। বিচার করার পর যতক্ষণ পর্যন্ত রায় না হয়, দোষী সাব্যস্ত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি বলতে পারবেন না, জামায়াত নিষিদ্ধ।’ তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ গতকাল এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘জামায়াত এখনো যেহেতু নিষিদ্ধ হয়নি, রাজনৈতিক দল হিসেবে আবেদন করেছে। সেজন্য তাদের সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে তাদের সমাবেশ থেকে যেভাবে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, এগুলো আসলে বিএনপিরই বক্তব্য।’
২০১০ সালে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর কোণঠাসায় থাকা জামায়াতের সারা দেশে ৩ হাজার কার্যালয় বন্ধ। ২০১৩ সালে বাতিল হয় নিবন্ধন। সর্বশেষ ওই বছরের ৪ মার্চ মতিঝিলের শাপলা চত্বরে কর্মসূচি পালনে অনুমতি পেয়েছিল দলটি। জামায়াতের দাবি, গত একযুগে তাদের ৯৩ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ডিসেম্বর থেকে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে ফের অনুমতি চাইতে শুরু করে দলটি। সর্বশেষ গত শনিবার মাঠে সমাবেশের অনুমতি চাইলেও একটি মিলনায়তনে সমাবেশের অনুমতি দেয় পুলিশ। গত ২৪ মে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করা ইস্যুতে নতুনভাবে ভিসা নীতি ঘোষণা করে আমেরিকা। নতুন নীতি অনুযায়ী, বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে যারা বাধা দেবে, তারা মার্কিন ভিসা পাবে না। শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশে বাধা দিলে ভিসা নীতি প্রযোজ্য হবে। অনেকের মতে, গত বছরের ডিসেম্বরে চারবার আবেদনের পর ব্যর্থ হলেও মার্কিন নতুন ভিসা নীতির কারণেই এবার পুলিশ সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে। তবে জামায়াতের দাবি, তারা মার্কিন ভিসা নীতি নয়, দীর্ঘদিন ধরেই মাঠে সক্রিয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক তৎপরতা শুরুর পর বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে নতুন করে যোগাযোগ শুরু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আগামী দিনে সরকারবিরোধী আন্দোলন কীভাবে জোরালো ও কার্যকর করা যায়, সে বিষয়ে কথা হচ্ছে।
জামায়াতের বক্তব্য
বিএনপিই নাকি জামায়াতকে মাঠে নামিয়েছে। তা ছাড়া দীর্ঘদিন পর প্রকাশ্যে সমাবেশের পর একটি প্রশ্ন উঠেছে যে, তাহলে কী সরকারের সঙ্গে জামায়াতের গোপনে কোনো আঁতাত হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের গতকাল রোববার কালবেলাকে বলেন, ওবায়দুল কাদেরের মন্তব্য অনাকাঙ্ক্ষিত ও অসৌজন্যমূলক। উনার মতো ব্যক্তির কাছ থেকে এ ধরনের মন্তব্য দেশের রাজনীতিকে অপমান করার সমান। জামায়াত কোনো ধরনের সন্ত্রাস বা নেগেটিভ কাজে বিশ্বাস করে না। আমরা সব সময় অত্যাচারিত, নির্যাতিত, মিথ্যাচার-অপপ্রচারের শিকার হয়েছি। আমরা ওবায়দুল কাদেরের এ ধরনের বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করি। আশা করি, উনি রাজনীতিতে ও সরকারের যে পদে আছেন, সেখানে থেকে ভবিষ্যতে কথা বলবেন এবং অন্যান্য দলের প্রতিও সম্মানবোধ থাকবে।
‘জামায়াতকে বিএনপি মাঠে নামিয়েছে’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এমন মন্তব্যের জবাবে ডা. তাহের বলেন, জামায়াতে ইসলামী নিজ পায়ে দাঁড়ানো এবং নিজস্ব সিদ্ধান্তে পরিচালিত একটি বৃহৎ সুশৃঙ্খল দল। এখানে নামানো-উঠানোর কোনো প্রশ্নই আসে না। সরকারের সঙ্গে আঁতাতের কোনো প্রশ্নই আসে না। ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যই তো এ কথা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট।
আমরা যেহেতু বিরোধী দল এবং সরকারবিরোধী আন্দোলনে আছি, তাই আমাদের নিজস্ব অবস্থান থেকে ক্রমান্বয়ে মাঠে কর্মসূচি থাকবে। জামায়াত মার্কিন ভিসা নীতির পর মাঠে নেমেছে বিষয়টা সত্য নয়। ভিসা নীতির আগ থেকেই আমরা মাঠে সক্রিয় আছি। বিভিন্ন সময়ে, আমাদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক বিভিন্ন দিবস পালন করেছি। মিছিল-মিটিং করেছি। সরকারবিরোধী কর্মসূচি পালন করেছি।
যা বলছে আওয়ামী লীগ
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান কালবেলাকে বলেন, যে কোনো রাজনৈতিক সংগঠন সভা-সমাবেশ করতে পারে। সেজন্য তাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। কারণ, তারা নিবন্ধিত দল নয়। তাদের গঠনতন্ত্রে বাংলাদেশের সংবিধান লঙ্ঘন করেছে। অতীতে জামায়াতের ইতিহাস নেতিবাচক, তারা সমাবেশের নামে জ্বালাও-পোড়াও করেছে। তারা যেন জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড না করতে পারে, সেজন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। তারা যেন অপকর্ম করতে না পারে, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক থাকতে হবে। তাদের ফের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পেছনে অবশ্যই বিএনপির হাত রয়েছে—এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, তারা তো একই বৃন্তে দুটি ফুল।
বিএনপির বক্তব্য
দীর্ঘদিন পর জামায়াতের সমাবেশ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন গতকাল কালবেলাকে বলেন, এত দিন সরকার জামায়াতকে কেন অনুমতি দেয়নি, সেটা সরকারই বলতে পারবে। কথা বলা ও সমাবেশ করার অধিকার তো সবারই আছে। সেটাই এ সরকার তাদের দেয়নি, আমাদেরও দেয়নি। আমাদেরও নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করে। এগুলো তো সংবিধানবিরোধী।
‘বিএনপিই নাকি জামায়াতকে মাঠে নামিয়েছে?’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এমন মন্তব্যের জবাবে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিএনপি কেন তাদের (জামায়াত) মাঠে নামাবে? তারা তো একটা দল। সরকার তাদের পারমিশন দিছে, সেই মোতাবেক তারা সভা করেছে। আগেরবার একটা সভা করতে চেয়েছিল, তখন তো পুলিশ অনুমতি দেয়নি, তারাও মাঠে নামেনি। তাহলে আমরা অনুমতি দিলাম কেমনে?
বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সহসম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, জামায়াতকে নিয়ে ১৫ বছর ধরে খেলছে সরকার। যখন যেভাবে প্রয়োজন ব্যবহার করেছে। জামায়াতের সঙ্গে ১৯৯৪-৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যুগপৎভাবে আন্দোলন করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল জামায়াতে ব্রেইন চাইল্ড। সেটাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় আন্দোলন করেছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীসহ অনেকের সঙ্গে সে সময়ের অনেক ছবি এখনো আছে। এরপর ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বলেছে যুদ্ধাপরাধের বিচার। যদিও সেটা নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। অর্থাৎ জামায়াতকে নিয়ে নতুন খেলা শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে।’ অনেকেই বলেছেন, জামায়াতকে কেনো নিষিদ্ধ করা হবে না? এ নিয়ে সংসদ সদস্য নজিবুল বশর মাইজ ভান্ডারীর প্রশ্নের জবাবে ২০১৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেছিলেন, ‘এখন জনমত এমন হয়েছে যে, জামায়াতকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের নিষিদ্ধ করার জন্য কোর্টে এরই মধ্যে একটি মামলা হয়েছে। আশা করি, মামলার রায় শিগগিরই হলে জামায়াত নিষিদ্ধ হয়ে যাবে।’ পরে আইনমন্ত্রীকে মামলার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে ২০১৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি বলেন, ‘জামায়াত নিষিদ্ধ করার বিষয়ে কোনো মামলা হয়নি।’ তবে নিবন্ধন বাতিল নিয়ে একটি মামলা পেন্ডিং আছে। সুতরাং জামায়াত নিষিদ্ধ হওয়া নিয়ে নিবন্ধন বাতিলের মামলার কোনো সম্পর্ক নেই। এত দিন পর জামায়াতের সমাবেশ সহাবস্থানের ইঙ্গিত দেয়। আসলে আওয়ামী লীগ মুনাফিক ও ধূর্ত। তারা যা বলে, তা করে না। যা করে, তা বলে না, যা বলে, তা বিশ্বাস করে না এবং যা বিশ্বাস করে, তা কখনো বলে না। তার প্রমাণ হলো—নিবন্ধন বাতিলের মামলাকে তারা জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের কথা বলছে, যা মিথ্যা ও ভুয়া। স্বার্থই হলো আওয়ামী লীগের আদর্শ।
উল্লেখ্য, এক রিট আবেদন নিষ্পত্তি করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
মন্তব্য করুন