চলতি বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাসের হার ও জিপিএ ৫ দুটোই কমেছে। বেড়েছে ফেলের সংখ্যাও। ৯টি সাধারণ বোর্ড, মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ডের অধীনে এবার পরীক্ষার্থী ছিল ২০ লাখ ৪১ হাজার ৪৫০ জন। এর মধ্যে পাস করেছে ১৬ লাখ ৪১ হাজার ১৪০ জন। ফেল করেছে ৪ লাখ ৩১০ জন। এবার পাসের হার ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এ হিসাবে পাসের হার কমেছে ৭ দশমিক ০৫ শতাংশ। এর আগে ৯৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছিল ২০২১ সালে। অন্যদিকে, এবার জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ জন। আর গত বছর জিপিএ ৫ পেয়েছিল ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ শিক্ষার্থী। সে হিসাবে এবার জিপিএ ৫ও কমেছে ৮৬ হাজার ২৪ জনের।
এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় এবার পাসের হার ও জিপিএ ৫ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের ওপর এখনো করোনার প্রভাব সুস্পষ্ট। এছাড়া পুনর্বিন্যাসকৃত সিলেবাসে সব বিষয়ে পরীক্ষা হওয়ায় পাসের হার ও জিপিএ ৫ কমতে পারে। আরও কারণ হতে পারে ডিভাইস আসক্তি, আর্থিক অনটন ইত্যাদি। তবে, এর বাইরেও আরও কিছু কারণ থাকতে পারে। সেগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে খুঁজে বের করে এর সমাধানে কাজ করতে হবে। এতে শিখন ঘাটতিও কিছুটা পূরণ হবে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক খণ্ডকালীন শিক্ষক আয়েশা বেগম বলেন, করোনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে নানা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে গেছে শিক্ষার্থীরা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ডিভাইস আসক্তি। গেমের পাশাপাশি তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচুর সময় ব্যয় করছে। সে কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়ালেখার প্রতি একটু অনীহা দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া রয়েছে আর্থিক কারণ ও গ্রাম-শহরের বৈষম্য। এগুলো শিক্ষার্থীর ফলাফলে প্রভাব পড়তে পারে। তিনি আরও বলেন, পাসের হার ও জিপিএ ৫ কমে যাওয়ার কারণ খুঁজতে হলে স্কুলগুলোতে যেতে হবে। স্কুলের অবকাঠামো ঠিক আছে কি না, নিয়মিত পাঠদান হচ্ছে কি না এসব তদারক করতে হবে।
একই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, আগে কম বিষয়ে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা হয়েছিল। এবার সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে হলেও শিক্ষার্থীদের সব বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। সে কারণে পাসের হার ও জিপিএ ৫ কমতে পারে। আবার করোনার ক্ষতি দুয়েক বছরে পূরণ হওয়ার কথা নয়। লম্বা সময় শিক্ষার্থীরা শিক্ষা কার্যক্রমে ছিল না। তিনি আরও বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর উচিত হবে, কেন পাসের হার ও জিপিএ ৫ কমেছে তার কারণ খুঁজে বের করা এবং ভবিষ্যতে যাতে এমন চিত্র না থাকে সে চেষ্টা করা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসান বলেন, গত বছর ও চলতি বছর যেসব ব্যাচ এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে বা আগামী বছর দেবে, এরা সবাই করোনাকালে চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে গেছে। এর ফলে একেকজনের শিখন ঘাটতি একেক রকম ছিল। আবার অনেকের শিক্ষার ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির আগের ও পরের জীবনের বাস্তবতা একরকম নয়। সে বাস্তবতায় আমরা এসএসসির ফলাফলে কিছুটা পার্থক্য দেখতে পাই। তারপরও আমি আশাবাদী, কারণ আগের তুলনায় খুব বেশি পার্থক্য তৈরি হয়ে যায়নি।
এম তারিক আহসান আরও বলেন, সামনের বছরের পরীক্ষার্থীদের জন্য কিছু বিশেষ উদ্যোগ হাতে নেওয়া জরুরি। শিখন ঘাটতি পূরণে মনোযোগী হওয়া দরকার। তবে শুধুমাত্র ক্লাস নিয়ে এ ঘাটতি পূরণ সম্ভব নয়। শিখন-শেখন প্রক্রিয়ায়ও কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষের বাইরে বিভিন্ন দলে ভাগ করে অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে কিছু সমস্যা সমাধান করতে দেওয়া যায়।
ডিভাইস আসক্তি বিষয়ে তিনি বলেন, এই আসক্তি শহরকেন্দ্রিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে খুব বেশি, তবে গ্রাম বা উপশহরে যে একদমই নেই, এমন নয়। শিক্ষার্থীরা এখন ভার্চুয়াল জগতে সময় বেশি কাটায়। এটাও ফলাফলে কিছুটা প্রভাব ফেলেছে। এগুলো ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার জন্য নানারকম পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। অভিভাবকদের সচেতন করা জরুরি। সরকারিভাবে গেমসহ বিভিন্ন সাইটে প্রবেশে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। আবার প্রযুক্তিকে অস্বীকারও করা যাবে না। কারণ, সামনের পৃথিবী ডিজিটাল ডিভাইসনির্ভর। এজন্য তাদের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এটাকে ইতিবাচকভাবে যাতে তাদের জীবনে কাজে লাগানো যায়, তেমন একটা উদ্যোগ নিতে হবে।
সামগ্রিক ফলের বিষয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী বলেন, এবার যারা এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে, তারা এর আগে জেএসসি পরীক্ষা দেয়নি। নবম শ্রেণিতে তারা অনলাইনে ক্লাস করেছে। অনলাইনের ক্লাসে তো অনেক সময়ই শিক্ষার্থীরা সেভাবে মনোযোগ দিতে পারে না। এ ছাড়া প্রস্তুতির জন্য সময়ও কম পেয়েছে। যদিও সরকার পরীক্ষা পিছিয়ে সিলেবাস শেষ করার চেষ্টা করেছে, তবু কিছুটা পেরেছে, পুরোপুরি শেষ হয়নি। এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থীরা নবম শ্রেণিতে কম নম্বরে অল্প কয়েকটি পরীক্ষা দিয়েছে। করোনার পর তারা এবারই প্রথম ১০০ নম্বরের পরীক্ষা দিয়েছে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। তার একটা প্রভাব এসএসসির ফলাফলে পড়েছে। এ কারণে গতবারের তুলনায় এবার ফল কিছুটা খারাপ হয়েছে। তিনি আরও বলেন, করোনা মহামারি শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক চাপ তৈরি করেছিল। শিক্ষার্থীরা সেটি পাশ কাটিয়ে যে ফল করেছে, সেজন্য তাদের পাশাপাশি শিক্ষক, অভিভাবকসহ সবাইকেই ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। এবার যারা পরীক্ষা দিয়েছে, তাদের ওপর করোনার প্রভাব যেরকম ছিল, সামনের দিনগুলোতে যারা পরীক্ষা দেবে তাদের ওপর সেভাবে পড়বে না। আশা করছি, সামনের দিনগুলোতে ফল আরও ভালো হবে।
মন্তব্য করুন