ওয়াহেদুজ্জামান সরকার
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০২:২৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জাতিসংঘের সংস্কার আর কতদূর

বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, মানবাধিকার রক্ষা এবং আন্তর্জাতিক আইন সমুন্নত রাখার উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতিসংঘ। কিন্তু সেসব উদ্দেশ্য অধরা থেকে যাওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে জাতিসংঘের কার্যকারিতা নিয়ে। সেইসঙ্গে দাবি উঠেছে, যুদ্ধ ও সংঘাত বন্ধ করে কার্যকর শান্তি প্রতিষ্ঠায় একে নতুন করে ঢেলে সাজানোর। ভেটো ক্ষমতা বাতিলের দাবিও উঠছে জোরেশোরে। কিন্তু বৈশ্বিক এ প্রতিষ্ঠানটির সংস্কার কতদূর তা কেউ জানে না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী দেশগুলোর হাত ধরে ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতিসংঘ। বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, মানবাধিকার রক্ষা এবং আন্তর্জাতিক আইন সমুন্নত রাখার নীতিগত ম্যান্ডেট নিয়ে যার যাত্রা শুরু। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ (ইউএনএসসি) হলো এর সবচেয়ে প্রভাবশালী অঙ্গ সংগঠন। বিশ্বে শান্তি বজায় রাখতেই এর প্রতিষ্ঠা। এর সিদ্ধান্তগুলো বাধ্যতামূলক এবং সদস্য ও অসদস্য উভয় রাষ্ট্রের জন্যই প্রযোজ্য। এ পরিষদে ১৫ জন সদস্য প্রত্যেকে নিজেদের মতামত দিতে পারেন। প্রত্যেকের একটি করে ভোট প্রয়োগের ক্ষমতা রয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্য দেশের মধ্যে পাঁচটি স্থায়ী সদস্য। আর বাকি ১০টি অস্থায়ী সদস্য। স্থায়ী সদস্য দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন। নিরাপত্তা পরিষদে এ পাঁচটি দেশ ভোটের ক্ষেত্রে বিশেষ অধিকার ভোগ করে থাকে যাকে বলা হয় ভেটো ক্ষমতা। এ পাঁচটি দেশের কোনো একটা দেশ যদি কোনো প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়, তাহলে সেই প্রস্তাব রদ হয়ে যায়। এ পাঁচ স্থায়ী সদস্যদের স্বার্থের বাইরে জাতিসংঘ কার্যকর কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারে না। এর ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান হয় না। যেমন চীন ও রাশিয়ার ভেটোর কারণে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। এ ক্ষমতাবলে তারা অধিবেশনে উত্থাপিত যে কোনো প্রস্তাব আটকে দিতে সক্ষম। তা সেই প্রস্তাবের পক্ষে যত বেশি সদস্য দেশই ভোট দিক না কেন, এ পাঁচটি দেশের যে কোনো একটি দেশ ভেটো দিলে তা আর একচুলও সামনে এগোবে না। জাতিসংঘ তার পুরো ইতিহাস জুড়ে বড় মানবিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে ভালো কোনো সমাধান দিতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। গণহত্যা, জাতিগত নিধনযজ্ঞ ও গৃহযুদ্ধসহ বিশ্বজুড়ে চলমান সংঘাত এবং নৃশংসতা প্রতিরোধে ব্যর্থতা ও অক্ষমতার জন্য প্রায়ই সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে সংস্থাটি। ফলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে এর ভূমিকা নিয়ে নানা সময়ে প্রশ্ন উঠেছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু হচ্ছে ফিলিস্তিন সংকট। গত প্রায় আট দশক ধরে এ নিয়ে কাজ করছে জাতিসংঘ। কিন্তু সুনির্দিষ্ট বেশ কয়েকটি সমস্যা মীমাংসা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে ফিলিস্তিন সংকটের কোনো সমাধান করতে না পারা এর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। জাতিসংঘ নিজেকে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার দাবি করে এলেও, তারা সমস্যার কোনো সমাধান দিতে পারেনি। সাম্প্রতিককালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় জাতিসংঘের ব্যর্থতা ও বিতর্কিত আচরণ আরও একবার স্পষ্ট হয়, যা বিশ্বের অনেককেই হতাশ করেছে। কারণ দেশটির সাধারণ মানুষ মানবিক বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য সংস্থাটি কোনো ভূমিকা কার্যত রাখতে পারেনি। এর আগে লিবিয়া ও ইরাকে জাতিসংঘের কোনো ভূমিকাই দেখা যায়নি। যদিও যুদ্ধ ও সংঘাত থেকে মানুষকে রক্ষার অঙ্গীকারই ছিল জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ভিত্তি। গত বছর ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হয় এবং এরপর গত প্রায় দেড় বছর ধরে তা অব্যাহত রয়েছে। যার প্রভাবে টালমাটাল হয়ে উঠেছে বিশ্ব। কিন্তু কিছু বক্তব্য ও বিবৃতি ছাড়াও জাতিসংঘের তেমন কোনো কর্মকাণ্ড চোখে পড়ছে না।

বিভিন্ন সময় জাতিসংঘের সংস্কার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আর কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। কয়েক বছর আগে এক প্রস্তাবে পাঁচটি ক্ষেত্রে সংস্কার আনার কথা বলা হলেও এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভেটো। আর সে প্রশ্নে এ সংস্কার উদ্যোগটির বিরোধিতা করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের তিনটি স্থায়ী সদস্য—যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন। এমনকি আলোচনার জন্য রূপরেখা তৈরি করার ক্ষেত্রে অংশ নেওয়ার ব্যাপারেও অস্বীকৃতি জানায় তারা। আরেকটি বিষয়ে এ দেশগুলোর অবস্থান একই। তা হলো তারা সবাই নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ব্যবস্থায় কোনো ধরনের পরিবর্তন আনার বিরোধী। শুধু তাই নয়, স্থায়ী সদস্য পদে নতুন কোনো দেশকে গ্রহণের ক্ষেত্রেও একমত হতে পারছে না তারা। জাতিসংঘের নানামুখী ব্যর্থতায় বিশ্বের বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পদের জন্য দাবি জানালেও স্থায়ী সেই পাঁচ দেশের কারণে তা কার্যকর হচ্ছে না। ভারত, জাপান, জার্মানি ও ব্রাজিল—এ চার দেশ যাকে বলা হচ্ছে গ্রুপ-ফোর তারা নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পদের জন্য জোরালো দাবি জানিয়েছে। ২০০৫ সালে এ চারটি দেশ যৌথভাবে এ সংক্রান্ত একটি খসড়া প্রস্তাব পেশ করে। প্রস্তাবে ছয়টি নতুন স্থায়ী এবং চারটি অস্থায়ী সদস্য গ্রহণের কথা বলা হয়। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য সংখ্যা ১৫ থেকে বাড়িয়ে ২৫ করার প্রস্তাব রাখা হয়। তারা যে যৌথ প্রস্তাব রাখে, তাতে কোনো দেশের নাম করা হয়নি। তারা চায়, পশ্চিম ইউরোপ আর লাতিন আমেরিকা থেকে একটি করে নতুন স্থায়ী সদস্য নেওয়া হোক এবং এশিয়া আর আফ্রিকা থেকে দুটি করে। আরও চারটি নতুন আসন এশিয়া, আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপ আর লাতিন আমেরিকার অস্থায়ী সদস্যদের জন্য নির্দিষ্ট করার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবে। কিন্তু ভারত ও জাপানের স্থায়ী সদস্য পদের দাবির বিরোধিতা করে চীন। যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো ক্ষমতার প্রসার ঘটানোর বিরোধী। সেইসঙ্গে নতুন এ কাঠামো সমর্থন করতে রাজি নয় ওয়াশিংটন। তবে যুক্তরাষ্ট্র স্থায়ী সদস্য পদের জন্য জাপানের প্রার্থিতা সমর্থন করতে আগ্রহী। যুক্তরাজ্য আর ফ্রান্সের সমর্থন আছে চার প্রার্থী দেশের প্রতিই। এরকম এক পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের সংস্কার যে সুদূরপরাহত, তা না বললেও চলে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য কোর্সের লাগাম টানতে আরও একটি প্রচেষ্টা

বরিশালে আগুনে পুড়ল আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১০টি ঘর

১৫ বছরে রেলমন্ত্রীর অস্থাবর সম্পত্তি বেড়েছে ৩২ গুণ

আগামীকাল রোকেয়া দিবস : শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাবে নারী সংহতি

৭ বৈধ প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল চেয়ে আপিল

নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর করতে সবাইকে কাজ করতে হবে : তথ্যমন্ত্রী

জন্মের আগেই নবজাতক বিক্রি, অতঃপর...

ফরিদপুর-৩ / নৌকার প্রার্থী শামীম হকের প্রার্থিতা বাতিলে এ. কে. আজাদের আপিল

একাত্তরে গণহত্যা / জাতিসংঘের স্বীকৃতি দাবি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ১০০০ প্রতিনিধির 

নবম গ্রেডে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি

১০

নারায়ণগঞ্জে ছাত্রলীগের সাবেক নেতাকে গুলি

১১

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের অপরিহার্যতা বিষয়ে সেমিনার

১২

স্বর্ণের দোকানে ডাকাতি, নৈশপ্রহরীকে হত্যা

১৩

যবিপ্রবিতে চাকরিপ্রার্থীদের আটকে মারধর, ৬ জনের নামে মামলা

১৪

ডেঙ্গুতে আরও ৭ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ২৫১

১৫

রাজবাড়ীতে ট্রেন আটকে দিল এলাকাবাসী

১৬

জলাশয় ভরাট করে বিএডিসির ল্যাব নির্মাণ বন্ধে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি

১৭

শান্তিনগর, শাহজাহানপুর ও আরামবাগে বাহাউদ্দিন নাছিমের মতবিনিময়

১৮

শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা আ.লীগের সবচেয়ে বড় শক্তি : নাছিম

১৯

একই সিনেমায় অনুপম-পরমব্রত!

২০
X