

খুলনায় ভরদুপুরে মানুষের ভিড়ে ঠাসা আদালতপাড়ায় হাজিরা দিতে আসা দুই আসামির মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি এবং রামদা-চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ফাঁকা গুলি ছুড়ে অস্ত্র উঁচিয়ে চলে যায় দুর্বৃত্তরা। সন্দেহ নেই, এ ঘটনা দেশে বিরাজমান নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরই সাক্ষ্য বহন করে। খোদ আদালতপাড়ার মতো একটি স্পর্শকাতর জায়গায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার এ দুর্বলতার বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই গভীর উদ্বেগ ও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে বিভিন্ন মহলে।
খবরে প্রকাশ, দুদিনের সাপ্তাহিক ছুটি শেষে সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস গত রোববার সকালে খুলনার আদালতপাড়া ছিল মানুষে ঠাসা। মহানগর দায়রা জজ আদালতের বাইরের সড়কেও ছিল ভিড়। এরই মধ্যে হেঁটে এসে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করা হয় দুজনকে। খুলনার পূর্ব রূপসার বাগমারা এলাকার বাসিন্দা এজাজ শেখের ছেলে ফজলে রাব্বি রাজন এবং নগরীর সদর থানাধীন নতুন বাজার এলাকার বাসিন্দা আব্দুল মান্নাফের ছেলে হাসিব। তারা সোনাডাঙ্গা থানার একটি অস্ত্র মামলায় হাজিরা দিতে এসেছিলেন মহানগর দায়রা জজ আদালতে। হাজিরা দিয়ে বের হয়ে এক মোটরসাইকেলে দুজন উঠে বসার সঙ্গে সঙ্গে আগে থেকেই অপেক্ষায় থাকা ১০-১২ জনের একটি দল তাদের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে এবং এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। নিহতরা দুজনই একাধিক মামলার আসামি ও খুলনার তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী একটি গ্রুপের সদস্য বলে পুলিশ জানায়। জোড়া হত্যাকাণ্ডের সাড়ে ৯ ঘণ্টার মাথায় নগরীতেই আরেক যুবক গুলিবিদ্ধ হয় দুর্বৃত্তদের হাতে।
আদালতপাড়ার মতো একটি জায়গা, যেখানে কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে, সেখানে এমন পূর্বপরিকল্পিত একটি কিলিং মিশন চালাতে হলে দুর্বৃত্তদের বিভিন্ন প্রস্তুতি ও সময়ের দরকার হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এ সময়ে সেখানে নিয়োজিত বিভিন্ন স্তরের প্রশাসন কী দায়িত্ব পালন করলেন যে, তাদের সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে এমন ঘটাতে পারল?
গত বছর জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটে। এর কিছু বাস্তবিক কারণও ছিল। কেননা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যারা কাজ করবে, তাদের অবস্থাই ছিল নাজুক। যাই হোক, সেরকম পরিস্থিতি থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টায় অনেকটা উন্নতি ঘটালেও সম্পূর্ণরূপে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরানো সম্ভব হয়নি আইনশৃঙ্খলাকে। সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ভয়ভীতিহীন জায়গায় আনা সম্ভব হয়নি। এর ফল যেটা হয়, তাই হয়েছে। অর্থাৎ, অপরাধ কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। সন্ত্রাসী-দুর্বৃত্তরা নানা রকমের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে নিয়মিতভাবে ঘটছে হত্যার মতো ঘটনাও। বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে মব সৃষ্টি করে নিশানা করা ব্যক্তির ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনা ঘটছে। এতে ঘটছে হতাহতের ঘটনা। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে মব সহিংসতা ও গণপিটুনির অন্তত ২৫৬টি ঘটনায় ১৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অক্টোবর পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় অন্তত ১৬০ জন নিহত ও ৮ হাজার ৫০ জন আহত হন।
আমরা মনে করি, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একটি নির্বাচনী পরিবেশ বা স্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বড় রকমের অন্তরায়। স্বভাবতই তার আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতির কোনো বিকল্প নেই। ফলে যে করেই হোক, এদিকটায় স্বাভাবিক অবস্থা ফেরাতে সরকারকে আরও জোর দিতে হবে। মনে রাখা জরুরি, আদালতের মতো জায়গায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিরাপত্তার বিষয়টি চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
মন্তব্য করুন