

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ছোট্ট নাদিয়া জান্নাত তাসকিয়ার মৃত্যু যেন আরেকবার মনে করিয়ে দিল ডেঙ্গু কেবল একটি মৌসুমি রোগ নয়, এটি এখন সারা দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকিগুলোর একটি। চিকিৎসার জন্য ওষুধের দোকান নির্ভরতা, সঠিক সময়ে হাসপাতালে না পৌঁছাতে পারা, আর হাসপাতালেও সর্বোচ্চ চেষ্টা ব্যর্থ হওয়া নাদিয়ার গল্প আজ হাজারো পরিবারের গল্প। এ বছর ডেঙ্গুতে ৩৯৪ জনের মৃত্যু এবং প্রায় এক লাখ মানুষের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া স্পষ্ট করে দিয়েছে, ডেঙ্গু মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি এখনো অপ্রতুল।
শিশুদের মৃত্যুর সংখ্যা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। এক বছরে ৭০টি শিশুর মৃত্যু কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু থেকে শুরু করে কিশোর, সব বয়সের শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুর প্রায় ১৮ শতাংশই শিশু, যা দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভয়ানক দুর্বলতার ইঙ্গিত বহন করে। ডেঙ্গুতে শিশুদের মৃত্যু শুধু রোগ প্রকোপের কারণে নয়; বরং সময়মতো রোগ শনাক্ত না হওয়া, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না পাওয়া এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার ঘাটতির সমন্বিত ফল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নভেম্বর মাসে এডিস মশার বিস্তার কমার কথা ছিল। কিন্তু মাঠের বাস্তবতা ভিন্ন। এখনো শহর-নগর এমনকি গ্রামীণ এলাকাতেও এডিস মশার বংশবিস্তার নজিরবিহীনভাবে বেড়েছে। স্থানীয় সরকার সংস্থা, নগর কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশনের মশকনিধন কার্যক্রম বারবার প্রশ্নের মুখে পড়ছে। ধোঁয়াভিত্তিক ফগিংয়ের মতো পুরোনো ও অকার্যকর পদ্ধতির ওপর নির্ভরতা এখনো কমেনি। অথচ গবেষণা বহুবার দেখিয়েছে এই ফগিং এডিস নির্মূলে কার্যকর নয়। অন্যদিকে, বাসাবাড়ি, নির্মাণাধীন ভবন, ড্রেন, ছাদ, টব, পরিত্যক্ত পাত্রে জমে থাকা স্বল্পমাত্রার পানি এগুলোই ডেঙ্গুর মূল জন্মক্ষেত্র। এগুলো নিয়ন্ত্রণে কোনো সমন্বিত উদ্যোগ এখনো দেখা যাচ্ছে না।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালে ডেঙ্গুর সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যু রেকর্ড হয়েছিল ১ হাজার ৭০৫ জন এবং তিন লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত। কিন্তু সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থেকেও আমরা কোনো শিক্ষা লাভ করিনি। ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে এডিস মশা নির্মূল ছাড়া বিকল্প নেই। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করেছেন। তবুও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এখনো ঢিলেঢালা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন।
একটি কঠিন বাস্তবতা হলো—ডেঙ্গুর লক্ষণ শুরুতে সাধারণ জ্বরের মতো মনে হওয়ায় অনেকেই গুরুত্ব দেন না, চিকিৎসকের কাছে দেরিতে যান। নেতৃত্ব, সচেতনতা, ব্যবস্থাপনা প্রতিটি স্তরেই ঘাটতি রয়েছে। হাসপাতালের এনআইসিইউতে শিশুর মৃত্যু বাড়ছে, আবার অনেক হাসপাতালে জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। একদিকে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা, অন্যদিকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এখনো অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এখন প্রয়োজন চারটি জরুরি পদক্ষেপ। প্রথমত, সারা দেশে দ্রুত ও সমন্বিত মশা নিধন অভিযান। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় সরকার ও নগর কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমে জবাবদিহি নিশ্চিত করা। তৃতীয়ত, জনসচেতনতা বাড়ানো, যাতে মানুষ ঘরের ভেতর-বাইরে জমে থাকা পানি অপসারণে অভ্যস্ত হয়। চতুর্থত, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করা।
নাদিয়ার মৃত্যু আমাদের বিবেককে প্রশ্ন করে আর কত নাদিয়াকে হারানোর পর আমরা ডেঙ্গু প্রতিরোধে তৎপর হব? এখনই কঠোর ও পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ভবিষ্যৎ আরও ভয়াবহ হবে। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঠেকানো সম্ভব, কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্র, সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রয়াস। ডেঙ্গুকে মৌসুমি নয়, সময় এসেছে একটি সংকট হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার। নইলে প্রতি বছর আমাদের আরও বহু নাদিয়াকে হারাতে হবে।
মন্তব্য করুন