দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে প্রায় ৯ মাস। নতুন এ শিক্ষাক্রম যাদের হাতে সফল হবে বা যারা বাস্তবিকই এটাকে সফল করে তুলবেন, সেসব সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকই এখনো পাননি সরাসরি কোনো প্রশিক্ষণ! বছরের দুই-তৃতীয়াংশ সময় প্রায় শেষ, তখনো এসব শিক্ষকের সম্বল বলতে অনলাইনে এক দিনের দায়সারা প্রশিক্ষণ, যা আদতে কোনো প্রশিক্ষণই নয়, নতুন কারিকুলাম সম্পর্কে বড়জোর একটা ধারণা অর্জন। এর বেশি কিছু কিছু নয়। তবে বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে অনেকের এই এক দিনের প্রশিক্ষণও জোটেনি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওপর গুরুত্বের এই দৈন্য চিত্র কোনোক্রমেই প্রত্যাশিত নয়।
শুক্রবার কালবেলায় এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে যে বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা প্রাথমিকে সংশ্লিষ্টের চরম উদাসীনতারই প্রমাণ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ১ লাখ ১৫ হাজার সরকারি ও বেসরকারি স্কুল রয়েছে। শিক্ষক রয়েছেন ৬ লাখ ৫২ হাজার। এসব শিক্ষক মাত্র এক দিনের অনলাইন প্রশিক্ষণ নিয়েই ‘কোনোরকম’ পাঠদান চালিয়ে নিচ্ছেন তারা। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ শিক্ষকরা। নামকাওয়াস্তে ওই এক দিনের প্রশিক্ষণ ছাড়া সরাসরি আর কোনো প্রশিক্ষণ না পাওয়ায় তারা নিজেরাই নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠদানের অনেক বিষয় আয়ত্ত করতে পারেননি। যারা বিভিন্ন সমস্যায় পড়েছেন, তারা ফেসবুক, ইউটিউব দেখে দেখে শিক্ষাক্রমের বিভিন্ন জটিল বিষয়ের সমাধান নিজেরা করার চেষ্টা করেছেন। এতে করে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক সবাইকেই বেগ পেতে হচ্ছে। বিশেষ করে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পাঠদানে সম্মুখীন হচ্ছেন নানা জটিলতায়। অনেক শিক্ষকই তাদের অক্ষমতার জন্য শ্রেণিকক্ষের কাজ শিক্ষার্থীদের বাড়ি থেকে করে আনতে বলছেন। এমনই এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ স্তরের শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষা নিয়ে এ ধরনের অবহেলা কোনো বিবেচনাতেই গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়নের দায়িত্ব মূলত প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই)। সংস্থাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি কিন্ডারগার্টেন স্কুল, এনজিও পরিচালিত স্কুল এবং ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। তবে চলতি বছর জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১-এর আলোকে প্রণীত নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবইয়ে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পাঠদানের শুরু থেকেই এটির বাস্তবায়নের পদক্ষেপ প্রশ্নবিদ্ধ হয়। দেখা যায়, সে সময় প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না করেই এ স্তরের নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান শুরু করা হয়। সেইসঙ্গে মাধ্যমিক স্তরে স্বল্প ও ত্রুটিযুক্ত প্রশিক্ষণসহ নানা অভিযোগ ওঠে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এখনো এ অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। দেশের সব প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমনিতেই রয়েছে নানা সংকট—শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতের তারতম্য, শিক্ষাক্রম উপযোগী প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব এবং শিক্ষা উপকরণে ঘাটতিসহ নানা প্রতিকূলতা। এর মধ্যে চলতি বছরে চালু হওয়া নতুন কারিকুলামে মাধ্যমিক (ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি) শিক্ষকসহ প্রাথমিকের শিক্ষকের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে না পারা নির্দ্বিধায় সংশ্লিষ্টদের চরম ব্যর্থতা।
আমরা মনে করি, শিক্ষা নিয়ে হেলাফেলা করার অধিকার কারও নেই। প্রাথমিক পর্যায়ে নতুন শিক্ষাক্রমের যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি। সেই লক্ষ্যে প্রথমে শিক্ষকদের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং নতুন এ পদ্ধতির ওপর বিশেষভাবে তাদের দক্ষ করে গড়ে তোলাই এখন অত্যাবশ্যকীয় কাজ। কেননা, এ পদ্ধতির সফলতা ও ব্যর্থতা তাদের ওপরই নির্ভরশীল। পাশাপাশি এ দায়িত্বের সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্টরা তাদের দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। আমরা চাই, নতুন কারিকুলামে শিক্ষকদের দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য যত দ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মন্তব্য করুন