এম এ আজিজ
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৩:১৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জ্ঞানভিত্তিক জনশক্তিই প্রধান ভরসা

স্বয়ংক্রিয়তা বা অটোমেশনের যুগে দেশের অগ্রগতি জ্ঞানভিত্তিক বিজ্ঞানমনস্ক জনশক্তিই যেখানে প্রধান ভরসা, সেখানে দেশের বর্তমান উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অপ্রয়োজনীয় ‘সনদপ্রাপ্ত শিক্ষিত’ তরুণ বা যুবক সৃষ্টি করে কর্মহীন মানুষের দীর্ঘ তালিকাকে আরও দীর্ঘ করছে।

চলমান চতুর্থ শিল্প বিপ্লব জ্ঞানভিত্তিক স্বয়ংক্রিয়তা বা অটোমেশনের একটি চলমান প্রক্রিয়া। বর্তমান যুগে এ অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বিশ্বে শ্রমিকদের বিকল্প হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে উন্নত দেশের মতোই আমাদের দেশেও কয়েকটি গার্মেন্টস এবং ফার্নিচার শিল্পে রোবট ব্যবহারে শ্রমিকরা কর্মহীন হতে শুরু করেছে। এ ছাড়া আধা অটোমেশন শিল্প তো আছেই। পর্যায়ক্রমে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির আবিষ্কার বদলে দিচ্ছে মানুষের জীবন-জীবিকার গতিপথ।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা। বাংলাদেশে কমবেশি ৫৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ১১৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ১০১টি আলিয়া মাদ্রাসা এবং কমবেশি ৬০ হাজার কওমি মাদ্রাসা আছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যে ‘সনদপ্রাপ্ত শিক্ষিত’ জনগোষ্ঠী তৈরি করছে, তারা জ্ঞানভিত্তিক স্বয়ংক্রিয়তার যুগে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। তাই পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী জনশক্তি তৈরি করা সময়ের দাবি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ দেখিয়েছে, পাঁচটি খাত উৎপাদন, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, পরিবহন, কৃষি এবং নির্মাণ—মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৬৭ শতাংশ অবদান রাখে। এ পাঁচটি খাতকে গণনা করা হয় সব মিলিয়ে ১৫ খাত দিয়ে। এ ছাড়া ‘প্রবাসী আয়’র পাশাপাশি উৎপাদন খাতের সিংহভাগ আসে ‘তৈরি পোশাকশিল্প’ খাত থেকে। এসব খাতই শ্রমিকনির্ভর।

২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা হবে ৮০০ কোটি। পরের ২০ বছরে বাড়বে আরও ১০০ কোটি। এর ফলে সামগ্রিক চাহিদা বাড়বে, কিন্তু উন্নত দেশসহ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে জন্মহার কমছে বলে বার্ধক্যে উপনীত হওয়া জনশক্তিকে প্রতিস্থাপন করার মতো পর্যাপ্তসংখ্যক তরুণ থাকবে না।

অন্যদিকে বিবিএসের ৯ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে প্রকাশিত জনসংখ্যা জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। মোট জনসংখ্যার ৪২.৮৪ শতাংশ ১৫-৩৯ বছর বয়সী। এ ছাড়া শূন্য থেকে ১৪ বছর বয়সী ২৮.৮১ শতাংশ এবং চল্লিশোর্ধ্ব মানুষের হার ২৮.৭১ শতাংশ। অর্থাৎ তরুণ শ্রেণির সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৪৬ শতাংশ। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে এ তরুণ শ্রেণির ৪৬ শতাংশ জনসংখ্যাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

বর্তমানে দেশে যেহেতু তরুণদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৪৬ শতাংশ, সেহেতু আশা করা যায়, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আগামী ২০ বছর জুড়ে তরুণ বা কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকবে। এ সময়ই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল ভোগ করার শ্রেষ্ঠ সময়।

দেশে কর্মক্ষম জনশক্তি ৬৫.২৩ শতাংশ। এর অর্থ হলো, দেশ এখন জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকালের বা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধা ভোগ করছে। ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ হলো কোনো দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যার আধিক্য। এরপর এ আশীর্বাদের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড নাও থাকতে পারে। সুতরাং এখনই দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীকে স্বয়ংক্রিয়তার অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে উপযুক্ত জ্ঞানভিত্তিক বিজ্ঞানমনস্ক জনশক্তিতে গড়ে তুলতে হবে। অন্যথায়, দেশের অগ্রগতি বা জিডিপির চাকা নাও ঘুরতে পারে।

এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে পুরো বিশ্বের শ্রমিকরাই কাজ হারাতে থাকবে। বিশ্বে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে এবং দেশের উন্নয়নকে চলমান রাখতে হলে এ জ্ঞানভিত্তিক প্রযুক্তিই প্রধান ভরসা।

উল্লেখ্য, বিশ্ব প্রথম শিল্প বিপ্লবে পেয়েছে পানি ও বাষ্পীয় ইঞ্জিনের নানামুখী ব্যবহারিক কৌশল, দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবে বিদ্যুতের ব্যবহারিক নানা দিক, তৃতীয় শিল্প বিপ্লবে ইন্টারনেট এবং বর্তমান চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে পেয়েছে শিক্ষা, উৎপাদন ও শিল্পব্যবস্থার জ্ঞানভিত্তিক স্বয়ংক্রিয়করণের একটি চলমান প্রক্রিয়া।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব শব্দটির উৎপত্তি ২০১১ সালে জার্মান সরকারের একটি হাই-টেক প্রকল্প থেকে। এই চলমান শিল্প বিপ্লবে আগামী পৃথিবী হবে জ্ঞানভিত্তিক ‘রোবটিকস, ন্যানো, আইওটি, ডেটা সায়েন্স প্রযুক্তির পৃথিবী’। চলমান চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে ১০টি প্রযুক্তি বিশ্বে শ্রমিকের বিকল্প হয়ে উঠছে, তা হলো—১. ইন্টারনেট অব থিংকস (আইওটি), ২. আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা), ৩. রোবট, ৪. অ্যাডভান্সড ম্যাটেরিয়ালস, ৫. ক্লাউড টেকনোলজি, ৬. অটোনোমাস ভেহিকেল, ৭. সিনথেটিক বায়োলজি, ৮. ভার্চুয়াল অগমেন্টেড রিয়ালিটি, ৯. ব্ল্যাক চেইন ও ১০. থ্রিডি প্রিন্টিং।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে তিনটি প্রযুক্তি। যেমন—১. ইন্টারনেট অব থিংকস (আইওটি), ২. আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ও ৩. রোবট।

আইওটি : আমাদের চারপাশের সব বস্তু যখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে, সেটাই আইওটি।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, আপনার বাসার চুলাকে আপনি একবার শিখিয়ে দিলেন আপনি সপ্তাহের কোন দিন কখন কী খাবেন। আপনার চুলা সেটা মনে রেখে ঠিক সেই দিন সেই সময়ে আপনার চাহিদামতো খাবার রান্না করে রাখবে। মাসের শেষ সপ্তাহের শেষ দিনে কোনো হোটেলে খাবেন। সেদিন আপনার চুলা আপনার জন্য রান্না করবে না। অন্য ছয় দিন আপনার চাহিদামতো খাবার তৈরি করে রাখবে।

আবার ধরুন আপনাকে বাজার করতে হবে। আপনার ফ্রিজের ভেতরে কী আছে তা নিজেই আপনাকে জানাবে বা নিজেই সরাসরি অনলাইনে অর্ডার করে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আনবে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা : আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা মেশিন ইন্টেলিজেন্স মূলত যে চারটি কাজ করতে পারে তা হলো—১. কথা শুনে চিনতে পারা, ২. নতুন জিনিস শিখতে পারা, ৩. পরিকল্পনা করতে পারা এবং ৪. সমস্যার সমাধান করতে পারা।

রোবট : রোবট একটি যান্ত্রিক কৃত্রিম কার্যসম্পাদক। রোবট সাধারণত একটি ইলেকট্রো-যান্ত্রিক ব্যবস্থা, যার কাজকর্ম, অবয়ব ও চলাফেরা প্রায় মানুষের মতো, যা বিভিন্ন কাজে মূলত মানুষের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। রোবট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় পরিচালিত একটি অত্যাধুনিক যন্ত্র। রোবটকে দিয়ে নিখুঁতভাবে মানুষের দেহে জটিল অপারেশনসহ যে কোনো কাজ করানো যায়।

রোবট নিচের ধর্মগুলোর সব বা অংশবিশেষ প্রদর্শন করে। যেমন—১. প্রাকৃতিক নয়, কৃত্রিম, ২. পরিবেশ অনুভব করার ক্ষমতা আছে, ৩. পরিবেশের বস্তু নিয়ে কাজ করতে পারে, ৪. কিছুটা বুদ্ধিমত্তা আছে, ৫. পরিবেশ বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, ৬. কম্পিউটারের মাধ্যমে প্রোগ্রামযোগ্য, ৭. ঘুরতে পারে ও স্থানান্তর করতে পারে, ৮. দক্ষভাবে সুনিয়ন্ত্রিত চলন প্রদর্শন করতে পারে এবং ৯. স্বেচ্ছায় কাজ করছে, এরকম আভাস দিতে পারে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ : ১. তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, ২. প্রযুক্তিগত সমস্যায় উৎপাদনে ব্যাঘাত সৃষ্টি, ৩. ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করা, ৪. ইন্টারনেট ও অন্যান্য প্রযুক্তির মধ্যে অব্যাহত সংযোগ নিশ্চিত করা এবং ৫. স্বয়ংক্রিয়তার কারণে বহু মানুষের কাজের সুযোগ হ্রাস পাওয়া।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা : ১. স্বয়ংক্রিয়তার প্রভাবে কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি হ্রাস, ২. উৎপাদন শিল্পে নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি, ৩. স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে বড় পরিবর্তন এবং ৪. বিশেষায়িত পেশার চাহিদা।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গভীর নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে রোববার

‘ঘুষ’ নিয়ে বরখাস্ত হান্নান এবার জাতীয় নির্বাচনের দায়িত্বে!

যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় নিহত ২

নৌকার প্রার্থীকে শুভেচ্ছা জানানো সেই পুলিশ কর্মকর্তা প্রত্যাহার

আ.লীগ প্রার্থী রাজী মোহাম্মদ ফখরুলকে শোকজ

পঞ্চগড়ে বাকপ্রতিবন্ধীর জমি দখলের অভিযোগ

ভাগ-বাটোয়ারার নির্বাচন করতে দেবে না জনগণ : রিজভী

দক্ষিণ আফ্রিকায় অর্থ পাচারে ৫ বাংলাদেশির নাম

স্বামীর খোঁজে বাংলাদেশে ভারতীয় তরুণী

নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন : শামীম ওসমানকে শোকজ

১০

ইসির সিদ্ধান্তে আওয়ামী লীগের আস্থা আছে : ওবায়দুল কাদের

১১

ফার্মগেটে জোড়া ককটেল বিস্ফোরণ

১২

মায়ের হত্যার বিচার করতে, বিপাশা হতে চায় পুলিশ

১৩

বিশিষ্টজনদের মতামত / গণতন্ত্র রক্ষায় নির্বাচনের বিকল্প নেই

১৪

ভার্চুয়াল বৈঠক / ইইউকে নির্বাচন বয়কটের কারণ জানাল বিএনপি 

১৫

ফ্রান্সকে হারিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানি

১৬

যে কারণে যুদ্ধবিরতির আলোচনা শেষ করে দিল ইসরায়েল

১৭

‘নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের নামে প্রজন্ম ধ্বংসের নীলনকশা করেছে সরকার’

১৮

ভূমিকম্প আতঙ্কে দোতলা থেকে লাফ দিয়ে দুই শিক্ষার্থী আহত

১৯

জলবায়ু অভিঘাত মোকাবিলায় সর্বজনীন আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থার আহ্বান তথ্যমন্ত্রীর

২০
X