দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপদাহ। অসহনীয় গরমে জনজীবন বিপর্যস্ত। কমে গেছে বাতাসের আর্দ্রতা। হিট স্ট্রোকে মানুষ মারা যাওয়ার খবরও পাওয়া যাচ্ছে গণমাধ্যমে। তীব্র তাপদাহে হাঁসফাঁস করছে বাংলার মানুষ। পশুপাখিও ভালো নেই। একপশলা বৃষ্টির জন্য হাহাকার করছে সবাই। শস্য ফলানোসহ পশুপাখির খাবারের জন্য এ মুহূর্তে যেমন বৃষ্টি দরকার, তেমনি তীব্র তাপদাহে সৃষ্ট নানা জটিলতা ও কষ্ট থেকে মুক্তি পেতেও আল্লাহর রহমতের বৃষ্টি খুবই প্রয়োজন। বাসাবাড়ি থেকে মানুষ বের হতে পারছে না, বেরিয়ে এলেও গরম আর পিছু ছাড়ছে না। দুনিয়ার বুকেই যেন বইছে জাহান্নামের তপ্ত লু-হাওয়া। হাদিসের ভাষ্য থেকেও জানা যায়, গ্রীষ্মের এ তপ্ত আভা আসে জাহান্নামের নিঃশ্বাস থেকে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জাহান্নাম তার রবের কাছে অভিযোগ করে বলে, হে রব, আমার এক অংশ অন্য অংশকে খেয়ে ফেলেছে। মহান আল্লাহ তখন তাকে দুটি নিঃশ্বাস ফেলার অনুমতি দেন। একটি নিঃশ্বাস শীতকালে, আরেকটি গ্রীষ্মকালে। কাজেই তোমরা গরমের তীব্রতা এবং শীতের তীব্রতা পেয়ে থাকো।’ (বুখারি, হাদিস : ৩২৬০)
এ অসহনীয় গরমের ধর্মীয় ও জাগতিক অনেক ব্যাখ্যা আছে। আমরা জানি, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘোরে। এ ঘোরার সময় পৃথিবী সূর্যের দিকে সামান্য হেলে থাকে। পৃথিবী আবার তার নিজ অক্ষেও ঘোরে, তাই বিভিন্ন সময় পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ সূর্যের দিকে হেলে থাকে। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধ কখনো সূর্যের কাছে চলে যায়, আবার কখনো উত্তর গোলার্ধ। যখন যে অংশ সূর্যের দিকে হেলে থাকে তখন সেই অংশ খাড়াভাবে বেশিক্ষণ ধরে সূর্যের আলো ও তাপ পায়। আর তখন সেই অংশে বেশি গরম পড়ে। এ সময় থাকে গ্রীষ্মকাল। একটা অংশ সূর্যের কাছে থাকা মানে তার উল্টো দিকের অংশটা থাকবে সূর্য থেকে দূরে। আর দূরে থাকলে সেই অংশটা কম আলো ও তাপ পাবে। তখন সেই অংশে থাকে শীতকাল। বর্তমান তাপদাহের কারণ যেটাই হোক, মানুষ ও পশুপাখির যে কষ্ট হচ্ছে এটাই বাস্তব। এ থেকে মুক্তি দরকার। ইসলামে একজন মুসলমানের জন্য এ বিষয়েও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আরবের মরু অঞ্চলে উত্তপ্ত বালু ও মরুঝড়ের কারণে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ সৃষ্টি হতো। তাই রাসুল (সা.) জোহরের নামাজ কিছুটা বিলম্বে আদায় করতেন। এ জন্য গরম বেশি পড়লে জোহরের নামাজ দেরিতে পড়া সুন্নত। সাহাবি আবু জর (রা.) বলেন, এক সফরে আমরা রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। একসময় মুয়াজ্জিন জোহরের আজান দিতে চেয়েছিল। তখন রাসুল (সা.) বললেন, গরম কমতে দাও। কিছুক্ষণ পর আবার মুয়াজ্জিন আজান দিতে চাইলে রাসুল (সা.) পুনরায় বলেন, গরম কমতে দাও। এভাবে তিনি নামাজ আদায়ে এত বিলম্ব করলেন যে, আমরা দূরবর্তী টিলাগুলোর ছায়া দেখতে পেলাম। অতঃপর রাসুল (সা.) বলেন, গরমের প্রচণ্ডতা জাহান্নামের উত্তাপ হতে নির্গত। কাজেই গরম প্রচণ্ড হলে উত্তাপ কমার পর নামাজ আদায় করো। (বুখারি, হাদিস : ৫৩৯)। অর্থাৎ দুপুরের গরম কিছুটা হ্রাস পেলে জোহরের নামাজ আদায় করো। এ থেকে রাসুল (সা.)-এর দয়ার্দ্রতার বিষয়টি উপলব্ধি করার পাশাপাশি এ শিক্ষা ও প্রচ্ছন্ন নির্দেশ পাওয়া যায় যে, প্রচণ্ড গরমে কর্তাব্যক্তিদের এ বিষয়ে লক্ষ রাখা জরুরি—যেন অধীনরা তীব্র গরমে অতিরিক্ত কষ্টে নিপতিত না হয়। তাই তাদের কর্তব্য হলো, প্রখর তাপমাত্রায় কর্তব্যরতদের কাজের সময়ে কিছুটা পরিবর্তন ঘটানো কিংবা তাপ নিয়ন্ত্রণের উপযুক্ত ব্যবস্থা করা। যেন তীব্র তাপদাহে তাদের কাজ করতে কষ্ট না হয়।
গরমের তীব্রতা জাহান্নামের তীব্রতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কাজেই তীব্র গরমে জাহান্নামের কথা স্মরণ করে মহান আল্লাহর কাছে জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাওয়া উচিত। প্রচণ্ড গরম থেকে রক্ষা পেতে আল্লাহর দরবারে বৃষ্টি কামনা করে নামাজ পড়া ও দোয়া করা সুন্নত। ইসলামী পরিভাষায় এ দোয়ার নাম ‘ইসতিসকা’ বা সিক্তকরণের দোয়া এবং নামাজের নাম ‘সালাতুল ইসতিসকা’ বা ‘বৃষ্টি কামনায় নামাজ’।
প্রকৃতির এই রুক্ষ-রুদ্র মুহূর্তে একজন আদর্শ মুসলমানের কর্তব্য, এ অবস্থায় ইসলাম কী নির্দেশ দেয় তা জেনে মান্য করা। গরমের তীব্রতা এবং অসহনীয় প্রখরতার সময় রাসুল (সা.) কিছু কাজ নিজে করেছেন, কিছু বিষয়ের নির্দেশ দিয়েছেন এবং তার কয়েকটি নির্দেশনা এমন রয়েছে যেগুলোর প্রতি গুরুত্বারোপ করলে তীব্র-তাপ থেকে মুক্তি সম্ভব। দুনিয়ার জীবনে গরমের তীব্রতায় একজন মুমিনের মানসপটে উদিত হয় জাহান্নামের সে প্রলয়ংকরী অগ্নি-শাস্তির কথা। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, গরমের দিন আল্লাহ তার শ্রবণ ও দৃষ্টিকে আসমানবাসী এবং পৃথিবীবাসীর দিকে নিবিষ্ট করেন। যখন বান্দা বলে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ! আজকে কী প্রচণ্ড গরম! আল্লাহুম্মা আজিরনি মিন হাররি জাহান্নাম, হে আল্লাহ! আমাকে জাহান্নামের তীব্র-তাপ হতে মুক্তি দাও।’ আল্লাহতায়ালা তখন জাহান্নামকে বলেন, ‘আমার এক বান্দা আমার নিকট তোমার থেকে মুক্তি চেয়েছে। আর আমি তোমাকে সাক্ষী রাখছি যে, আমি তাকে মুক্তি দিলাম।’ (বাইহাকি)। সুতরাং তীব্র গরমের এ সময়ে আমরা জাহান্নাম থেকে মুক্তির দোয়া অব্যাহত রাখব; যেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের জাহান্নামের তীব্র সেই আজাব থেকে মুক্তি দান করেন। সূর্যের প্রচণ্ড তাপবর্ষণে আমাদের শরীর থেকে দরদর করে ঘাম ঝরে, এর ওপর আবার পথঘাটের ধুলাবালু মিশে উৎকট দুর্গন্ধের সৃষ্টি করে। শরীর হয়ে পড়ে নিস্তরঙ্গ ও দুর্বল। তা ছাড়া শরীর ঘেমে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হলে আশপাশের মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না। আল্লাহর রাসুল (সা.) তাই গরমের তীব্রতায় অতিরিক্ত ঘাম, শরীরের দুর্গন্ধ এবং অন্যকে কষ্ট দেওয়া থেকে বাঁচতে গোসলের নির্দেশ দিয়েছেন। আয়েশা (রা.) বলেন, লোকজন তাদের বাড়ি ও উঁচু এলাকা হতেও জুমার নামাজের জন্য পালাক্রমে আসতেন। আর ধুলাবালুর মধ্য দিয়ে আগমনের কারণে তারা ধুলোমলিন ও ঘর্মাক্ত হয়ে যেতেন। তাদের শরীর থেকে ঘাম ঝরত। একদিন তাদের একজন আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর কাছে এলেন। তখন নবী (সা.) আমার কাছে ছিলেন। তিনি তাকে বললেন, ‘যদি তোমরা এ দিনটিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে ও গোসল করতে!’ (বুখারি : ৯০২)। এর মাধ্যমে তীব্র গরমের সময় গোসলের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা যায়।
প্রচণ্ড তাপদাহের সময়ে আমরা বুঝতে পারি এক ফোঁটা বৃষ্টিজলের কী মূল্য। এ সময় মুমিনের কর্তব্য মহান আল্লাহর কাছে বৃষ্টি চেয়ে দোয়া ও ইস্তিগফার করা। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপে বাংলার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠলে গেয়ে ওঠে ‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দে ও আল্লাহ মেঘ দে’। গরমের তীব্রতা বৃষ্টির বর্ষণই ভালোভাবে কাবু করতে পারে। তীব্র তাপপ্রবাহে তাই সবারই প্রাণের চাওয়া একপশলা বৃষ্টি। আল্লাহর রাসুল (সা.) গরমের তীব্রতায় অতিষ্ঠ উম্মতদের শিখিয়ে দিয়ে গেছেন বৃষ্টি প্রার্থনার দোয়া—‘আল্লাহুম্মা আগিসনা’ (তিনবার) অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করুন। (বুখারি, হাদিস : ১০১৪)।
আমাদের জীবনে রাসুল (সা.)-এর সব নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে পারলেই সব প্রকার দুরবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি মিলবে; দুনিয়ার জীবনে এবং আখিরাতেও। মুসলমানের জন্য আশার কথা হচ্ছে, গরমের এ তীব্রতা সত্ত্বেও অর্জন করা যায় কিছু সুফল। এ সুযোগে মুমিন অর্জন করতে পারেন মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি। আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার আরও মাধ্যম হচ্ছে, গরিব-দুঃখীর মাঝে সুমিষ্ট ফল বিতরণ করা, ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করা, ঘামে ভেজা শরীরে জনসমাগমে গমন না করা এবং গরমে প্রবাহিত ঘামের গন্ধ যেন অন্যের কষ্টের কারণ না হয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখা; গ্রীষ্মকালকে গালমন্দ না করা বিষয়টিও খেয়াল রাখার নির্দেশ দেয় ইসলাম। কারণ এ গরমেই মানুষের জন্য পরিপক্ব হয় আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু। রান্নাঘরে চুলায় যেমন আগুন জ্বালালে রান্না হয় সুস্বাদু খাবার, তেমনি প্রকৃতিতেও উত্তাপ ছড়ালে আমরা লাভ করি প্রভুর অপূর্ব নেয়ামত।
লেখক : মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ
মন্তব্য করুন