পুতুল নাচের ইতিকথা বাঙালি সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা তৃতীয় উপন্যাস ও চতুর্থ মুদ্রিত গ্রন্থ। উপন্যাসটিতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমাজতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় মেলে। বোধহয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ উপন্যাস তার রচিত ৩৭টি উপন্যাসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বললেও অত্যুক্তি হবে না। ১৯৩৬ সালে উপন্যাসটি প্রকাশের পর ইংরেজি, হিন্দি, কানাড়ি, চেক, সুইডিশ, গুজরাটি, তেলেগুসহ বিভিন্ন ভাষায় রূপান্তরিত হয়। এ ছাড়া ১৯৪৯ সালে অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় সিনেমাও তৈরি করা হয়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন, ‘সত্যই তো আর পুতুল নয় মানুষ। অদৃশ্য শক্তি বা অন্য মানুষের আঙুলে বাঁধা সুতার টানে সত্যিই তো মানুষ পুতুলের মতো নাচে না।’ তবে তিনি যখন পুতুল নাচের ইতিকথা নামে উপন্যাস লিখলেন, প্রশ্ন আসতেই পারে—এই পুতুলের অদৃশ্য দড়ি কার হাতে? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে পাঠককে উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র শশী এবং আবর্তনে থাকা গাওদিয়ার মানুষের সাদামাটা জীবনযাত্রার গভীরতাকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তাহলে বোধগম্য হবে, লেখকের মতে সেই অদৃশ্য দড়ি কোনো অদৃশ্য শক্তির কাছে বাঁধা পড়েনি। বাঁধা পড়ে আছে মানুষের নিজের হাতেই। মানুষ সব জেনেও পুতুল হয়ে থাকে, কখনো সমাজের কাছে, কখনো পরিবারের কাছে আবার কখনো বা ভালোবাসার মানুষের কাছে। যেমন কুসুম সাতটি বছর অবহেলার পুতুল হয়ে কাটিয়েছে গাওদিয়ায়। আবার নিজে থেকে সুতা টেনে গুটিয়ে চলে গেছে বাপের বাড়ি। এমন অনেক দৃষ্টান্ত লেখক মানুষের জীবন নামের পুতুল খেলাকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন।
উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র গ্রামের ডাক্তার শশী। ঈশ্বরের প্রতি তার বিশ্বাস নেই। গ্রামের পটভূমিতে শশী, শশীর পিতা, কুসুমসহ অন্য চরিত্রগুলোর মধ্যে বিদ্যমান জটিল সামাজিক সম্পর্ক নিয়েই গড়ে উঠেছে এর কাহিনি ও প্রেক্ষাপট। ক্ষয়িষ্ণু সমাজের প্রেম, বিরহ, দ্বেষ ও পারস্পরিক সহমর্মিতাকে উপজীব্য করে লেখা এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র শশী সদ্য ডাক্তারি পাস করে গ্রামে আসে। বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভিন্নতর সংস্কৃতি কিংবা সহজ ভাষায় উন্নত জীবনের সন্ধানে বেরিয়ে যাবে সে; কিন্তু শেষমেশ সে আর প্রথাগত জীবনের বাইরে যেতে পারে না। গ্রামীণ জীবনের প্রতিবেশ-পরিবেশের বৈচিত্র্য আর বাস্তবতার ডালপালা এমনভাবে তাকে আঁকড়ে ধরে; তাকে ছিঁড়ে বের হওয়া শশীদের সামর্থ্যের বাইরে। কুসুম ২৩ বছর বয়সী বাঁজা মেয়ে। উপন্যাসের এক চরিত্র পরাণের স্ত্রী। সে রহস্যময়ী ও বিচিত্ররূপিনী এক নারী। তার খামখেয়ালিপনা, খাপছাড়া প্রকৃতি তাকে রহস্যময়ী করে তুলেছে। শশীর জন্য রয়েছে তার ‘উন্মাদ ভালোবাসা’। কুসুমের স্ফুট-অস্ফুট প্রেম শেষ পর্যন্ত অন্য এক রূপ নেয়, অন্য মাত্রা নেয়।
অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে রয়েছে যাদব পণ্ডিত। তিনি ধার্মিক ও অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে গ্রামের সবার কাছে পরিচিত। অন্ধবিশ্বাসের ফাঁদে মানুষকে আটকে রেখে সে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করতে জানে। এ ছাড়া এতে বিন্দু, নন্দ, কুমুদ, মতি, জয়া, বনবিহারি, নন্দলাল, যামিনী কবিরাজ ও সেনদিদির মতো নানা রকম বাস্তব চরিত্রকে জীবনের নানা স্তর থেকে উঠিয়ে এনেছেন লেখক। গ্রন্থনা : সঞ্জয় হালদার
মন্তব্য করুন