যাত্রাপথে সহযাত্রীর সান্নিধ্য লাভের অভিজ্ঞতা প্রায় সবার রয়েছে। স্বজন, বন্ধু, অপরিচিত—যে কেউ সহযাত্রী হতে পারেন। এমনকি মনের মানুষকে সহযাত্রী হিসেবে পাওয়াও বিরল ঘটনা নয়। অন্যদের মতো এমন অভিজ্ঞতা আমারও রয়েছে। তাদের কথা বলছি না। বলছি ভিন্ন ধরনের এক সহযাত্রীর কথা, যার নাম বই।
আজকাল রেলস্টেশনে বুকস্টল তেমন চোখে পড়ে না। শৈশবে বিভিন্ন রেলস্টেশনে বুকস্টল দেখেছি। যাত্রীরা সেখান থেকে পছন্দ অনুযায়ী বই/পত্রিকা কিনে ট্রেনে চড়তেন। হঠাৎ কোনো স্টেশনে বুকস্টল দেখলে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। প্ল্যাটফর্মে তখন মা, বাবা, ভাই, বোনের সাথে দাঁড়িয়ে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতাম। কখনো কখনো অপরিচ্ছন্ন ওয়েটিং রুমে বসতাম। বাবা পছন্দনীয় কোনো বই বা পত্রিকা কিনে আনতেন।
ট্রেনে, বাসে, প্লেনে, লঞ্চে, নৌকায়—বিভিন্ন যানে চড়ে দেশ-বিদেশ ঘুরেছি। সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্য পেয়েছি ট্রেনে চড়ে। ইউরোপের দেশগুলোতেও দেখেছি অধিকাংশ যাত্রী ট্রেন পছন্দ করেন। সেখানে ট্রেনের যাত্রীদের এক চমৎকার অভ্যাস গড়ে উঠেছে। প্রায় প্রত্যেক যাত্রীর হাতে কোনো বই বা ম্যাগাজিন। এমনকি যে যাত্রী আসনের অভাবে দাঁড়িয়ে আছেন তিনিও বই পড়ছেন। কী অপূর্ব দৃশ্য। কোনো কোলাহল বা চিৎকার নেই। সবাই যার যার বইয়ে বুঁদ হয়ে আছে। এমন দৃশ্য কি আমাদের দেশে কল্পনা করা যায়? শব্দদূষণের পাশাপাশি হাতাহাতির দৃশ্যও বিরল নয় এদেশের যানবাহনে। এক বছর ইউরোপ বাসের সময় বই ছিল আমার নিত্যসঙ্গী। নানা দেশ ভ্রমণের সময় আমার হাতে ছিল অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘পথে প্রবাসে’ বইটি। গত শতাব্দীর বিশের দশকে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস)-এর সদস্য হিসেবে ইংল্যান্ডে প্রশিক্ষণ গ্রহণকালে পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশে ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। আট দশক পরে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের সদস্য হিসেবে সরকারি বৃত্তি নিয়ে আমি ইংল্যান্ডে পড়তে যাই। অন্নদাশঙ্কর রায়ের বই পড়তে পড়তে তাঁর স্মৃতিবিজড়িত স্থানে আমিও ঘুরেছি। মনে মনে ভেবেছি তার বইয়ের মতোই একটি অসাধারণ ভ্রমণ কাহিনি লিখবো। নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন থেকেই ‘ইউরোপের পথে পথে’ নামে আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা লিখেছিলাম।
প্রথম কর্মস্থল রাজশাহীতে যখন যোগদান করতে যাই, তখন আমার হাতে ছিল ফিলিপ মেসনের ‘The Men Who Ruled India’ বইটি। সিভিল সার্ভিসে কর্মজীবন শুরু করতে যাওয়ার মুহূর্তে যাত্রাপথে আমার হাতে ছিল উপমহাদেশে সিভিল সার্ভিসের গোড়াপত্তনের পরিয়জ্ঞাপক এই বইটি। চাকরিসূত্রে রাজশাহী, ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর ও ঢাকায় পদায়িত হয়েছি। এ কারণে দেশের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে আমাকে ঘুরতে হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ে পছন্দের যান হিসেবে বেছে নিয়েছি ট্রেনকে।
ট্রেনে ভ্রমণের সময় নিঃসঙ্গ যাত্রায় আমার অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী ছিল বই। ট্রেন ভ্রমণ করতে কত বইয়ের সাগরে যে ডুবে গেছি, তার ইয়ত্তা নেই। কয়েক বছর আগে রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানে আলোচনা করতে খুলনা গিয়েছিলাম। টাঙ্গাইল থেকে আন্তঃনগর সুন্দরবন এক্সপ্রেসে চড়লাম। প্রায় আট ঘণ্টার যাত্রা। যমুনা নদী, হার্ডিঞ্জ সেতুসহ কত মনোহর দৃশ্য চারপাশে। কিন্তু আমার চোখ আটকে ছিল প্রমথনাথ বিশীর ‘শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ’ বইয়ে। শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের অপূর্ব জীবনকথায় বারবার হারিয়ে যাচ্ছিলাম। খাওয়া ও সামান্য ঘুমের সময়টুকু ছাড়া বাকি সময় বইয়ের রাজ্যে ছিলাম। সন্ধ্যাবেলায় নিজেকে আবিষ্কার করলাম খুলনা রেলস্টেশনে।
সবচেয়ে বেশি ট্রেন ভ্রমণ করেছি ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে। এমনও হয়েছে, মাসে অন্তত আটবার আসা-যাওয়া করেছি। প্রতিটি যাত্রার গড় সময় ছিল চার ঘণ্টা। অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দিয়েছি বইয়ের সান্নিধ্যে। এ সময়ে কত বই ও সাহিত্য পত্রিকা পড়েছি, তার হিসাব নেই। কখনো সাহিত্য পত্রিকা ‘দেশ’-এর কোনো সংখ্যা, কখনো ‘বইয়ের দেশ’ পত্রিকা, কখনো বাংলা বা ইংরেজি কোনো বই। যাওয়া-আসা উভয়ক্ষেত্রেই বিকেলে যাত্রা শুরু হতো। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতে গন্তব্যে পৌঁছতাম। সন্ধ্যায় যখন চারপাশে অন্ধকার নেমে আসতো, স্বভাবতই কামরার ভেতরে আলো জ্বালানোর প্রয়োজন হতো। লক্ষ করেছি, অধিকাংশ যাত্রীর অন্ধকারের প্রতি পক্ষপাত রয়েছে।
এমন নয় যে, অন্ধকারে নীরবতার মধ্যে তারা কোনো ধ্যান করছেন বা কোনো বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তামগ্ন। আলো নিভিয়ে যার যার স্মার্ট ফোনে ডুবে থাকাই ছিল তাদের স্বভাব। তাদের বিরক্তি উৎপাদন করে আলো জ্বালিয়ে আমাকে বই পড়তে হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে একটি স্মরণীয় ঘটনা উল্লেখ করি। আন্তঃনগর ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস ট্রেনে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে যাচ্ছি। হাতে ছিল মাইকেল ক্যারিটের ‘A Mole in the crown’ বইটি। এটি একটি দুষ্প্রাপ্য বই। গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভারতবর্ষে আইসিএস অফিসার হিসেবে তিনি নিজের চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন বইটিতে। তন্ময় হয়ে বইটি পড়ছিলাম। ময়মনসিংহে পৌঁছানোর পূর্বমুহূর্তে ওপরের র্যাক থেকে ব্যাগ নামিয়ে ট্রেন থেকে নামার প্রস্তুতি নিলাম। নামার পর গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেলাম। ততক্ষণে ট্রেন পরবর্তী স্টেশনের দিকে রওনা হয়েছে। এমন সময় মনে পড়লো সেই বইটি ব্যাগে ঢোকানো হয়নি। ট্রেনেই ফেলে এসেছি। মন বিষণ্নতায় ছেয়ে গেল। চেষ্টা করলে এই বইয়ের আরেকটি কপি হয়তো সংগ্রহ করতে পারব। এই বইটি পড়ার সময় দাগ দিয়ে নোট রেখেছিলাম একটি প্রবন্ধ লেখার জন্য। অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল।
হঠাৎ ট্রেনে কর্মরত আমার পরিচিত এক টিটিইর কথা মনে পড়ে গেল। তাকে দ্রুত ফোন করে আমার বগির তথ্য ও আসন নম্বর জানিয়ে আমার সমস্যার কথা বললাম। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন। কিছুক্ষণ পরে ফোন করে জানালেন ট্রেনে কর্মরত এক স্টাফ বইটি নিজের কাছে রেখেছেন। তিনি জামালপুরে নেমে যাবেন। ২-১ দিনের মধ্যেই বইটি পাব। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। দু’দিন পর বিকেলে আন্তঃনগর তিস্তা ট্রেনে চড়লাম ঢাকার উদ্দেশে যাত্রার জন্য। ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে একজন স্টাফ এসে বইটি ফেরত দিয়ে গেল। সেই টিটিইর প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে উঠলো। হারানো সম্পদ ফিরে পাওয়ার আনন্দে আমি তখন চঞ্চল |
বইটি ফেরত পেয়ে আর দেরি করিনি। অন্য বই পড়া ও লেখালেখি স্থগিত করে শুধু এই বইটি পড়েছি কয়েকদিন। এর একটি কারণ ছিল। কারণটি সচেতন পাঠকমাত্রই জানেন। বনফুলের ‘পাঠকের মৃত্যু’ এক অবিস্মরণীয় গল্প। আসানসোল রেলস্টেশনে সহযাত্রীর হাত থেকে একটি বই নিয়ে গোগ্রাসে পড়ছিলেন এক পাঠক। ব্যাকুলতার সাথে বইটি পড়তে গিয়ে নির্ধারিত ট্রেন মিস করতে হয় তাকে। সেই বইয়ের শেষ কয়েকটি পাতা না থাকায় অতৃপ্তি নিয়ে এই পাঠক দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছিলেন। হঠাৎ এক আত্মীয়ের বাড়িতে সেই বইটি পেয়ে অধীর আগ্রহে পড়া শুরু করেছিলেন। কিন্তু পড়তে গিয়ে আগের আগ্রহ আর পেলেন না। এবারও বইটি শেষ করতে পারলেন না। পাঠকের মৃত্যু এভাবেই ঘটে।
আমার মনেও আশঙ্কা ছিল—ট্রেনে হারিয়ে ফেলা বই বহু বছর পর ফিরে পেয়ে যদি আর পড়তে ইচ্ছে না করে! সময়ের ব্যবধানে কত পাঠকের মৃত্যু ঘটে। তাই আর ঝুঁকি নিইনি। আগ্রহ থাকতে থাকতেই বইটি পড়া শেষ করি।
জানি না আর কতদিন বাঁচবো, কত বই পড়ার সুযোগ পাবো। এটুকু বলতে পারি, আমার পঠিত বইগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ পড়েছি ভ্রমণকালে। সহযাত্রী হিসেবে বই আমাকে কখনো নিরাশ করেনি। আনন্দ দিয়েছে, কষ্ট দিয়েছে, ভাবনার খোরাক জুগিয়েছে—এক কথায় আমাকে সক্রিয় রেখেছে। বই আমার সেরা সহযাত্রী।
মন্তব্য করুন