শৈশব পার করে এসেছি বহুকাল। সবকিছু স্মৃতি ধারণ করতে পারে না। মনে পড়ে কালীবাড়ির মাঠে খেলতে যেতাম, মিঠাপুকুরের পর ভাঙা স্তূপের মধ্যে লুকোচুরি খেলতাম। লোহালিয়া নদীর পাড়েও যেতাম। বিশাল বিশাল পালতোলা মহাজনী নৌকা নদীর বুকে ভেসে যেত। কখনো দেখতাম মাটির হাঁড়িকুড়িভর্তি নৌকা প্রায় পানি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সুন্দরবন থেকে আসত সুন্দরী কাঠবোঝাই বিশাল নৌকা। বাড়িতে মাটির চুলায় রান্না হতো। কাঠের দরকার হলে আব্বা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে এই নৌকাভর্তি কাঠ কিনতেন। বাড়িতে কাঠ তোলা হতো। এরপর আসত কাঠ কাটার লোক। দুজন লোক সারা দিন ধরে কুড়াল দিয়ে কাঠ কাঠত। এও এক শিল্পকর্ম ছিল। কাঠগুলো শুকোবার জন্য মাঝখানে ফাঁকা রেখে চৌকো করে সাজানো হতো। আমরা ওর মধ্যে ঢুকে লুকোচুরি খেলতাম।
স্কুলের অ্যানুয়াল পরীক্ষার পর দাদু বেড়াতে আসতেন। যাওয়ার সময় তিন ভাইবোনকে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে নিয়ে যেতেন। খুব ভোরে এক মাল্লাই নৌকায় যাত্রা শুরু হতো। ছোট নৌকায় বেশি নড়াচড়া করা যেত না। মাঝি সাবধান করত—‘মনু বেশি লড়াচড়া কইর না, নায়ে পানি ওডবে।’ মাঝির হাতের বইঠা পানি কেটে কেটে সামনের দিকে নিয়ে যেত। কখনো নড়েচড়ে উঠলে মাঝি ধমক দিত। দাদু নৌকায় উঠে ঘুমিয়ে পড়তেন। একসময় নৌকা এসে পড়ত বিশাল পায়রা নদীতে। পানি আর পানি। নদীর আরেক পাড়ের ক্ষীণ রেখা দেখা যেত অনেক দূরে। একটু বাতাসে ভীষণ ঢেউ উঠত। নৌকা ভীষণ দুলত।
—ও দাদু, ভয় করছে।
—ঘুমাও আমার পাশে।
ভয়ে ভয়ে শুয়ে পড়তাম। কিন্তু ঘুম আসত না।
—ও দাদু, ঘুম আসছে না।
—এক দুই একশ পর্যন্ত গোনো।
গুনতাম কিন্তু নৌকা একসময় বিস্তীর্ণ নদী পেরিয়ে খালে ঢুকে পড়ত। খালের পাড়ে মেয়েরা কাপড়চোপড় ধুচ্ছে। ছোটরা পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি করছে। গাছেরা মাথা নুইয়ে নিজেদের ছবি দেখছে। আমরা পাতা ছিঁড়তে চেষ্টা করতাম। একসময় খাল শেষ হতো। বিকেলে বদনীখালি এসে পৌঁছতাম। এখানেও সামনে বিশাল এক নদী। নাম তার বিষখালি। ভয়ে বালিশে মুখ লুকাতাম। শুনতাম নদীর কলধ্বনি। ওই সময় ভয় পেলেও পরে নদী আমার কাছে চিরকালের জন্য প্রিয় হয়ে যায়। এখনো গভীর রাতে আমি নদীর আহ্বান শুনতে পাই। সপ্তম শ্রেণিতে উঠলাম। একদিন আম্মা বললেন, শোনো, এখন বড় হয়েছ। আর বাইরে যাবে না। অবাক হয়ে গেলাম। আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। কই আগের মতোই তো আছি। পরদিন আগের মতো খেলতে গেলাম। এক্কাদোক্কা পলাপলি না খেললে হয়! ফিরে এলে আম্মা ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন। থাপ্পড়ের কথা ভুলে গিয়ে পরদিনও খেলতে গেলাম। এবার একটা নয়, অনেক থাপ্পড় খেলাম—‘হতচ্ছাড়া মেয়ে, এত বলি আর বাইরে যাবে না। কথা কানে যায় না, আবার বের হলে ঠ্যাং ভেঙে দেব।’
হৃদয় বিদীর্ণ হলো। বুলু, রেনু, মায়া, রুনুরা ডেকে ডেকে বিফল হয়ে চলে গেল খেলতে। আজ থেকে চিরকালের জন্য বন্ধ হলো খোলা মাঠের ভুবন। ওই কালীবাড়ির মাঠের কোনায় ফুটবে কদম ফুল, শরতে ঝরবে শিউলিরা। শুধু আমি যেতে পারব না। হায় ঈশ্বর, মেয়ে হলাম কেন? সেদিনকার সেই বালিকার কষ্টের কথা মনে হলে আজও বুক ফেটে যায়। সেদিন বিশ্বভুবন ঘন আঁধারে ঢেকে গিয়েছিল। আমি বন্দি হলাম সংকীর্ণ অন্তঃপুরে। স্কুল আর বাসা—এই হলো আমার সীমানা। প্রিয় বন্ধু নাহীদ রোকসানা ছিল আমার দক্ষিণের জানালা। পারিবারিক সম্পর্কের বাইরে নির্মল বন্ধুত্বের আনন্দ তার কাছ থেকে পেলাম। ও বলত, এ বেড়ি আমাদের ভাঙতে হবে। একদিন ওকে না দেখলে মন খারাপ হতো আর প্রিয় সাথী ছিল বই। কেমন করে বই পড়ার আগ্রহ হয়েছিল জানি না। কত করে বই জোগাড় করতাম। কোনো বই স্কুলেই পড়ে শেষ করতে হতো। কোনো বই বাসায় আনতে পারতাম। মনে পড়ে স্কুল লাইব্রেরি থেকে ডেভিড কপারফিল্ড নামে একটা অসাধারণ বই পড়েছিলাম।
সবাই ঘুমিয়ে গেলে হারিকেনের চারদিকে কাগজ মুড়িয়ে গোগ্রাসে গিলতাম বই। প্রবেশ করতাম স্বপ্নময় অলৌকিক জগতে। এরা কারা? এরা কি আমার মতো রক্ত-মাংসের মানুষ। মনে হতো ওই জগৎটাই সত্য।
অনেক কষ্টে পায়ের বেড়ি খসিয়েছিলাম। ভর্তি হয়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু ততদিনে পক্ষিণীর পক্ষচ্ছেদ হয়ে গেছে। উড়তে গেলে মুখ থুবড়ে পড়তে হয়। রোকেয়া হলেও আম্মার কঠোর অনুশাসন মেনে চলেছি। একসময় বিয়ে হলো। সন্তান এলো গর্ভে। মনে মনে বললাম, কন্যা নয়, পুত্র চাই। এ দেশে কন্যার জীবন বড় কষ্টের। পুত্ররা বড় হয়ে গেছে। এখন কন্যার জন্য এক আকুল পিপাসা অনুভব করি। মনে হয় কী এক সাধ অপূর্ণ রয়ে গেল জীবনে। যে মুক্তি আমি পাইনি, সে মুক্তি হয়তো আমার কন্যাকে দিতে পারতাম।
মন্তব্য করুন