ভাষান্তর : মাসুদ রানা
২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৩:১৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সার্ত্র ফরাসি কবিতা সম্পর্কে কিছুই জানেন না

আমেরিকান প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক এবং নাট্যকার জেমস ব্যাল্ডউইন [২ আগস্ট, ১৯২৪-১ ডিসেম্বর, ১৯৮৭] তার আমেরিকার জাতি বিষয়ে বাগ্মিতা এবং আবেগ তাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠে পরিণত করেছিল। প্রথম উপন্যাস গো টেল ইট অন দ্য মাউন্টেন, ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল; কয়েক দশক পর টাইম ম্যাগাজিন ১৯২৩ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত প্রকাশিত ইংরেজি ভাষার ১০০টি সেরা উপন্যাসের তালিকায় উপন্যাসটিকে অন্তর্ভুক্ত করে। নিউইয়র্ক সিটির হারলেমে কালোদের বস্তিতে দারিদ্র্য আর আমেরিকান সাদা-কালো বৈষম্যের মধ্যে বড় হওয়া জেমস ব্যাল্ডউইন একসময় ফ্রান্সে পাড়ি জমান। ১৯৬৯ সালের দিকে দেওয়া জেমস ব্যাল্ডউইনের একটি সাক্ষাৎকারের অংশ এখানে পত্রস্থ হলো।

আপনি কেন ইউনাইটেড স্টেটস ছেড়ে এসেছিলেন?

আমি ভেঙে পড়েছিলাম। আমি পকেটে চল্লিশ ডলার নিয়ে প্যারিসে চলে আসি, কিন্তু আসল কথা আমাকে নিউইয়র্ক ছাড়তে হয়েছিল। আরও বহু মানুষের দুর্দশায় আমি ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম, একসময় বই পড়াই আমাকে দীর্ঘ সময়ের জন্য এসব থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, যদিও তখনো আমাকে রাস্তায়, কর্তৃপক্ষ এবং ঠান্ডার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়েছিল। আমি জানতাম সাদা হওয়ার অর্থ কী এবং আমি জানতাম ‘নিগার’ হওয়ার মানে কী এবং এও জানতাম, আমার সঙ্গে কী ঘটতে চলেছে। আমার ভাগ্য ফুরিয়ে যাচ্ছিল—তখন হয় আমি জেলে যাব, কাউকে খুন করব, না হয় নিজেই খুন হব, এমন এক পরিস্থিতি। দুই বছর আগে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে।

১৯৪৮ সালে যখন প্যারিসে আসি তখন আমি ফরাসি ভাষার একটি শব্দও জানতাম না। আমি কাউকে চিনতাম না এবং তখন কাউকে জানতেও চাই না। পরে যখন আমি অন্যান্য আমেরিকানের মুখোমুখি হতাম, আমি তাদের এড়িয়ে যেতে শুরু করি, কারণ তাদের কাছে আমার চেয়ে বেশি অর্থ ছিল এবং আমি কারও দয়া-দাক্ষিণ্য চাইনি। আমি যে চল্লিশ ডলার নিয়ে এসেছি তা আমার মনে আছে, দুই বা তিন দিন স্থায়ী হয়েছিল। প্রায়ই শেষমুহূর্তে এক হোটেল থেকে অন্য হোটেলে চলে যেতাম। একসময় অসুস্থ হয়ে পড়ি। আশ্চর্যের বিষয় আমাকে হোটেল থেকে বের করে দেওয়া হয়নি। আমি কখনোই বুঝিনি কেন সেই কর্সিকান পরিবার আমার যত্ন নিয়েছে। একজন অতি বৃদ্ধ মহিলা তিন মাস ধরে পুরোনো লোকচিকিৎসা আর সেবা করে আমাকে সুস্থ করে তুলেছিলেন। আমি বেঁচে আছি কি না, দেখতে তাকে প্রতিদিন সকালে পাঁচটি সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে হতো। আমি এই সময়ের মধ্য দিয়ে গেছি, যেখানে আমি ছিলাম একা এবং আমি তাই হতে চাইতাম। নিউইয়র্কে একজন অ্যাংরি ইয়ংম্যান হওয়ার আগপর্যন্ত আমি কোনো সম্প্রদায়ের অংশ ছিলাম না।

ফ্রান্সকেই কেন বেছে নিলেন?

এটি ফ্রান্সকে বেছে নেওয়ার ব্যাপার ছিল না, এটি মূলত ছিল আমেরিকা থেকে বেরিয়ে আসার ব্যাপার। আমি জানতাম না ফ্রান্সে আমার সঙ্গে কী ঘটতে যাচ্ছে কিন্তু জানতাম নিউইয়র্কে আমার সঙ্গে কী ঘটবে। আমি যদি সেখানে থাকতাম, আমি জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজ থেকে আমার বন্ধুর মতোই নিচে চলে যেতাম।

যতদূর জানি আপনাকে প্রভাবিত করার মতো বহুল পঠিত এমন কোনো কালো আমেরিকান লেখক ছিলেন না। আপনার লেখার ফর্ম বা বিষয়বস্তুতে এমন কোনো প্রভাবের চিহ্ন রয়েছে?

না। যখন আমি জানতে পারলাম যে কালো লেখক আছে, আমি এরই মধ্যে গঠিত হয়ে গেছি। এমন কোনো লেখক নেই যাকে আমি বড় হওয়ার সময় জানতাম। আমি ল্যাংস্টন হিউজকে অনেক পরে চিনেছি যখন আমি নিজেও একজন পরিচিত লেখক এবং তারপর রিচার্ড রাইট—তিনি আমার জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন, তবে লেখক হিসেবে নয়। তিনি আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন কারণ তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, একজন কালো মানুষও লেখক হতে পারে। কারণ আমি লেখক হব, এটা হার্লেমে তখনো একটা হাস্যকর ব্যাপার ছিল। কেউ আমাকে বিশ্বাস করেনি, না বাবা, না মা। রিচার্ড রাইট এ কারণে আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু একজন লেখক হিসেবে নয়। একমাত্র কালো লেখক যিনি আমাকে সত্যিই প্রভাবিত করেছেন, যাকে আমি অনেক পরে পড়েছি এবং যার ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা ছিল এবং যার স্বতঃস্ফূর্ত শৈলী ছিল। তার নাম ডব্লিউ ই বি ডু বোইস। তিনি তেমন কোনো ভালো ঔপন্যাসিক ছিলেন না, কিন্তু তার প্রকৃত মেধা ছিল, অনুসন্ধানী বুদ্ধিমত্তা ছিল। এর জন্য তার দেশ তাকে নির্বাসিত করেছে এবং আফ্রিকায় তার মৃত্যু হয়। আমেরিকানরা বলবে যে, তিনি নিজেই নিজেকে নির্বাসিত করেছিলেন, কিন্তু তা নয়। আমি এটা জোরে এবং পরিষ্কার বলতে চাই, তিনি তার নিজের দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন এবং ওয়াশিংটন মার্চের ঠিক এক দিন আগে ৯৪ বছর বয়সে মারা যান। এর বাইরে আমার প্রজন্মের কেউ কোনো কালো লেখককে চিনত না। উদাহরণস্বরূপ, আমি জানতাম না যে আলেকজান্ডার পুশকিন একজন নিগ্রো লেখক ছিলেন, কারণ আমেরিকান স্কুলগুলোতে নিগ্রো শিশুদের তা শেখানো হতো না এবং যে কারণে তাদের শেখানো হয় না তা হলো, আপনি যদি নিজেকে সেভাবে জানতে শুরু করেন তবে তারা আপনাকে আর শোষণ করতে পারবে না।

আমরা যদি শিকড়গত দৃষ্টিকোণ থেকে সাধারণভাবে কালো আফ্রিকান সাহিত্যের পাশাপাশি কালো-আমেরিকান সাহিত্য পড়ি—আপনি কি মনে করেন যে ফর্ম এবং/অথবা বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে এ দুটির মধ্যে সম্পর্ক আছে?

কঠিন প্রশ্ন। কারণ প্রথমত আফ্রিকান এবং আফ্রো-আমেরিকান কবি উভয়ই এমন এক ঐতিহ্যের, যা পশ্চিমে আর বিদ্যমান নেই। যেমন একজন লেখক হিসেবে আমি লিখিত ঐতিহ্য থেকে আসি না। আমি এসেছি একটি মৌখিক, কথ্য সাহিত্য থেকে। আফ্রিকায় আমরা ব্লুজ লিখিনি, কথা বলেছি। পশ্চিমা দেশগুলোকে একটি সম্ভাবনা এবং সুযোগ হিসেবে কথা বলার কথা মনে রাখা উচিত। বাবা থেকে ছেলের কাছে সবকিছু এভাবেই গেছে। এভাবে গোত্র এবং রাষ্ট্র উভয়ই অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। একই কারণে আমেরিকান নিগ্রোদের পক্ষেও বেঁচে থাকা সম্ভব হয়েছিল।

তাহলে তো আমরা মৌখিক সাহিত্যের ঐতিহ্যের কাছে ঋণী—

হ্যাঁ, আমেরিকায় আমাদের এমনভাবে কথা বলতে হয়েছে যেটা একজন শ্বেতাঙ্গ হিসেবে আপনি বুঝতে পারবেন না। রে চার্লস এখনো এমনভাবে কথা বলেন, যা শ্বেতাঙ্গরা বুঝতে পারে না। দাস প্রহরীর সজাগদৃষ্টির সামনে তিন মিনিটের মধ্যে আমাকে আমার ভাইকে সতর্ক করতে হয়েছে; আমার ভাইকে আমাকে জানাতে হয়েছিল যে, সে কোথাও যাচ্ছে এবং আমাকে সে সতর্ক করেছে এভাবে যে, ‘যিশুর কাছ থেকে চুরি করো।’ এটি এখনো একটি ব্যক্তিগত ভাষা। দুটি কারণে ব্যক্তিগত—কারণ আমরা এখনোও একই অবস্থায় আছি, দেশটি আমাদের নয় এবং আমাদের ক্ষমতা নেই। গ্রিনউইচ সময় একটি ইংরেজি আবিষ্কারের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে কিন্তু আরেকটি সময় আছে ‘নিগ্রো টাইম’ নামে; আরেকটি জীবন আছে যা লন্ডনে নেই।

আফ্রিকান এবং আফ্রো-আমেরিকান সাহিত্য সম্পর্কে আমার আরও একটি প্রশ্ন আছে। [জাঁ-পল] সার্ত্র বলেছেন যে, আফ্রিকান কবিতা বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বিপ্লবী কবিতা। আপনি কি মনে করেন এটি আফ্রো-আমেরিকান কবিতার জন্যও সত্য?

বিপ্লব আর কবির মধ্যে কিছুটা দূরত্ব আছে। আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছি যে, সার্ত্র, যিনি একজন সম্মানিত ব্যক্তি, তিনি কোনো ধরনের বিপ্লবের অথরিটি নন। হতেও পারেন না। আমার দৃষ্টিতে, প্রকৃতপক্ষে, সার্ত্র ফরাসি কবিতা সম্পর্কে কিছুই জানেন না; কালো কবিতা সম্পর্কে তার জ্ঞান আরও কম। নিগ্রোরা শ্বেতাঙ্গ মানুষের মনে প্রাথমিকভাবে আশা এবং প্রতীক হিসেবে বিদ্যমান, এসব কালো-সাদা বিচ্ছিন্নতা ও কালো-সাদা সংঘর্ষের ফলে শ্বেতাঙ্গের শক্তিশালী হয়ে ওঠা এবং যে পদ্ধতিতে তিনি শক্তি অর্জন করেছিলেন, তা প্রতিটি শ্বেতাঙ্গের মনে একটি ভয়ংকর অনুভূতি রেখে গেছে। জাঁ পল সার্ত্র হওয়া ও প্যারিসে বসবাস করা এবং রিচার্ড রাইটের বন্ধু হওয়া ও আপনার নিচে থাকা লোকদের সম্পর্কে চিরন্তন চিন্তাভাবনা করা এক জিনিস এবং মার্টিন লুথার কিং বা ম্যালকম এক্স হওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।

আপনি আমেরিকায় কালো আন্দোলনের কথা কিছুটা পরোক্ষভাবে বলেছেন। আমরা কি এখন সরাসরি এটি সম্পর্কে কথা বলতে পারি?

কোনো লেখক এমন কিছু নিয়ে সরাসরি কথা বলেন না। আইজেনহাওয়ার সরাসরি কথা বলেছেন, নিক্সন সরাসরি কথা বলেছেন, হিটলার সরাসরি বলেছেন। কোনো শিল্পী কোনো সময়ই এ ধরনের বিষয়ে সরাসরি কথা বলেন না। এটা না হলে সারা পৃথিবীতে কেউ একজন শিল্পীর কথা শুনতে পেত না। বিষয় হলো মানুষ, আপনি, আমি, আমরা সবাই যে বিপর্যয়গুলোকে ঘৃণা করি এবং অভিযোগ করি—আমরা কীভাবে এবং কী পদ্ধতিতে তার জন্য দায়ী।

ঠিক আছে। কিন্তু তবুও আমি আপনাকে যুক্তরাষ্ট্রের কালো আন্দোলন সম্পর্কে কিছু বলতে বলব—

যুক্তরাষ্ট্রে কোনো কালো আন্দোলন হয়নি, সেখানে সাদা আন্দোলন হয়েছে।

বিষয়টি আবার বলবেন কি?

আমি জানি যুক্তরাষ্ট্রে কোনো কালো আন্দোলন হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রে একটি শ্বেতাঙ্গ আন্দোলন এবং এর বিরুদ্ধে একটি কালো প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এটি আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে, আমি আসলে কী বলতে চাই... যদি আমরা সাদা ও কালো শব্দগুলোর পরিবর্তে উদাহরণস্বরূপ খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের কথা বলি বা জার্মান ও ইহুদি বা চেক ও রাশিয়ান। চেক আন্দোলন হিসেবে যা ঘটেছে তা আপনি বর্ণনা করতে পারবেন না, আপনি পারেন? যা ঘটেছে তা রাশিয়ান নিপীড়নের চেক প্রতিক্রিয়া, তাই নয় কি?

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কমবে ঢাকার তাপমাত্রা, হতে পারে বৃষ্টি

শরিকদের আশার বাণী শোনালেন তথ্যমন্ত্রী

যশোরে এসিল্যান্ড পরিচয়ে মোবাইলে প্রতারণা

মেসির মায়ামিতেই অনুষ্ঠিত হবে কোপার ফাইনাল

জবির নতুন কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. হুমায়ুন কবীর

ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের টানেল ধ্বংসে ইসরায়েলের ভয়ংকর কৌশল!

বিদেশিদের চাপ একেবারেই নেই : ইসি আলমগীর

না ফেরার দেশে ‘সিআইডি’র ফ্রেডি

সরকার আশ্বাস দিয়েছে বলেই নির্বাচনে এসেছি : জাপা মহাসচিব

এবার দক্ষিণ গাজা খালি করতে চায় ইসরায়েল

১০

আসন ভাগাভাগির সিদ্ধান্ত কবে, জানালেন কাদের

১১

নির্বাচনে অবৈধ অস্ত্রের চোরাচালান ঠেকাতে সীমান্তে সতর্ক অবস্থানে বিজিবি

১২

শুরু হলো এপিকটা অ্যাওয়ার্ড-২০২৩

১৩

৬ ডিসেম্বর: লালমনিরহাট হানাদারমুক্ত দিবস আজ

১৪

বিতর্কিত জলসীমায় চীনের ১৩৫ জাহাজ!

১৫

ছাত্রদল নেতাকে না পেয়ে ক্রীড়াবিদ ছোট ভাইকে গ্রেপ্তার

১৬

জানা গেল হিরো আলমের বার্ষিক আয় ও সম্পদ বিবরণী

১৭

চাঁদপুরে মনোনয়নপত্র বাতিলের বিরুদ্ধে লড়বে ১১ প্রার্থী

১৮

জাতীয় অধ্যাপক ডা. আব্দুল মালিক আর নেই

১৯

প্রতারণায় মামলায় গায়ক নোবেলের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন ৩০ জানুয়ারি

২০
X