ডিজিটাল কানেকটিভিটি শক্তিশালীকরণে সুইচিং ও ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন প্রকল্পের (এসটিএনপি) ডিডব্লিউডিএম যন্ত্রপাতি ক্রয়ের দরপত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. রফিকুল মতিন ও টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল ইসলামসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ তুলে ধরে অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। তিনি কমিশনের অনুমোদন পেলেই অভিযুক্তদের আসামি করে মামলা করবেন।
দুদকের তথ্যমতে, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তর ও বিটিসিএলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এসটিএনপি প্রকল্পের শত শত কোটি টাকা আত্মসাতের একটি অভিযোগ ২০২১ সালের ১ মার্চ জমা পড়ে দুদকে। অভিযোগে যাদের নাম এসেছে, তারা হলেন বিটিসিএল পরিচালনা পর্ষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান নুর-উর-রহমান, টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মহসিনুল আলম, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের যুগ্ম প্রধান মো. মোছলেহ উদ্দিন ও বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. রফিকুল মতিন। কমিশন অভিযোগ অনুসন্ধানে সংস্থাটির উপপরিচালক নারগিস সুলতানাকে দায়িত্ব দেন। তিনি অনুসন্ধান শেষ করে সম্প্রতি পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশসহ কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করেন।
দুদকের অনুসন্ধান সূত্রে জানা গেছে, যাদের আসামি করার সুপারিশ করা হয়েছে, তারা হলেন টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম, বিটিসিএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. রফিকুল মতিন, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ও বর্তমানে টেলিটক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম হাবিবুর রহমান, বিটিসিএলের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (অর্থ) খন্দকার যুবায়ের হাসান এবং ডাক ও টেলিযোগ বিভাগের (ডাক-২) এবিএম বদিউজ্জামান।
অনুসন্ধান প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, দেশের ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক কল আদান-প্রদান এবং দ্রুতগতির ইন্টারনেট চাহিদা পূরণে সরকারি অর্থায়নে বিটিসিএলের মাধ্যমে ডিজিটাল কানেকটিভিটি শক্তিশালীকরণে সুইচিং ও ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন প্রকল্প (এসটিএনপি) গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পটি ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি একনেকে অনুমোদন পায়। একই বছরের ১০ জুন প্রকল্পের ডিডব্লিউডিএম যন্ত্রপাতি ক্রয়ের দরপত্র দলিল ও দাপ্তরিক প্রাক্কলিত ব্যয় প্রস্তুতের জন্য কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির তৈরি সিলগালা খামে প্রাক্কলন পেয়ে ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজে অনুমোদন করে তা সিলগালা করে রাখেন এবং ১২ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাঁচটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। পরে সাত সদস্যের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সর্বসম্মতিক্রমে এক্স-ফারকে একমাত্র গ্রহণযোগ্য ও সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে ঘোষণা করে এবং দাখিল-উত্তর যাচাই সম্পন্ন করে। সুপারিশসহ প্রতিবেদনে বুয়েট ও সেনাবাহিনীর বহিঃসদস্যসহ কমিটির সদস্য সচিব প্রকল্প পরিচালক স্বাক্ষর করেন। কিন্তু কমিটিতে থাকা বিটিসিএলসহ সরকারি কর্মকর্তারা মূল্যায়ন প্রতিবেদনের বেশ কয়েকটি পৃষ্ঠা নম্বর হাতে কেটে অতিরিক্ত দুই পাতা সংযোজন করে পুনঃদরপত্রের ভিন্নমত দেন। কাটছাঁটের বিষয়টি গোপন করতে বোর্ডসভায় মূল্যায়ন প্রতিবেদন ছাড়া শুধু কার্যপত্র উপস্থাপন করা হয়। সভায় পরিচালনা পর্ষদের সব বহিঃসদস্যরা দরপত্র বাতিলের বিপক্ষে ও বিটিসিএলসহ সরকারি কর্মকর্তারা বাতিলের পক্ষে মত দেন। বোর্ডসভায় দরপত্র বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর দরপত্র বাতিলের বিরুদ্ধে রিভিউ প্যানেলে আবেদন করে একমাত্র যোগ্য প্রতিষ্ঠানটি। অন্যদিকে রিভিউ নিষ্পত্তির আগেই একই বছরের নভেম্বরে পুনঃদরপত্র আহ্বান করে বিটিসিএল। পরবর্তী সময়ে আরও দুইবার দরপত্র আহ্বান করে অনির্দিষ্টকালের জন্য দরপত্র স্থগিত করে বিটিসিএল কর্তৃপক্ষ।
অনুসন্ধান প্রতিবেদন সূত্রে আরও জানা গেছে, দরপত্র বাতিল আইনসংগত নয় বলে বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদে উপস্থিত দুজন স্বাধীন সদস্যের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে অন্য স্বাধীন সদস্য বুয়েটের উপাচার্য দরপত্র বাতিলের বিপক্ষে মত প্রদান করেছিলেন। অথচ সম্পূর্ণ বিপরীতে তাকে দরপত্র বাতিলের পক্ষে দেখিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে পরিচালনা পর্ষদের কার্যবিবরণী তৈরি করা হয়। বেআইনি দরপত্র বাতিলে সরকারের গৃহীত প্রকল্পের সুফল প্রাপ্তি থেকে জনগণ বঞ্চিত হয়েছে এবং সরকার ১০৭ কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে।
এর আগে টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট ও দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবলের ল্যান্ডিং স্টেশন থেকে বিভিন্ন জেলার মধ্যে ২০১৬ সালে স্বয়ংক্রিয় ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক স্থাপনের প্রকল্পেও বিটিসিএল কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।
মন্তব্য করুন