বিদেশ থেকে জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) নামে বাংলাদেশে আসা সব ধরনের পণ্যের খালাস বন্ধ করতে চায় শুল্ক বিভাগ। বিনা শুল্কে আমদানি করা গাড়ির ব্যবহার নিয়ে জটিলতা তৈরি হওয়ায় এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক সংস্থাটির কার্যক্রম শনাক্তকরণ নম্বর (বিআইএন) আটকে রেখে (লক) সমুদ্র, স্থল, বিমানবন্দরসহ দেশের সব কাস্টম স্টেশনে পণ্য খালাস ও সেবা স্থগিত রাখার অনুরোধ জানানো হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিটি কার্যকর হলে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খাদ্য সরবরাহসহ বাংলাদেশে ইউএনএইচসিআরের সার্বিক কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তা কার্যক্রমে ব্যবহারের জন্য ২০১৮ সালে বিদেশ থেকে মোট ৪৬টি গাড়ি আমদানি করে ইউএনএইচসিআর। ওই বছরের ৪ জুন ১৮টি নতুন টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো, ৫টি হায়েস ও ১৫টি পিকআপ; ১১ জুলাই ৫টি ল্যান্ড ক্রুজার অ্যাম্বুলেন্স ও একটি ল্যান্ড ক্রুজার হার্ডটপ ডিজেল এবং ২৬ আগস্ট তিনটি ট্রাক আনা হয়।
শুল্ক কর্তৃপক্ষ বলছে, ইউএনএইচসিআর নিজস্ব অফিসিয়াল কাজে ব্যবহারের ঘোষণা দিয়ে গাড়িগুলো আমদানি করেছে। এর পরপ্রেক্ষিতে এনবিআরের ১৯৭৫ সালের একটি আদেশ অনুযায়ী সংস্থাটিকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়। এনবিআরের ২০০০ সালে জারি করা কূটনৈতিক মিশন বা অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত সংস্থার শুল্ক ও কর ছাড় সুবিধা সংস্থার আদেশ অনুযায়ী শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা গাড়ি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে এনবিআরের অনুমতি নিতে হয়।
শুল্ক কর্তৃপক্ষ বলছে, শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানি করলেও ইউএনএইচসিআর তা নিজস্ব কাজে ব্যবহার করছে না। সংস্থাটির সঙ্গে ‘গ্রহণ ও ব্যবহারের অধিকার সংক্রান্ত চুক্তি’ করে বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়সহ বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান গাড়িগুলো ব্যবহার করছে—যা শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানি সম্পর্কিত এনবিআরের প্রজ্ঞাপনের লঙ্ঘন।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের বিজ্ঞপ্তি সূত্রে জানা গেছে, ইউএনএইচসিআরের জন্য আমদানি হলেও বিনা অনুমতিতে অন্য প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করছে, এমন তথ্য জানতে পেরে গাড়িগুলোর শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিল করে গত বছরের ২২ ডিসেম্বর একটি বিচারাদেশ জারি করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। এতে ইউএনএইচসিআরকে জরিমানাসহ ৪৬টি গাড়ির আমদানি শুল্ক বাবদ ৭৬ কোটি ২ লাখ ৮৮ হাজার টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়। পরবর্তী সময়ে এই শুল্ক আদায়ে দাবিনামা ও তাগিদপত্র দেওয়া হয়। জাতিসংঘের আওতাধীন এ সংস্থাটি এই দুটি পত্রের জবাব দিলেও তা কাস্টম হাউসের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। এ কারণে তারা গত ২৩ মে চূড়ান্ত তাগিদপত্র জারি করে। তবে এখন পর্যন্ত ইউএনএইচসিআর দাবিনামার টাকা পরিশোধ করেনি। তাই শুল্ক আদায়ে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে শুল্ক কর্তৃপক্ষ।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার ফাইজুর রহমান কালবেলাকে বলেন, শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানির শর্ত ভঙ্গ করেছে ইউএনএইচসিআর। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অনুমোদন না নিয়ে অন্য সংস্থাকে গাড়ি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি, যা কাস্টম আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বিচারিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ইউএনএইচসিআর কর্তৃপক্ষকে শুনানিতে ডাকা হয়েছে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কেউ শুনানিতে উপস্থিত হয়নি। তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আপিলও করেনি। এ অবস্থায় আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরকারের পাওনা অর্থ আদায়ের সর্বশেষ প্রক্রিয়া হিসেবে দাবিকৃত টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত দেশের সব শুল্ক স্টেশনে সংস্থাটির নামে পণ্য খালাস ও সেবা বন্ধ রাখতে চিঠি ইস্যু করা হয়েছে।’
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘কাস্টমস আইন ১৯৬৯-এর ২০২-এর (১) (বি) ধারা এবং মূল্য সংযোজন কর আইন ১১৯১-এর ৫৬ ধারার (১ক) উপধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আলোচ্য পণ্য চালানের বিপরীতে অনাদায়ী ৭৬ কোটি ২ লাখ ৮৮ হাজার ৩০ টাকা সরকারি কোষাগারে পরিশোধ না হওয়া ইউএনএইচসিআরের বাংলাদেশ প্রতিনিধির বিআইএন লক করাসহ এই প্রতিষ্ঠান বা সহযোগী কোনো প্রতিষ্ঠান বা একই মালিকানাধীন কোনো প্রতিষ্ঠানের পণ্য দেশের কোনো স্থলবন্দর, সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর বা শুল্ক বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন যে কোনো খালাস বন্ধ রাখা এবং পণ্য বা সেবা সরবরাহ স্থগিত রাখার অনুরোধ করা হলো।’
এদিকে ইউএনএইচসিআরের পণ্য আমদানি বন্ধের এ উদ্যোগ কার্যকর হলে কক্সবাজারে অবস্থানরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীসহ বাংলাদেশে চলমান শরণার্থী সম্পর্কিত কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য ও অন্যান্য পণ্য সরবরাহে সংকট তৈরি হতে হবে। এ ধরনের পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে হবে। এ কারণে গাড়ির শুল্ক সংক্রান্ত জটিলতা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
শরণার্থীদের খাদ্যসহ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য খালাসের বিষয়ে জানতে চাওয়া চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার ফাইজুর রহমান বলেন, ‘বিচারাদেশ অনুযায়ী সরকারি অর্থ আদায়ে পণ্য খালাস বন্ধ রাখার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি শুল্ক বিভাগের দাবি পরিশোধ করলে তাদের আমদানি কার্যক্রমে কোনো বাধা থাকবে না।’
এদিকে বিদেশ থেকে গাড়ি এনে বাংলাদেশ সরকারের একটি মন্ত্রণালয়কে ব্যবহার করতে দেওয়ার পরও ইউএনএইচসিআরের বিরুদ্ধে এ ধরনের পদক্ষেপ কতটা যৌক্তিক সে বিষয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।
জানতে চাওয়া হলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব মো. কামরুল হাসান কালবেলাকে বলেন, ‘এ মুহূর্তে বিষয়টি সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য ইউএনএইচসিআর, ঢাকা কার্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক ই-মেইলে যোগাযোগ করা হয়। সংস্থার পক্ষ থেকে দেওয়া লিখিত জবাবে বলা হয়, ‘ইউএনএইচসিআর জাতিসংঘের নিয়মনীতি মেনে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে। জাতিসংঘের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিটি দেশই ইউএনএইচসিআরের পণ্য আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে থাকে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।’
বিদেশ থেকে আনা গাড়ির ব্যবহার ও এ বিষয়ে শুল্ক বিভাগের দাবির বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে বলেও ইউএনএইচসিআরের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
মন্তব্য করুন