বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত। অবর্ণনীয় দুর্ভোগের সাক্ষী হয়েছে রাজধানীবাসী। বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত, দমকা হাওয়া। মুহূর্তেই যেন নরকে পরিণত হয় পুরো শহর। ডুবে যায় অলিগলি, মূল সড়ক। রাজধানীর কোথাও কোথাও সড়কে ভেঙে পড়ে গাছ। যানজট ছিল গভীর রাত পর্যন্ত। যারা রাত ১০টায় বাসায় পৌঁছতেন, দুর্ভোগের রাতে তারা বাসায় ফিরেছেন দেড়টা-২টায়। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে বৃহস্পতিবার রাত ১২টা পর্যন্ত ৬ ঘণ্টায় ১১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়।
বৃষ্টির মধ্যেই এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে মিরপুরে। ঝিলপাড় বস্তির বিপরীত দিকে জলাবদ্ধ সড়কে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ে। বিদ্যুৎস্পর্শে একই পরিবারের তিনজন মারা যান। ওই পরিবারের ৭ মাস বয়সী শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ যায় এক তরুণের।
এ রাতে কার্যত পুরো রাজধানী অচল হয়ে পড়ে বৃষ্টি, জলাবদ্ধতা আর যানজটে। অবর্ণনীয় ভোগান্তিতে পড়তে হয় কর্মস্থল থেকে ঘরমুখী মানুষকে। টানা সাড়ে ৬ ঘণ্টার ভারি বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি জমে বিকল হয়ে যায় অনেক যানবাহন। দেড়-দুই-তিন ঘণ্টা করে আটকে থাকতে হয়েছে অফিস, দোকানপাট, বাজারঘাটে। যতক্ষণে বৃষ্টির হাত থেকে নিস্তার পেয়েছেন, ততক্ষণে তলিয়ে গেছে ঢাকার রাস্তাঘাট। কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও তা কোমর ছুঁইছুঁই। ঢাকার রাজপথ যেন হয়ে ওঠে ‘রাজ নৌপথ’। তাতে গাড়িতে চড়েও মিলেছে নৌপথে ভ্রমণের অনুভূতি।
মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, কলাবাগান, নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, কাঁটাবন, হাতিরপুল, কাঁঠালবাগান, ফার্মগেট, তেজগাঁও, আজিমপুর, পলাশী, কামরাঙ্গীরচর, বাড্ডা, কুড়িল, গুলশান-১, গুলশান-২, শ্যামলীসহ রাজধানীর অনেক এলাকার রাস্তা তলিয়ে যায়। জলাবদ্ধতায় সড়কগুলোতে সব গাড়ি আটকে যায়। প্রাইভেটকারের জানালা পর্যন্ত ওঠে পানি।
প্রতিবছরই ঝড়-জলের মৌসুমে রাজধানীবাসীর পানিতে আবদ্ধ হওয়ার অভিজ্ঞতা ঋদ্ধ হতে থাকলেও মুক্তির পথ দেখাতে পারে না দুই সিটি করপোরেশন। এ বছরও ভারি বৃষ্টি হলেই কিছু সময়ের জন্য হলেও ডুবে গেছে ঢাকা। বৃহস্পতিবার রাতে আরেকবার হলো সে অভিজ্ঞতা। যে যেখানে আটকা পড়েছিলেন, বৃষ্টির অবিরাম ও ক্লান্তিহীন রূপ দেখে একসময় ভিজেই বেরিয়ে গেছেন বাসার পথে।
ফার্মগেটে রাত পৌনে ১২টার সময় দীর্ঘ যানজট দেখা যায়। যানবাহনের জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন মোহাম্মদ মোশারফ। রাত ১০টায় বের হলেও কোনো যানবাহন পাচ্ছিলেন না। বলেন, খিলক্ষেতের বাসায় কীভাবে পৌঁছব, বুঝতে পারছি না। বেসরকারি চাকরজীবী মানিক জানালেন, মতিঝিল থেকে রওনা দিয়েছি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে। চারদিকে পানি আর পানি। ফার্মগেট আসতে ১১টা বেজে যায়। গাড়ি বন্ধ হয়ে গেল। সেখান থেকে নেমে হাঁটা শুরু করি। মিরপুর পৌঁছতে পৌঁছতে রাত সোয়া ১টা বেজে গেছে।
কোচিং শেষে রাত ৮টার দিকে ফার্মগেট থেকে কাঁঠালবাগান এলাকার বাসায় ফিরছিলেন কলেজছাত্র জুয়েল। কিন্তু মুষলধারায় বৃষ্টির কারণে রাত ১২টায়ও বাসায় ফেরা সম্ভব হয়নি তার। তিনি বলেন, এত বৃষ্টি আর এমন জলাবদ্ধতা এ এলাকায় জীবনেও দেখিনি! ঝুঁকি নিয়ে বাসায় যেতে চাচ্ছি না। দুর্ঘটনার আশঙ্কা আছে। তাই ৩-৪ ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছি।
পান্থপথের এক দোকানি বলেন, দোকানে পানি উঠে গেছে। বাসায় ফেরার গাড়ি পাচ্ছিলাম না। জলাবদ্ধতার কারণে অল্প দূরেই সেন্ট্রাল রোড পর্যন্ত যেতে রিকশা ভাড়া চাইল আড়াইশ টাকা। উপায় নেই। হেঁটে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছিল না। বাধ্য হয়ে নিতে হলো। পান্থপথ সিগন্যালের আশপাশের রেস্টুরেন্ট, মুদি দোকানের ভেতরেও পানি ঢুকেছে।
সোহেল ইয়ামিন নামে এক ব্যক্তি জানান, নিউমার্কেট থেকে কয়েক ঘণ্টায় কামরাঙ্গীরচর এসে দেখলাম সব গলি পানিতে একাকার। চেনাই মুশকিল। এর আগে তিনি নিউমার্কেটে প্রায় আড়াই ঘণ্টা আটকে ছিলেন।
রাত ১২টার দিকে গুলশান-১ ও ২ এলাকার অনেক বাসিন্দা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেন সাহায্য চেয়ে। তাতে লিখেছেন, এখনো অনেকেই আটকে আছেন। গাড়ি পাচ্ছেন না। রাইড শেয়ারও মিলছে না। মোবাইলে চার্জ নেই। দু-একটা গাড়ি ফাঁকা পেলেও তিন থেকে চারগুণ ভাড়া চাচ্ছে।
এলিফ্যান্ট রোড এলাকার সড়কের আইল্যান্ড পর্যন্ত ডুবে যায় রাতে। বন্ধ হয়ে যায় গাড়ি চলাচল। এক সংবাদকর্মী জানান, রাত সাড়ে ১০টায় সেগুনবাগিচা থেকে রওনা দিয়ে শ্যামলী পৌঁছলাম রাত ২টা ৪৫ মিনিটে। রূপনগরের বাসিন্দা নাজমুস জানান, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে বাসায় ফেরার চেষ্টা করি। অল্প একটু যেতেই পানি ঢুকে ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। তিন থেকে চারগুণের বেশি চাওয়া হয়েছে রিকশা ভাড়া। তার মতো এমন অভিযোগ অনেকেরই।
কাওরান বাজারের এক ব্যবসায়ী জানান, সন্ধ্যা থেকে দাঁড়িয়ে ছিলাম। শেষে বাধ্য হয়ে ভিজে বাসে উঠলাম। কিন্তু বাস আর চলছিল না। মিরপুর-২-এ পৌঁছলাম রাত সাড়ে ১২টারও পর। তখনো চারদিকে অথৈ পানি।
রাস্তায় জলাবদ্ধতায় অনেক যানবাহন বিকল হয়ে পড়ায় সেগুলোকে টেনে নিতে দেখা গেছে ধানমন্ডি এলাকায়। বেশ কিছু এলাকায় রাস্তায় গাছের ডাল ভেঙে পড়ার খবরও পাওয়া গেছে। রাত ৯টার দিকে ধানমন্ডি ১৪ নম্বরের এক বাড়ির সামনে কড়ইগাছ ভেঙে পড়ে। রাস্তায় তীব্র যানজট লেগে যায়। রাতে ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়, বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ছে, আবার আগুন লেগেছে—এমন খবর দিয়ে সাহায্য চাওয়া হয়।
বিভিন্ন এলাকায় বাসা-বাড়িতে পানি ঢুকে যায়। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা কবির হোসেন জানান, ভারি বৃষ্টিতে পানি ঘরের মধ্যে ঢুকেছে। আসবাব ভিজে গেছে। ঘরের মেঝেতে খাট পর্যন্ত পানি। ম্যানহোলের আবর্জনাও মিশেছে সে পানিতে।
সম্পাদনা: রাসেল
মন্তব্য করুন