আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত ছিল, বিভিন্ন সময়ে নানা উদ্যোগও নেওয়া ছিল; কিন্তু কোনো কিছুতেই কমানো যায়নি খেলাপি ঋণ। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হলেও চলতি বছরের শুরু থেকেই তা বাড়তে থাকে। সবশেষ গত জুন শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। দেশের ইতিহাসে খেলাপি ঋণের এই হার সর্বোচ্চ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
গত বছরের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ছয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৫ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। আর আগের প্রান্তিক মার্চের তুলনায় অর্থাৎ তিন মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে বরং তাদের পুরস্কৃত করা হয়। সে সুযোগে সস্তায় ঋণ নিয়ে কেউ পাচার করেন। আবার কেউ খাটান পুঁজিবাজারে। কেউ এক খাতে ঋণ নিয়ে অন্য খাতে ব্যবহার করেন। ফলে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, আমাদের দেশে ঋণখেলাপিদের তিরস্কারের পরিবর্তে পুরস্কার দেওয়া হয়। ঋণখেলাপিদের একের পর এক ছাড় বা সুবিধা দিলে তারা টাকা ফেরত দেবে না। আরও সুবিধার অপেক্ষায় থাকবে। এটা খুব স্বাভাবিক নিয়ম। কারণ তারা জানে, টাকা ফেরত না দিলেও চলবে। ঋণ পরিশোধ না করলেও খেলাপিদের কোনো ধরনের শাস্তি বা জরিমানা কিছুই গুনতে হয় না। ফলে সাময়িকভাবে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমলেও এখন তা আরও বেড়ে গেছে, যা ব্যাংক খাতের জন্য অশনি সংকেত।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, শুধু টাকার অঙ্কে নয়, খেলাপি বেড়েছে শতকরা হিসাবেও। জুনে বিতরণকৃত ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে, যা গত ডিসেম্বরে ছিল ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। এ সময় ব্যাংক খাতে মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। যা গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা।
আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম শর্ত হচ্ছে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমানো। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা। অথচ এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এই ঋণের প্রথম কিস্তি হিসাবে ৪৭৬ দশমিক ১৭ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে আগামী ৫ অক্টোবর আইএমএফের স্টাফ মিশন আসবে। দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের আগেই খেলাপি ঋণ কমানোসহ বেশকিছু শর্ত পূরণ করার কথা ছিল: যার মধ্যে খেলাপি ঋণ কমানো অন্যতম।
এদিকে, খেলাপি ঋণ কম দেখানোর উপায় হিসেবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন ছাড় দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশেষ করে করোনার প্রভাব শুরুর পর ২০২০ সালে কেউ কোনো টাকা না দিলেও তাকে খেলাপি করা হয়নি। ২০২১ সালে একজন উদ্যোক্তার যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করার কথা, কেউ ১৫ শতাংশ দিলে তাকে আর খেলাপি করা হয়নি। এর আগে ২০১৯ সালে বিশেষ ব্যবস্থায় মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য বিপুল পরিমাণের ঋণ পুনঃতফশিল করা হয়। এরও আগে ৫০০ কোটি টাকার বড় অঙ্কের ঋণ পুনর্গঠন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিশেষ বিবেচনায় পুনঃতফশিলসহ বিভিন্ন শিথিলতা দেওয়া হয়। বারবার এ ধরনের শিথিলতার কারণে উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ ঋণ পরিশোধের চেয়ে সুবিধা নেওয়ার পেছনে ছুটছেন বেশি। আর এসব ছাড়ের কারণে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের আসল চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছে না। ২০২০ ও ২০২১ সালজুড়ে কয়েক দফায় করোনার কারণে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে কোনো ঋণ পরিশোধ না করে কিংবা সামান্য পরিশোধ করে খেলাপিমুক্ত থাকার সুযোগ ছিল। এ ধরনের বিভিন্ন সুবিধার বেশিরভাগই শেষ হয়েছে গত ডিসেম্বরে। এর পরপরই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ব্যাপকভাবে। ২০২১ সালে ঋণের ১৫ শতাংশ পরিশোধ হলেও তা নিয়মিত দেখানো হয়।
গত বছরের জুলাই মাসে নতুন গভর্নর হিসেবে আব্দুর রউফ তালুকদার কাজে যোগ দেওয়ার পরপরই ১৮ জুলাই ঋণ পুনঃতফসিলে ব্যবসায়ীদের বড় ছাড় দিয়ে নতুন নীতিমালা ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোসহ নগদ এককালীন জমা দেওয়ার হার কমিয়ে ব্যাংকগুলোর ক্ষমতা বাড়ানো হয়। এর ১৬ দিনের মধ্যে সংশোধনী দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া নতুন সার্কুলারে ঋণখেলাপিদের আরও ছাড় দেওয়া হয়, পাশাপাশি বেশ কিছু ক্ষেত্রে কড়াকড়িও করা হয়।