‘এলেবেলে চল্লিশে
সোজা বেণি একপাশে
করে থৈ থৈ
মানুষের মোটা মাথা
ফেলে রেখে খোলা ছাতা
রোদ্দুরে চেয়ে বলে
নাচিয়েরা কই?’
‘কাজ নেই কর্ম নেই, খালি বসে বসে জমি বেচিস আর খাস। বাড়িতে দুটো ছেলেমেয়ে। বউটা না হয় মরে গেছে। তাই বলে সংসার ছেড়ে দিলে কি হবে নাকি?’
দাদি প্রত্যেক দিনের মতোই কলতলায় থালাবাসন মাজতে মাজতে বকে যেতে লাগল একমনে। বলছে কাকে? আর কাকে। বাবাকে!
রোমেলের বাবাটা কিচ্ছু করে না। কিচ্ছু না মানে কিচ্ছুটি না। সারাদিন তার সব চিন্তাজুড়ে কেবল বড় দাদির বলে যাওয়া গুপ্তধনের কথা।
বড় দাদি জেনেছিল বড় দাদার কাছ থেকে, বড় দাদা জেনেছিল তার দাদার কাছ থেকে। এভাবেই বংশানুক্রমে চলে আসছে গুপ্তধনের কথা। শোনা যায়, রোমেলদের পূর্বপুরুষ একসময় ছিল রাজার মিত্র মানুষ। রাজা খুশি হয়ে নানা সম্পদ উপহার দিয়েছিলেন তার বন্ধুকে। বন্ধুর ভয় ছিল, তার ছেলেমেয়েরা নষ্ট না হয়ে যায় সম্পদের লোভে। তাই বুদ্ধিমান কারও হাতেই যাবে এ সম্পদ, ঠিক করলেন তিনি। বানিয়ে ফেললেন ছড়া দিয়ে এক ধাঁধা আর লুকিয়ে রাখলেন সবকিছু। সে এমন এক ধাঁধা যে, কেউ সেটার কোনো সমাধানই করতে পারেনি এখনো পর্যন্ত।
রোমেলের বাবার আশা, চল্লিশ বছর হলেই গুপ্তধনের খোঁজ পেয়ে যাবেন তিনি। ছড়াতেই তো বলা আছে, চল্লিশে! না পেলে অবশ্য রোমেল, তার দাদি, বাবা আর রোমেলের ছোট বোন সোমাকে পথে বসতে হবে। গুপ্তধন খোঁজার আশায় কাজকর্ম বাদ দিয়ে বাবা সব জমিজিরাত বেচে দিয়েছেন। এমনকি বন্ধক রেখেছেন এই বাড়িটাও।
ছড়াটা রোমেলের মুখস্থ। বিড়বিড়িয়ে সেটা পড়তে পড়তে হাঁটছিল সে, এমন সময় পেছন থেকে গুঁতো মারল টুকি। এই টুকি দেওয়ার অভ্যাস আছে বলেই ওর নাম হয়েছে টুকি।
‘কী রে! কই যাস?’ টুকির প্রশ্ন।
‘জানি না। ভালো লাগছে না।’
‘এই একটা মানুষ দেখলাম স্কুল না করতে পারলে তার ভালো লাগে না’, হতাশ হলো টুকি।
‘স্কুলের মাইনে না দেওয়ায় তোকে ক্লাস করতে না দিলে তোরও ভালো লাগত না।’
অনেকটা সময় হাঁটল ওরা। মাথার ওপরে প্রচণ্ড রোদ।
‘চল ওই গাছটার নিচে বসি। দেখ, কী বিশাল ছায়া ওটার নিচে!’
হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল টুকি রোমেলকে। গাছের নিচে বসে চোখ বন্ধ করতেই মাথায় গুড়গুড় করে উঠল ওর কিছু শব্দ।
মানুষের মোটা মাথা ফেলে রেখে খোলা ছাতা রোদ্দুরে চেয়ে বলে নাচিয়েরা কই?
আরেহ! গাছটা তো আসলেই ছাতার মতো। মনে মনে ভাবল রোমেল। হাঁটলে চল্লিশ কদম দূরে হবে না ওদের পূর্বপুরুষের পুরোনো বসতভিটাটা? সোজা রাস্তার একটা পাশে পুকুর। রাস্তাটাকে বেণি ধরলে, পুকুরটা থৈ থৈ করলে...
‘এই শোন টুকি। এখান থেকে ওই ভাঙা বাড়িটা পর্যন্ত যা তো। দেখ তো কত পা হয়?’
কথা না বলে হাঁটা ধরল টুকি।
‘একান্ন।’
‘একান্ন!’ একটু হতাশ হলো রোমেল। মনে মনে আশা করছিল চল্লিশ পায়ের মধ্যেই হয়তো হবে ওটা।
‘কিন্তু কেন হাঁটালি রে রোদের মধ্যে?’
‘কিছু না।’ বলে উঠে পড়ল রোমেল।
টুকিকে রেখে ফিরে এলো বাড়ি। স্কুলের কথা মনে পড়ছে খুব। আর মনে পড়ছে মায়ের কথা। মা থাকলে আজ স্কুল থেকে ওকে বের করে দেওয়া হতো না কখনোই।
‘এই ভাই, কী করিস রে?’ সোমা এসে ধাক্কা দিল রোমেলকে।
‘দেখছিস না শুয়ে আছি?’ বিরক্ত কণ্ঠে বলল রোমেল।
‘মন খারাপ ভাই? মন খারাপ করিস না। আমাকেও নাচের স্কুল থেকে বলে দিয়েছে, টাকা না দিলে আর না আসতে।’ মাথা নিচু করে বলল সোমা। চোখে পানি। প্রাণপণে সেটাকে লুকোচ্ছে সে। উঠে পড়ল রোমেল। বোনকে খুব ভালোবাসে সে। হাতের চেটোয় সোমায় মুখ ধরল সে।
‘কাঁদিস না তো। একদম কাঁদবি না। তুই এমনিতেই অনেক সুন্দর নাচিস। কী শিখবি তুই? তোর কাছ থেকেই মানুষ শিখতে পারে।’
হেসে উঠল সোমা।
‘নাচ দেখবে ভাই?’
‘কী নাচ দেখাবি?’
‘তুমি বলো কোন মুদ্রাটা দেখবে...’
মুদ্রা!
খাট থেকে তড়াক করে উঠে বসল রোমেল। ‘ভাই, কোথায় যাচ্ছ দৌড়ে? নাচ দেখবে না?’ রোমেলের তখন আর কিছুতে মনোযোগ নেই। নাচিয়ে, মুদ্রা, চল্লিশ, ছাতা, বেণি, সিঁথি—সব ধরলে...
সোজা গাছটার কাছে দৌড়ে গেল রোমেল। সেখানে টুকি বসে বসে ঘুমিয়েই পড়েছে।
‘এই ওঠ!’ টুকিকে ধাক্কা মেরে ওঠাল রোমেল।
‘কী...কী হলো? গুপ্তধন পেয়েছিস নাকি?’
‘পাইনি। তবে পাব। সর এখান থেকে। দৌড়ে একটা মাটি খোঁড়ার কিছু নিয়ে আয়।’
ঘণ্টাখানেক পর টং করে একটা শব্দ পেল ওরা টুকির বাড়ি থেকে আনা কোদালের ডগায়। শব্দ শুনেই থেমে গেল টুকি। ‘এবার?’
বাবা আর দাদিকে ডেকে এনে বহু আগের লুকিয়ে রাখা রোমেলের পূর্বপুরুষদের গুপ্তধন দেখাল রোমেল আর টুকি। বেশিদিন লাগল না রোমেলদের ভাগ্য ফিরতে। স্কুলে ফিরল রোমেল, ছোট্ট সোমা ফিরল নাচের ক্লাসে।
তবে বাবার টাকা হাতে যেন থাকেই না। আসতে না আসতে উড়িয়ে ফেলছে হিসাব না করেই। রোমেল অবশ্য ওসব ভাবছে না। বাবার অবস্থা জেনেও ও নিশ্চিন্তে বসে আছে। থাকবে নাইবা কেন? কাউকে বলার আগে ও আর টুকি মিলে অর্ধেক গুপ্তধন লুকিয়ে ফেলেছিল আরেক গোপন স্থানে।
রোমেলের পূর্বপুরুষ ভুল করেননি, কী বলো? রোমেলের মতো বুদ্ধিমান কারও হাতে পড়বে গুপ্তধন, এমনটাই তো চেয়েছিলেন তিনি, নাকি?
মন্তব্য করুন