সিলেটের বিভিন্ন পাথর কোয়ারিতে লুটপাট থামছেই না। কোনো রকম নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই পাথর উত্তোলনের মহোৎসব চলছে। প্রকৃতি কন্যা জাফলং, সাদাপাথরের অপার সম্ভাবনা ধ্বংস করে দিয়েছে পাথরখেকো চক্র। অভিযোগ উঠেছে, এসব লুটপাটে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিএনপি-যুবদল-ছাত্রদল ও শ্রমিক দলের নেতাকর্মীরা।
দুই উপদেষ্টার সফরের পর আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এ চক্র। বাধ্য হয়ে তারা ক্রাশার মেশিনের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দিলেও বন্ধ হচ্ছে না অবৈধ উপায়ে পাথর উত্তোলন। ইতোমধ্যে চার উপজেলায় ৩০০টি অবৈধ ক্রাশার মিলের বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। তবুও পর্যটন স্পটগুলোতে যেতে ভয় পাচ্ছেন পর্যটকরা।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ে। ওইদিনই বিভিন্ন কোয়ারি থেকে দুই হাজার কোটি টাকার পাথর বালু লুট করা হয়। সিলেটের গোয়াইনঘাটের জাফলং, বিছনাকান্দি, কোম্পানীগঞ্জের সাদাপাথর, ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি, শারফিন টিলা, উৎমাছড়া পর্যটন স্পট থেকে এসব পাথর লুট হয়।
স্থানীয়রা জানান, এসব লুটের পেছনে রয়েছেন বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। প্রশাসনের নিরব ভূমিকায় অবৈধ কার্যক্রম চালিয়েছেন তারা। মাঝে মধ্যে লোক দেখানো টাক্সফোর্স অভিযান পরিচালনা করলেও আগেই খবর চলে যায় পাথর খেকো চক্রের কাছে। ফলে এসব লোক দেখানো অভিযান কোনো কাজেই আসেনি। প্রকৃতিকন্যা জাফলংয়ের ধ্বংসযজ্ঞও থামাতে পারেনি প্রশাসন। প্রশাসনের এসব অভিযানের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল।
শনিবার (১৪ জুন) জাফলং ইসিএভুক্ত এলাকা পরিদর্শনে আসেন অন্তর্বর্তী সরকারের বন ও জলবায়ু পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ান হাসান ও বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মোহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। পরিদর্শন শেষে ফেরার পথে দুই উপদেষ্টার গাড়ি বহর আটকে দেন বালু পাথর ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা।
এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন স্থানীয় বিএনপি-যুবদল-ছাত্রদল ও শ্রমিক দলের নেতাকর্মীরা। ওই সময় তারা জাফলংসহ বন্ধ থাকা সিলেটের পাথর কোয়ারি খুলে দেওয়ার দাবিতে স্লোগান দেন। এ ঘটনায় উপদেষ্টারা প্রায় আধা ঘণ্টা আটকে থাকেন। পরে পুলিশ-বিজিবি মিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
২০১৫ সালের ১৪ নভেম্বর জাফলংকে ইসিএ ঘোষণার গেজেট প্রকাশের পর থেকে মাঝেমধ্যে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মজুত পাথরের পরিসংখ্যান রাখা হতো। সর্বশেষ গেল ২৬ জুলাই পরিমাপ অনুযায়ী জাফলংয়ে পাথর মজুত ছিল ৩ কোটি ৭৪ লাখ ঘনফুট। ৫ আগস্ট পরবর্তী লুটপাটে এ পর্যন্ত মজুতের পরিমাণ প্রায় ১ কোটি ঘনফুট কমেছে। যার বাজারমূল্য শতকোটি টাকার ওপরে। পাথরের সঙ্গে বালুও লুটপাট হয়।
এলাকাবাসীরা জানান, কয়েক বছর আগে সরকার পাথর কোয়ারি বন্ধের ঘোষণা দেয়। এরপর থেকে রাতের আঁধারে স্থানীয় সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ইমরান আহমদের দুই সহচর সুভাস দাশ ও অধ্যক্ষ ফজলুল হকের নেতৃত্বে অবৈধভাবে বালু ও পাথর উওোলন চলত। গেল ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর কোয়ারির নিয়ন্ত্রণে নেন বিএনপি ও এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতারা।
পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে গোয়াইনঘাটের জাফলংয়ে পাথর লুটপাটের ঘটনায় ৯টি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ২২৬ জনকে। এর মধ্যে সিলেট জেলা যুবদলের সহসাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কাশেম গত ২৭ এপ্রিল সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। তবে ঈদের আগে তিনি জামিনে ছাড়া পান।
এ ছাড়া কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার শাহ আরেফিন টিলা কর্তন ও পাথর উত্তোলনের অভিযোগে ২৩ জানুয়ারি ৪০ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। এ মামলায় কোনো গ্রেপ্তার নেই। জাফলংয়ে লুটপাটের ঘটনায় দায়ের করা ৯টি মামলার মধ্যে ৬টি বিচারাধীন ও ৩টি তদন্তাধীন অবস্থায় রয়েছে বলে পরিবেশ অধিদপ্তর জানিয়েছে।
এদিকে পাথর লুটের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পদ হারিয়েছিলেন জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম শাহ পরান। পাথর লুটপাটে জড়িত থাকার অভিযোগে স্থানীয় বিএনপির অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সিলেট পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো, বদরুল হুদা বাদী হয়ে পৃথক পৃথক ১০টি ঘটনায় ২৬৬ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন।
মামলার আসামি ও পাথর লুটে জড়িত থাকায় দল থেকে বহিস্কৃতও হয়েছেন অনেকে। ঘটনার প্রায় কয়েক মাস অতিবাহিত হলেও পাথর লুটপাটকারী মামলার আসামিরা এখনো রয়ে গেছেন ধরা ছোয়ার বাইরে।
জানা গেছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলার আসামি হওয়ায় আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে পাথর খেকোরা। শুরু করেন প্রকৃতিকন্যা জাফলংয়ে অবৈধ বালু ও পাথর উওোলনের ধ্বংসযজ্ঞ।
জাফলংয়ের বিভিন্ন এলাকায় ফেলুডার, এস্কোভেটর, বোমা মেশিন ও হাজার হাজার শ্রমিক দিয়ে জুমপাড় কেটে শতাধিক গর্ত তৈরি করে শুরু করেন পাথর উওোলন। এসব ধ্বংসযজ্ঞে রক্ষা পায়নি জাফলং জুমপাড় বাঁধ, কালিবাড়ি মন্দিরসহ শতাধিক একর ফসলি জমি, চা বাগান, পান-সুপারি বাগান, বসতবাড়ি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তঘাটসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
জানা গেছে, এভাবে পাথর উওোলনের ফলে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, গত ৫ আগস্টের পর থেকে জাফলং ও বিছনাকান্দি থেকে ১ হাজার কোটি টাকার বালু পাথর লুটপাট হয়েছে।
৫ আগস্টের পর বেপরোয়া
৫ আগস্টে সরকার পতনের খবরে থানা ও ফাঁড়ি থেকে পুলিশ পালিয়ে যায়। এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ে। বিজিবির নজরদারিও ছিল না, ওই সময়টাই কাজে লাগায় পাথর লুটপাটকারীরা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জাফলং ও বিছনাকান্দি জিরো পয়েন্ট পর্যটন স্পট থেকে শুরু হয় পাথর লুটপাট। মেশিন দিয়ে হাজার হাজার শ্রমিক লাগিয়ে প্রভাবশালীরা দিন-রাত পাথর উওোলন করেন।
এতে এই পাথর খেকোদের থাবায় ধ্বংস হয়েছে প্রকৃতিকন্যা জাফলং। ভেঙে গিয়েছে রাস্তা-ঘাট বসতবাড়ি ও ফসলি জমি। আর এসব ধ্বংসলীলা চালিয়েছেন স্থানীয় বিএনপি বহিস্কৃত নেতা শাহ আলম স্বপন, শাহপরান, হেনরী লামিন, স্টেলিং তারিয়াং, পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি আজির উদ্দিন, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সুমন শিকদার, উপজেলা শ্রমিক দলের সভাপতি আবদুল জলিল, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালাম, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক রমজান মোল্লা ও বহিষ্কৃত উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাহিদ খান।
ক্ষত-বিক্ষত বিছনাকান্দি
পাথরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিছনাকান্দি পর্যটনকেন্দ্রের মূল সৌন্দর্য পাথর। ৫ আগস্টের পর এখানেও লুটপাট চালায় পাথরখেকো চক্র। ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায় এ পর্যটন স্পট। এ সময় পাথর চুরির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও টাক্সফোর্সের অভিযানে লক্ষাধিক ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়। যদিও পরবর্তীতে জব্দকৃত এসব পাথরের আর হদিস পাওয়া যায়নি।
মামলা সূত্রে জানা যায়, গোয়াইনঘাট উপজেলার সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইদুল ইসলামের মৌখিক আদেশে তোয়াকুল ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সাবেক তশীলদার রুহুল আমিন বাদী হয়ে গেল গত বছরের ৩০ অক্টোবর গোয়াইনঘাট থানায় একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। মামলায় বিছনাকান্দি পর্যটন কেন্দ্র ও তৎসংলগ্ন এলাকা থেকে আনুমানিক ৬০ লাখ ঘনফুট পাথর চুরি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
ওই মামলায় উপজেলার রুস্তমপুর ইউনিয়নের ভেড়িবিল গ্রামেয়ার আব্দুছ ছত্তারের ছেলে হারুন মিয়াকে প্রধান আসামি করে এজাহারে ২৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া মামলায় অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছিল আরও ৫০/৬০ জনকে।
এজাহারে বলা হয়, ৫ আগস্টের পর থেকে দুস্কৃতকারীরা ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত নিয়মিত বিছনাকান্দি পর্যটন কেন্দ্র ও তৎসংলগ্ন এলাকা থেকে প্রায় ৬০ লাখ ঘনফুট পাথর চুরি করে নিয়ে যায়। পরে সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইদুল ইসলামের মৌখিক আদেশে গত ৩০ অক্টোবর গোয়াইনঘাট থানায় ৬০ লাখ ঘনফুট পাথর চুরির বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করলে ওই দিনই থানায় মামলাটি রেকর্ড হয়।
হাজার কোটি টাকার পাথর লুট
স্থানীয় সচেতন মহলের অভিযোগ, সিলেটের গোয়াইনঘাটে পাথর দুটি পাথর কোয়ারির মধ্যে একিটি আবার পর্যটন কেন্দ্র। এই দুই কোয়ারিতে বিগত ১৫ বছরে যা লুটপাট হয়নি, গত ১০ মাসে তার চেয়ে তিন চার গুণ বেশি লুটপাট হয়েছে বলেও তারা দাবি করেছেন।
গত ১০ মাসে জাফলং, বিছনাকান্দিতে কী পরিমাণ পাথর লুটপাট হয়েছে প্রশাসনের কাছে হিসাব নেই বললেও, স্থানীয় বাসিন্দাদের ধারণা অন্তত ১ হাজার কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। লুটপাট অব্যাহত থাকায় কিছু দিনের মধ্যে পর্যটন স্পট থেকে শুরু করে কোয়ারিগুলো পাথরশূন্য হয়ে পড়তেও পারে।
জৈন্তাপুরের শ্রীপুরের পাথর কোয়ারি ও সারি নদীর বালু লুটপাট
জৈন্তাপুরে শ্রীপুরের পাথর কোয়ারি থেকে ৩ কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। সারি নদী থেকে বালু প্রায় ৩ কোটি টাকার লুট হয়েছে। জৈন্তাপুর বিএনপির সহসভাপতি আব্দুল আহাদ, বিএনপি নেতা আলমগীর হোসেনের নেতৃত্বে এ লুটপাট হয়েছে বলে অভিযোগ।
কোম্পানীগঞ্জে বিএনপির সভাপতির নেতৃত্বে সিন্ডিকেট
কোম্পানীগঞ্জে ৫ আগস্ট রাতেই লুট হয়ে যায় প্রায় পাঁচশ কোটি টাকার বালু-পাথর। লুট থেকে বাদ যায়নি কোম্পানীগঞ্জে নির্মাণাধীন স্থল বন্দর, ভোলাগঞ্জ স্থল বন্দরের নির্মাণ সামগ্রী, রেলওয়ের মূল্যবান লোহার পাথ, রডসহ বিভিন্ন গুরুত্ব পূর্ণ মালামাল।
স্থানীয়রা জানান, সাদাপাথর সংলগ্ন বাংকারের গর্ত থেকে পাথর উত্তোলনের সঙ্গে জড়িতদের শেল্টার দিচ্ছেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি শাহাব উদ্দিন। তিনি আত্মীয় স্বজনদের দিয়ে একটি বলয় তৈরি করেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক শ্রম বিষয়ক সম্পাদক দুলাল মিয়া দুলা, তার ছেলে ইকবাল হোসেন, বিএনপি সভাপতি শাহাব উদ্দিনের বোনজামাই জসিম উদ্দিন, ভাগ্নে রাসেল, আলিম উদ্দিন, কাজের লোক যুবদল নেতা মো. জাফর, জসিম উদ্দিন, শৈবাল সাজন, ছাত্র সমন্বয়ক জাকির হোসেন, জাহাঙ্গীর হোসেন, সিলেট জেলা যুবদলের সহসাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাকিন আহমদ ফরহাদ, আনোয়ার মিয়া, বুরহান মিয়া, শানুর আলী, সিলেট জেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক বাহার আহমদ রুয়েল, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদলের আহবায়ক সাজ্জাদ হোসেন দুদু, যুবদল সদস্য রজন মিয়া, সদস্য মোস্তাকিন আহমদ ফরহাদ, উপজেলা শ্রমিকদলের সভাপতি আবুল বাশার বাদশা, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান, বিএনপি নেতা লাল মিয়া, আলিম উদ্দিন, সায়দুর রহমান, শাহাব উদ্দিন।
কোম্পানীগঞ্জ সাদাপাথর এলাকায় বিভিন্নজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর শুধু সাদাপাথর নয় বাংকার এলাকা, স্থলবন্দর, শারফিন টিলা দখলে নেন তিনি।
এলাকাবাসী জানান, শারফিন টিলা এলাকা দখলে নিয়েছেন পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সেবুল মিয়া। এসব পাথর খেকোদের করাল থাবায় পাথর রাজ্য ভোলাগঞ্জ বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে জানতে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপি সভাপতি শাহাব উদ্দিনকে একাধিকবার ফোন দিলেও ফোনটি রিসিভ হয়নি।
সিলেটের পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক আবদুল করিম কিম বলেন, ৫ আগস্টের পর সিলেটের জাফলং, শ্রীপুর, ভোলাগঞ্জ এলাকায় ব্যাপক পাথর লুটতরাজ হয়। এমন নজিরবিহীন লুটপাট অতীতে দেখা যায়নি। শুরুতে প্রশাসনিক ব্যবস্থা অকার্যকর ছিল বলে পাথর লুট ঠেকানো সম্ভব হয়নি। এ কথা মানা গেলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার পরও এই লুটপাট বন্ধ করা যায়নি। প্রশাসন লুটপাট ঠেকাতে ব্যর্থতা দেখিয়েছে।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রতন কুমার অধিকারী কালবেলাকে বলেন, কী পরিমাণ পাথর লুট হয়েছে হিসাব নেই। এটা খনিজ সম্পদ বলতে পারবে, এটা তাদের সম্পদ। বিছনাকান্দিতে যে পাথর জব্দ হয়েছে এটা নিলাম প্রক্রিয়ায় ছিল। সর্বশেষ আবার নিলামের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে।
বিছনাকান্দিতে টাক্সফোর্সের অভিযানে জব্দকৃত পাথর আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি সর্বশেষ জানি কিছু পাথর আছে। এর বেশি কিছু জানি না।
বেলার সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আখতার কালবেলাকে বলেন, খনিজ সম্পদ রক্ষা ও সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে মূলত খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের। সে কারণে খনিজ সম্পদ দেখভালের দায়িত্ব পালনে তারা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ।
তিনি বলেন, পাথর উত্তোলনে স্থানীয় এলাকার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ২০২০ সালে কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন সাময়িক সময়ের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে ভালো-মন্দ বিবেচনা না করেই ঝুঁকিপূর্ণ কোয়ারিগুলো থেকে পাথর উত্তোলন শুরু করার সিদ্ধান্তটা ভুল। অনেকেই মনে করছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন বৈধ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অদ্যাবধি এসব কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলনে স্থগিতাদেশ রয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ কালবেলাকে বলেন, এভাবে যে পাথর উত্তোলন হচ্ছে তাতে আমরা নাগরিক সমাজ ক্ষুব্ধ এবং হতবাক। কারণ জেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে এটা বন্ধ করার জন্য। জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব রাজনৈতিক দিক থেকে শুরু করে সবকিছু দেখভাল করার জন্য। কিন্তু তারা ব্যর্থ। এখনো সময় আছে বন্ধ করার। বন্ধ যদি না করতে পারেন তাহলে সাদাপাথর নামক জায়গা দেখার কোনো সুযোগ থাকবে না। এখানে স্থানীয় ইউএনওর অনেক দায়িত্ব আছে।
কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ কালবেলাকে বলেন, কোম্পানিগঞ্জে পাথর উত্তোলনের সঙ্গে পুলিশ কোনোভাবেই জড়িত নয়। যদি কাউকে পাওয়া যায় তাহলে তার বিরুদ্ধে আইন মেনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পাথর উত্তোলনের বিরুদ্ধে আমরা সর্বনিম্ন ১৫টি মামলা নিয়েছি। এবং অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।
সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, কোনো অনৈতিক কাজকে বিএনপি কখনো প্রশ্রয় দেয় না। যে অন্যায় করে সে যত বড় নেতা হোক না কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতিকে শোকজ করেছি এবং তিনি উত্তরও দিয়েছেন। পরে আমরা আমাদের জেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি অ্যাডভাকেট আশিক উদ্দিনের নেতৃত্বে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করি এবং তারা সরেজমিনে পরিদর্শন করে একটা প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।
তিনি বলেন, আগামী দুএকদিনের মধ্যে তারা প্রতিবেদনটি আমাদের কাছে উপস্থাপন করবেন এবং আমরা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এ ব্যাপারে কঠোর প্রদক্ষেপ গ্রহণ করব।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শের মোহাম্মদ মাহবুব মুরাদ কালবেলাকে বলেন, সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলো নিরাপদ রাখতে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৩০০টি ক্রাশার মেশিনে অবৈধ বিদুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
তিনি জানান, কোয়ারি এলাকায় পাথর উত্তোলন বন্ধে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তারা শিগগিরই কাজ শুরু করবেন।
মন্তব্য করুন