বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশ একটি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে অর্জিত যুদ্ধবিধ্বস্ত এই স্বাধীন বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ৩৭তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ যা ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের ২৯তম এবং ২০৫০ সাল নাগাদ ২৩তম অর্থনীতিতে উন্নত দেশে পরিণত হবে। স্বাধীনতার পর মাত্র ১৮ মার্কিন ডলার রিজার্ভ নিয়ে পথচলা শুরু করা বাংলাদেশকে নিয়ে সমালোচনা ও তার বিরোধিতা তখন থেকে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির হাত ধরে শুরু হয়ে এখনো তা চলমান। এই অপশক্তি চোখে আঙুল দিয়ে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়ন রোল মডেল হিসেবে পরিচিত। তা ছাড়া ২০২৬ সালেই বাংলাদেশ ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ এবং ২০৪১ সালেই ‘উন্নত দেশ’ হিসেবে বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করবে।
বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে তার বড় প্রমাণ হলো গত কয়েক বছর ধরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বর্তমান মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৭৬৫ মার্কিন ডলার। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে বিশ্বের শীর্ষ কয়েকটি দেশের একটি আজ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধন এগুলো নিঃসন্দেহে উন্নয়নের মাইলফলক। উন্নয়নের এমন কোনো দিক নেই যেখানে বাংলাদেশের পদচারণা হয়নি। কিন্তু এত এত উন্নয়ন স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির চোখে পড়ে না। তা ছাড়া কেনই বা চোখে পড়বে তাদের! এই অপশক্তিগুলো প্রতিনিয়ত বাংলাদেশকে নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচারে লিপ্ত। বাংলাদেশের জিডিপির আকার যেখানে ৪৬০ বিলিয়ন ডলার এবং মাথাপিছু আয় যেখানে ২৭৬৫ মার্কিন ডলার সেখানে এই বাংলাদেশ ও দেশের স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিগুলো অপপ্রচার চালাচ্ছে যে, বাংলাদেশের নাকি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা নেই। দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির এই বাংলাদেশকে নিয়ে এমন ধরনের মন্তব্য নিতান্তই উপহাসযোগ্য এবং ভিত্তিহীন।
বাংলাদেশের উন্নয়ন ও স্বাধীনতাবিরোধী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অধীনে দুর্নীতি, বিদেশে টাকা পাচার ও লুটপাটের ফলে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত বাংলাদেশকে উন্নয়নের বর্তমান স্তরে নিয়ে আসতে দেশীয় সম্পদ ব্যবহারের পাশাপাশি বৈদেশিক ঋণ নিতে হয়েছে। বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার মাধ্যমে ঋণ গ্রহণকারী বাংলাদেশ একসঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার একটি বড় অংশ পায়, যা অবকাঠামো এবং বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে কাজে লাগায়। যেমন রাশিয়া থেকে ঋণের অর্থ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ব্যবহার হচ্ছে। চীনের ঋণে তৈরি হচ্ছে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। সাধারণ অবস্থায় বাংলাদেশের মতো এমন উন্নয়নশীল দেশের রাজস্ব আয় এ ধরনের মেগা প্রকল্পগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান যথেষ্ট নয়। তাই বৈদেশিক ঋণ বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের কাজকে সহজ করে, যা পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন অবিরাম বিদ্যুতের সরবরাহ, কম খরচে পরিবহন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা, বন্দর এবং অন্যান্য সুবিধাসহ বর্ধিত অবকাঠামো দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত। উন্নয়নশীল দেশগুলোর এসব অবকাঠামো নির্মাণকাজকে সহজ করে বৈদেশিক ঋণ। বাংলাদেশের এসব ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা আছে বলেই ঋণ দাতারা বাংলাদেশকে ঋণ দিয়েছে।
অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আইএমএফ যে ঋণ সহায়তা দিতে যাচ্ছে তা পরিশোধের সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে বলে মনে করেন প্রতিষ্ঠানটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ। তিনি বলেন, ‘বর্তমান সংকটকালে আইএমএফ বাংলাদেশকে যে ঋণ সহায়তা দিতে যাচ্ছে তা যথাসময়ে পরিশোধের সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে।’ বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করে ডিএমডি অ্যান্তইনেত মনসিও বলেন, ‘আইএমএফ দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী। ২০৪১ সাল নাগাদ একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও উচ্চ আয়ের দেশে উত্তরণে বাংলাদেশকে সহায়তা অব্যাহত রাখবে আইএমএফ।’ সুতরাং পরিশোধের সক্ষমতা আছে বলেই বাংলাদেশকে আইএমএফ ঋণ দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরলস প্রচেষ্টায় করোনা ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অনেক দেশের অর্থনীতি হিমশিম খেলেও বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। দেশে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নের পাশাপাশি শতভাগ বিদ্যুতায়ন, মাতৃস্বাস্থ্য সুরক্ষা, মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান, প্রায় এক কোটি মেয়ে শিক্ষার্থীকে মোবাইলে অর্থ প্রেরণের মাধ্যমে বৃত্তি প্রদান, নারীদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, শিক্ষাক্ষেত্রে নারীদের অভূতপূর্ব অগ্রগতি, তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীদের দক্ষতা উন্নয়ন, ডেল্টাপ্ল্যান ২১০০ প্রণয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সফলতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। সরকার দারিদ্র্য দূরীকরণ ও খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ্যে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নেওয়ার পাশাপাশি হতদরিদ্র মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সামাজিক সুরক্ষা জালের আওতা বর্ধিতকরণ এবং টিসিবি ও ভিজিএফ কার্ডের মাধ্যমে তাদের মাঝে খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস বিতরণের মতো নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও জনগণের জীবনমান সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে বর্তমান সরকার।
আমাদের দেশের যে বৈদেশিক লোন আছে তা ফেরত দেওয়া যে সমস্যা হবে না তা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের বক্তব্য থেকেও নিশ্চিত হওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা আছে।’ কারণ সম্প্রতি স্ট্যান্ডার্ড পওর পিস অ্যান্ড বডি যে কান্ট্রি রেটিং করেছে, তাতে এত অসুবিধার মাঝেও তারা বাংলাদেশের আগের রেটিংই বহাল রেখেছে এবং বলেছে তা ভবিষ্যৎ স্ট্যাবল। ক্রেডিট এজেন্সিগুলো একটা জিনিসই দেখে যে, আপনি লোন শোধ দিতে পারবেন কিনা। তারা দেখে বলেছে যে, বাংলাদেশ তা পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সবসময় বলে আসছে বাংলাদেশের যে লোন আছে সেটা ফেরত দেওয়া কোনো সমস্যা না। এ বিষয়ে আরও বেশি নিশ্চিত হতে আমরা যদি একটু পেছনে গিয়ে দেখি তাহলে দেখি যে, ডিএসএসআই ২০২০ সালে আমাদের যত লোন ছিল পিছিয়ে দিতে চেয়েছিল। সমস্ত ডেভেলপিং কান্ট্রি যারা আইডিএ উইন্ডো থেকে লোন নেয় তাদের জন্য এটা করা হয়েছিল। একমাত্র বাংলাদেশ, আমরা এই অফারটা নিইনি। আমরা বলেছি, আমাদের সামর্থ্য আছে। আমরা এ টাকা শোধ দিতে পারব এবং আমরা কিন্তু ওইটা নিইনি, শোধ দিয়েছি সময়মতো। সুতরাং আমাদের এ মুহূর্তে যে লোন আছে তা আমাদের টোটাল এক্সটার্নাল ডেবট টু জিডিপি ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ, যা পৃথিবীর মধ্যে সর্বনিম্ন। আমাদের যে থ্রেশহোল্ড সেটা কিন্তু অনেক উপরে, ৪৫ পার্সেন্ট যেতে পারে। সুতরাং এটা খুব বেশি এমন কিছু না। আমরা শোধ দিতে পারব। সেই সামর্থ্য আমাদের আছে এই বিষয়ে কোনো প্রকার সন্দেহ নেই।
অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কাসহ আরও কিছু দেশ যেখানে দাতা সংস্থাদের কাছ থেকে ঋণ চেয়েও পাচ্ছে না সেখানে আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতা সংস্থা ও দেশ বাংলাদেশের জন্য একরকম ঋণের ডালি খুলে বসেছে। গত বছর আইএমএফের সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণের পর এবার বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ দিতে চুক্তি করেছে। এডিবি এবং জাইকাসহ অন্য দাতা সংস্থাগুলোও এগিয়ে আসছে বাংলাদেশকে ঋণ দিতে। বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতাই ঋণ দাতাদের আস্থার ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চলমান বৈশ্বিক সংকটে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত অনেক দেশের চেয়েও বাংলাদেশের অর্থনীতি মজবুত অবস্থানে আছে এবং ঋণ নিয়ে তা পরিশোধের সক্ষমতা রয়েছে। আর এ কারণেই বাংলাদেশকে ঋণ দিতে এগিয়ে আসছে দাতা সংস্থা ও দাতা দেশগুলো।
এখন পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কাসহ আরও কিছু দেশ রয়েছে যারা ঋণ নিলে শোধ করতে পারবে কিনা- তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে দাতা সংস্থাগুলোর। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দাতাদের এ রকম কোনো সন্দেহ নেই। কারণ ওইসব দেশের অর্থনীতির চেয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বেশ মজবুত অবস্থানে রয়েছে। ওইসব দেশের এখন ঋণ নিয়ে হয়তো পরিশোধ করার মতো সক্ষমতা নেই কিন্তু বাংলাদেশের সে সক্ষমতা রয়েছে। যেসব দাতা সংস্থা বা দাতা দেশ বাংলাদেশকে ঋণ দিচ্ছে তারা অনেক যাচাই-বাছাই করে তবেই দিচ্ছে। তবে দাতাদের ঋণ দেওয়ার অগ্রাধিকার ও বাংলাদেশের প্রয়োজন- এ দুয়ের সমন্বয় ঋণপ্রাপ্তি আরও সহজ করে দিয়েছে। এ ছাড়া গত বছরের শেষের দিকে এসে আইএমএফ যে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন দিয়েছে- এটিও অন্য দাতাদের ঋণ দেওয়ার পথ খুলে দিয়েছে বা অন্যদের ঋণ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। তা ছাড়া আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে সেগুলো ধাপে ধাপে পূরণ করায় বাংলাদেশের প্রতি দাতাদের আস্থা বেড়েছে।
যেখানে জিডিপির ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণ নেওয়ায় কোনো ঝুঁকি নেই সেখানে বাংলাদেশের এখন যা বিদেশি ঋণ রয়েছে তা জিডিপির ২০ শতাংশের মতো। সুতরাং এই দিক থেকে কিছুটা স্বস্তিও রয়েছে। এ ছাড়াও ঋণ নিয়ে যেসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সেগুলো থেকে রিটার্ন পাওয়া শুরু হলে ঋণ পরিশোধ করতে কোনো সমস্যা হবে না।
সুতরাং প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে অল্প সময়ে বাংলাদেশের এমন বিস্ময়কর উন্নয়নে ঈর্ষান্বিত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও উন্নয়নে বিশ্বাসী অপশক্তিগুলো একসময় অপপ্রচার চালিয়ে ছিল যে, বাংলাদেশের মানুষ কোনোদিন পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন দেখবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁদের চোখে আঙুল দিয়ে তা প্রমাণ করে দিয়েছেন। এখন এই অপশক্তিগুলো দেশের শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিতে অস্বাভাবিক করতে অপপ্রচার চালাচ্ছে যে, বাংলাদেশের করা বৈদেশিক ঋণ নাকি পরিশোধ করতে পারবে না। অচিরেই বঙ্গবন্ধু তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ তাঁর বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের মাধ্যমে এই অপপ্রচারকারীদের বরাবরের মতো দাঁত ভাঙা জবাব দিবে। কোনো ধরনের অপপ্রচার, ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত বাংলাদেশ ও তার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন শেখ হাসিনার পথচলাকে রুদ্ধ করতে পারবে না। বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা আছে বলেই ঋণ নিয়েছে এবং অতীতের মতো তা ঠিক সময়ে পরিশোধও করা হবে।
ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া : ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন