বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি তৈরি পোশাকশিল্প দেশে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত। বিশাল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা এই শিল্পে প্রায়ই অস্থিরতা দেখা দেয়। ইতিহাস বলছে, কখনো শ্রমিকরা বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে, কখনো বকেয়া পরিশোধের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। কখনো তারা কারখানায় হামলা করেন, মূল্যবান জিনিসপত্র ভাঙচুর করেন। কিছুদিন আগেও বেতন বাড়ানোর জন্য পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভে নতুন করে পোশাক শিল্পে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। এই অস্থিরতাকে কেন্দ্র করে তৈরি পোশাকশিল্প নিয়ে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের আশঙ্কা দিলে এই শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।
প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা পোশাকশিল্পের স্থিতিশীলতা ধরে রাখার লক্ষ্যে এবং পোশাক শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার্থে মজুরি বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে যে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প নিয়ে অতীতে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ছিল এবং তা এখনো চলমান রয়েছে। এই খাতে আমাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ঠেকাতে প্রতিযোগীরা তৎপর রয়েছে।
আমাদের পোশাকশিল্প নিয়ে আন্তর্জাতিক যড়যন্ত্রের স্পষ্টতা পাওয়া যায় সম্প্রতি বাংলাদেশের পোশাকশিল্প নিয়ে আট কংগ্রেসম্যানের চিঠি থেকে। বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের মজুরি সম্প্রতি বাড়ানো হলেও তা জীবনযাত্রার ব্যয়ের তুলনায় যথেষ্ট মনে করছেন না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আট কংগ্রেসম্যান। তাই পোশাক শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির দাবিতে জোরালো সমর্থন ও শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় সরকারকে চাপ দিতে আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যারকে (এএএফএ) চিঠি দিয়েছেন তারা। মজুরি বৃদ্ধির মাধ্যমে যেখানে বাংলাদেশ সরকার শ্রমিকদের সন্তুষ্ট করে পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন সেখানে ওই মজুরি শ্রমিকদের জীবনমান রক্ষায় যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য করা পরিষ্কারভাবে ইঙ্গিত করছে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প নিয়ে আট কংগ্রেসম্যানের চিঠি নতুন একধরনের ষড়যন্ত্র। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অস্বাভাবিক করার লক্ষ্যেই মূলত তাদের এই ষড়যন্ত্র।
কয়েক মাসে আগে বাংলাদেশে গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি নিয়ে যে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল এবং পরবর্তীতে পোশাক শ্রমিকদের সর্বনিম্ন বেতন আট হাজার থেকে বাড়িয়ে ১২ হাজার ৫০০ টাকা করার কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতির সমাধান, এবং শ্রমিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজে যোগদান করায় পোশাক খাতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে। এই স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এই আট কংগ্রেসম্যানের লিখা এমন চিঠি কোনোভাবেই যুক্তিসংগত হতে পারে না। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নতুন করে অস্বাভাবিক করার স্বার্থেই তারা নতুন এই ষড়যন্ত্রকে বেছে নিয়েছে।
আমেরিকান অ্যাপারেল এবং ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহীর কাছে আট কংগ্রেসম্যানের লেখা এই চিঠি যে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প নিয়ে তাদের করা নতুন এক ষড়যন্ত্র তা এই চিঠি কয়েকটি দিকের গভীর বিশ্লেষণে উঠে আসবে। একটু লক্ষ করলে আমরা দেখতে পাই যে, আমেরিকার কংগ্রেসম্যান সেখানকার কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসায়ীদের সংগঠনকে এভাবে সরাসরি চিঠি লেখে না। কেননা এই ধরনের চিঠি সেখানকার কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে লিখলে তা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হিসেবে গণ্য হয় এবং এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়ে থাকে। তবে তারা কংগ্রেসে আলোচনা করেন, প্রয়োজনীয় আইন পাস করেন এবং আমেরিকার ব্যবসায়ীরা সেই আইন মেনেই তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এই ক্ষেত্রে এমন সরাসরি চিঠি লিখার কোনো ইতিহাস নেই। এমতাবস্থায় এই আট কংগ্রেসম্যানের চিঠি বাংলাদেশের পোশাকশিল্প নিয়ে তাদের করা নয়া ষড়যন্ত্রকেই ইঙ্গিত করছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
এরপর লক্ষ্য করুন আমেরিকার আট কংগ্রেসম্যান তাদের চিঠিতে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকের অসন্তোষের যে বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন সেগুলো অনেক পুরনো ঘটনা। গার্মেন্টস শ্রমিকদের সর্বনিম্ন বেতন বৃদ্ধিসহ শ্রমিক অসন্তোষের বিষয়গুলোর সমাধান হওয়ায় সব শ্রমিক কাজে যোগ দিয়েছেন এবং সব কারখানা পুরোদমে চলছে। অথচ আমেরিকার আট কংগ্রেসম্যান এসব পুরনো এবং মীমাংসিত বিষয় উল্লেখ করে এতদিন পরে এসে চিঠি লিখলেন। আমি আশ্চর্য না হয়ে পারছি না এটা ভেবে যে আমেরিকার মতো বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশের আইনপ্রণেতারা এ রকম পুরোনো এবং সন্তোষজনকভাবে নিষ্পত্তি হওয়া বিষয় নিয়েও চিঠি লিখতে পারেন। মানে এই ধরনের চিঠি তাদের কথা না হলেও লিখে তারা প্রমাণ করলেন যে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প নিয়ে ষড়যন্ত্র করার স্বার্থেই এই চিঠি লিখা হয়েছে।
এখানে আরোও একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, তারা শ্রমিকদের সর্বনিম্ন বেতন ২০৮ ডলারের সমপরিমাণ নির্ধারণ করার দাবি জানিয়েছেন। এই বিষয়টি একেবারেই অস্বাভাবিক এবং অবাস্তব মনে হয়েছে। কেননা ইতিহাস বলছে পশ্চিমা বিশ্বের, বিশেষ করে আমেরিকার নীতিনির্ধারক বা কংগ্রেসম্যান কখনই অন্য কোনো দেশের শ্রমিকের মজুরি বা অন্য কোনো বিষয় সংখ্যা উল্লেখ করে নির্ধারণ করার জন্য সুপারিশ করেন না। আর যদি করেও থাকে তবে তা এ রকম খণ্ডিত সংখ্যা ২০৮ ডলার হওয়ার কথা নয়। সেটি হয়তো সাধারণ সংখ্যা ২০০, ২৫০ বা ৩০০ ডলার হতে পারে। একেবারে ২৫ হাজার টাকার সমপরিমাণ ২০৮ ডলার উল্লেখ করার কারণেই আর বুঝতে বাকি থাকে না যে স্বার্থান্বেষী মহল যারা বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকের সর্বনিম্ন বেতন ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণের অবাস্তব দাবি তুলে গার্মেন্টস শিল্পে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা চালিয়েছিল তারাই এই চিঠির বক্তব্য লিখেছেন।
আমার প্রশ্ন হলো এইখানে যে আমেরিকার আট কংগ্রেসম্যানের এই চিঠির দ্বারা কাদের স্বার্থ রক্ষা হবে? এই বিষয়টি বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, একদিকে আমেরিকার জনগণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেননা তাদের এই চিঠির কারণে যদি শ্রমিকের বেতন ২০৮ ডলারের সমপরিমাণ করা হয় বা বাংলাদেশের বিকল্প বাজার খোঁজা হয়, তাহলে উচ্চ দ্রব্যমূল্যে নাভিশ্বাস ওঠা আমেরিকানদের আরও অধিক মূল্যে কাপড়চোপড় কিনতে হবে। ফলে আমেরিকার জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্যদিকে আমেরিকার ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অপেক্ষাকৃত বেশি দামে তৈরি পোশাক আমদানি করার কারণে তাদের মুনাফা হ্রাস পাবে যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আমেরিকার পোশাক ব্যবসায়ীদের ওপর। সুতরাং বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প নিয়ে করা ষড়যন্ত্রের ফলে আমেরিকার জনগণ এবং পোশাক শিল্পের ব্যবসায়ীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার যথেষ্ট ব্যবসায়ী ও কর্মীবান্ধব। পোশাকশিল্প মালিকদের এবং শ্রমিক স্বার্থ রক্ষার্থে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বদ্ধপরিকর। পোশাকশিল্পের স্থিতিশীলতা রক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখা ব্যাপারে সরকার যথেষ্ট সচেতন। কোনো ধরনের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত পোশাক খাতের অগ্রগতির ধারা বন্ধ করতে পারবে না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যমান থাকতে।
আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে রপ্তানি ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যে এ শিল্পের সক্ষমতা বাড়াতে এরই মধ্যে সরকারের সহায়তায় পণ্য বহুমুখীকরণ, বাজার বহুমুখীকরণ, ফাইবার বহুমুখীকরণ এবং দক্ষতা উন্নয়ন, ইনোভেশন ও টেকনোলজি আপগ্রেডেশন এবং কস্ট-কম্পিটিটিভ হওয়ার মাধ্যমে ভ্যালু চেইনে এগিয়ে থাকার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তৈরি পোশাকশিল্পের সঙ্গে জড়িতরা এসব নিয়ে কাজও করছেন। এর ফলে চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) জুলাই মাসে যুক্তরাজ্য এবং কানাডায় পোশাক রপ্তানি যথাক্রমে ৪৭৫ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন এবং ১২৮ দশমিক ৮৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে ২৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ এবং ১৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
একই সময়ে অপ্রচলিত বাজারে পোশাক রপ্তানি ২৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেড়েছে। টাকার অঙ্কে এটি ৬৭৪ দশমিক ৮২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। প্রধান অপ্রচলিত বাজারগুলোর মধ্যে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় রপ্তানি যথাক্রমে ৪৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ, ৫৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ, ২ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং ১৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেড়েছে। এই অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে সরকারের একান্ত প্রচেষ্টা ও সহযোগিতার ফলে।
সুতরাং, বাংলাদেশ অর্থনীতির একমাত্র চালিকাশক্তি এই তৈরি পোশাকশিল্প নিয়ে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র অতীতে যেমন ছিল এখনো তেমনি আছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের পোষাক শিল্প নিয়ে আট মার্কিন কংগ্রেসম্যানের চিঠি নিঃসন্দেহে নয়া ষড়যন্ত্রগুলোর মধ্যে একটি। তবে এই ষড়যন্ত্র নিয়ে বাঙালি জনগণের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা তার কূটনৈতিক প্রজ্ঞাবলে এই ধরনের ষড়যন্ত্রের কোনো প্রভাব আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর পড়তে দেবে না এটা নিশ্চিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পের যে অগ্রগতি তার ধারাবাহিকতা রক্ষিত হবে এতে কোনো ধরনের সন্দেহ নেই।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া : উপাচার্য (রুটিন দায়িত্ব), বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন