প্রাণের মেলা / রুচির বদল ঘটিয়েছে সামাজিক মাধ্যম
অমর একুশে বইমেলা মানেই পাঠক, লেখক আর প্রকাশকদের মিলনমেলা। বিভিন্ন বয়সের পাঠক আসেন বইমেলায় নিজের পছন্দের ও প্রিয় লেখকের বই সংগ্রহ করতে। মেলায় আসা পাঠক-দর্শনার্থীর অধিকাংশই বয়সে তরুণ। তাদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ফেসবুক তারকাদের লেখা বইগুলো। তবে থ্রিলার, উপন্যাস, অনুবাদ সাহিত্য ও নতুন লেখকদের বইয়ের প্রতিও তরুণদের আগ্রহ দেখা গেছে। প্রকাশক-বিক্রয়কর্মীরা জানান, তরুণদের একটি বড় অংশই আসে বিভিন্ন ফেসবুক সেলিব্রেটির বই কিনতে, যাদের বেশিরভাগই মূলত লেখক নন। গতকাল শনিবার বিকেলে এর প্রমাণ মিলল রাজধানীর সূত্রাপুর থেকে মেলায় আসা তরুণ আবদুল্লাহ খানের বক্তব্যে। পছন্দের বই সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি আসলে বই তেমন পড়ি না। আমার প্রিয় একজন ফেসবুক সেলিব্রেটি বই লিখেছেন। সেই ভালোলাগা থেকে কিনলাম। প্রকাশকদের মতে, এই শ্রেণির তরুণ পাঠকরা আসলে ‘বই’ পড়েন না, লেখক পড়েন। আর এ ধরনের পাঠকের কারণে মূলধারার লেখকরা অবহেলিত হচ্ছেন। কারণ যারা সত্যিকারের পাঠক তারা মূল ধারার লেখকদের বই কেনেন এবং পড়েন। আর যারা ফেসবুক সেলিব্রেটিদের বই কেনেন, তারা আবেগের জায়গা থেকেই কেনেন। অনেক সময় সেই বই পড়েনও না। কবি সুদেব চক্রবর্তী বলেন, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচিত মুখ, ইউটিউবাররা ইদানীং বই লিখছেন। তাদের ফ্যান-ফলোয়াররা এসে সেসব বই কিনেছেন মেলায় এসে। এসব বইয়ের মাধ্যমে আসলে সমাজের কী উপকার হচ্ছে বা মেসেজ দিচ্ছে, তা ভেবে দেখা দরকার। কারণ একটি বই আমাদের একটি জেনারেশন তৈরির পেছনে বিরাট ভূমিকা রাখে। বাংলা প্রকাশের প্রকাশক আহসান আল আজাদ বলেন, সেলিব্রেটিদের বই লেখাতে দোষের কিছু নেই। তবে সেই বই কতটা মানসম্পন্ন ও গ্রহণযোগ্য সেটাই বিবেচ্য বিষয়। শুধু ফেসভেল্যুর কারণে বই বিক্রি বেড়ে যাওয়া, আর মূলধারার লেখকদের জ্ঞানগর্ভ বই অবহেলিত হওয়াটা দোষের। এ সংস্কৃতির পরিবর্তন দরকার। এ জন্য প্রয়োজন একটি পাঠাভ্যাসসম্পন্ন জাতি। শ্রাবণী প্রকাশনীর প্রকাশক রবিন আহসান বলেন, বইমেলায় সব ধরনের পাঠকই আসেন। তবে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী বিশেষ করে তরুণ পাঠকের সংখ্যাই বেশি। তাদের জন্য আমরা আলাদাভাবে ৫ শতাংশ ছাড়ের ব্যবস্থা করেছি। এই তরুণ পাঠকদের পছন্দের তালিকায় এগিয়ে রয়েছে থ্রিলার, অনুবাদ সাহিত্য, উপন্যাস। এর মধ্যে একটি বৃহৎ অংশ তরুণ লেখকদের ভক্ত। আমরা চাই তরুণ প্রজন্ম যেন বইমুখী হয়। তাদের হাতে রুচিশীল বই পৌঁছে দেওয়াই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। তবে মূলধারার লেখকদের বই কেউই কিনছেন না–এমনটিও নয়। বইমেলার অপেক্ষায় থাকেন এক শ্রেণির পাঠক, যারা বিভিন্ন প্যাভিলিয়নে গিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে বই কেনেন। এমনই একজন নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা পাঠক সামিয়া তাসলিম। তিনি বলেন, আমার উপন্যাস পড়তে ভালো লাগে। হুয়ায়ূন আহমেদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা আমার খুব পছন্দ। তবে নতুন লেখকদের লেখা কয়েকটি বইও এবার কিনেছি। পড়ে দেখব তারা কেমন লিখেছেন। অনিন্দ্য প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী মিতু বলেন, মেলায় তরুণ পাঠকের সংখ্যাই বেশি। আর তাদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে রয়েছে উপন্যাস। তরুণদের মধ্যে একটা অংশ বিভিন্ন ফেসবুক সেলেব্রিটির ভক্ত। তাই তার বই না কিনলে নয়, এমন ধারণা থেকে বই কেনেন। আসলে তারা আবেগের জায়গা থেকেই কেনেন; কিন্তু পড়েনও না। এবার মেলায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সেলিব্রিটি অন্তিক মাহমুদ, টিপু সুলতান, খন্দকার মুশতাক আহমেদ, ডা. সাব্রিনা, আরিফ আজাদ, চমক হাসান, ঝংকার মাহমুদ, ডা. সাইদুল আশরাফ কুশলের বই তরুণ-তরুণীরা বেশি চাচ্ছে। তবে মেলায় ভিন্ন চিত্রও দেখা গেছে। গত শুক্রবার বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মিজান পাবলিশার্সের সামনে উপচে পড়া ভিড় ছিল দর্শনার্থীদের। মুশতাকের লেখা ‘তিশার ভালোবাসা’ এবং ‘তিশা অ্যান্ড মুশতাক’ বই হাতে নিয়ে পাঠকদের বই কিনতে উৎসাহিত করছিলেন মুশতাক-তিশা দম্পতি। হঠাৎ একদল দর্শনার্থী এসে তাদের ‘ভুয়া ভুয়া’ বলে তাড়া করে এবং মেলায় তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। এ সময় আনসার সদস্যরা মুশতাক-তিশা দম্পতিকে নিরাপত্তা দিয়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের গেট দিয়ে মেলা প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে যেতে সাহায্য করেন। গতকাল বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি: সুচিত্রা মিত্র’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাইম রানা। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন আহমেদ শাকিল হাসমী এবং অণিমা রায়। সভাপতিত্ব করেন মফিদুল হক। আজ লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি ও অনুবাদক জিল্লুর রহমান, কথাসাহিত্যিক পলাশ মজুমদার, শিশু সাহিত্যিক আহমেদ রিয়াজ এবং প্রাবন্ধিক মোতাহার হোসেন মাহবুব। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি দিলারা হাফিজ, চঞ্চল আশরাফ এবং রনজু রাইম। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী অনিমেষ কর, কাজী বুশরা আহমেদ তিথি, মিজানুর রহমান সজল এবং মুস্তাক আহমেদ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পুঁথি পাঠ করেন ফকির আবুল হাশেম। এ ছাড়াও ছিল মিতা মোস্তফার পরিচালনায় নৃত্য সংগঠন ‘বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্র’ এবং মো. আনোয়ার হোসেনের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘আরশিনগর বাউল সংঘ’-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী কিরণ চন্দ্র রায়, তপন মজুমদার, অনাবিল ইহসান, রুশিয়া খানম, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, জামাল দেওয়ান এবং সাগর দেওয়ান। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ পাল (তবলা), আনোয়ার সাহদাত রবিন (কি-বোর্ড), মো. মনিরুজ্জামান (বাঁশি), অনুপম বিশ্বাস (দোতারা) এবং দশরথ দাস (বাংলা ঢোল)। গতকাল নতুন বই এসেছে ১৫২টি। এর মধ্যে গল্পের বই ২১, উপন্যাস ১৭, প্রবন্ধ ১০, কবিতা ৪৫, গবেষণাগ্রন্থ ৩, ছড়ার বই ২, ভ্রমণের বই ৩, শিশুসাহিত্য ১২, জীবনী ৫, মুক্তিযুদ্ধের বই ৪, সায়েন্স ফিকশন ১, নাটকের বই ২, বিজ্ঞানের বই ২, রাজনীতির বই ১, চিকিৎসাবিষয়ক বই ৪, রম্যগল্প ২, অনুবাদ ২, অভিধান ৩, রচনাবলি ৩ এবং অন্যান্য ৯টি। আজকের আয়োজন: অমর একুশে বইমেলার আজ ১১তম দিন। মেলা শুরু হবে বিকেল ৩টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি: কলিম শরাফী শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন সরওয়ার মুর্শেদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন মাহমুদ সেলিম এবং গোলাম কুদ্দুছ। সভাপতিত্ব করবেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা।
১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪
X