সংকেত ও টেলিকমের কাজেই ৫০ কোটি টাকা নয়ছয়
বাংলাদেশ রেলওয়ের হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নাধীন অন্যতম আলোচিত মেগা প্রকল্প হলো দোহাজারী-কক্সবাজার রেলওয়ে প্রকল্প। গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নেওয়া এ প্রকল্পটির আনুষ্ঠানিক মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে। এরই মধ্যে প্রকল্প ঘিরে শুরু হয়েছে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও নিম্নমানের কাজ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা। অভিযোগের তীর যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দিকে।
ট্রেন পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ সংকেত ও টেলিকম শাখায় ৫০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বিশেষ অনুসন্ধান টিম তদন্ত শুরু করেছে। এর আগেও দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ডুয়েল গেজ রেল প্রকল্পে ঠিকাদারদের যোগসাজশে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ও মালপত্র সরবরাহের মাধ্যমে ৫০ কোটি টাকার বেশি দুর্নীতি ও আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে, যার অনুসন্ধান ছিল দুদকের নথিতে।
সবশেষ ২৬ অক্টোবর দুদকের অনুসন্ধান টিমের পাঠানো চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে রেল প্রশাসন আংশিক তথ্য প্রদান করেছে। দুদকের বিশেষ অনুসন্ধান টিম যে কোনো সময় মাঠপর্যায়ে তদন্তে নামবে বলেও নিশ্চিত করেছেন টিম লিডার ও দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আবদুল মালেক।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সংকেত ও টেলিকম বিভাগের চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ সেলিমকে ৩ সেপ্টেম্বর এক আদেশে বদলি করা হলেও, মাত্র ১৩ দিনের ব্যবধানে ১৬ সেপ্টেম্বর সে আদেশ বাতিল করা হয়। বিতর্কিত কর্মকর্তার বদলি এবং তা বাতিলের ঘটনা ঘিরে রেলওয়ে মহলে গুঞ্জন চলছে। প্রকল্পের বিভিন্ন নথির পাশাপাশি দুদকের সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে তার ব্যক্তিগত যাবতীয় ডকুমেন্টও চাওয়া হয়েছে।
এ প্রকল্পের অনিয়ম-লুটপাটের পেছনে রেলের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও জড়িত আছেন বলে রেল অঙ্গনে আলোচনা রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম রেলের মহাপরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। সচিবের কথামতো মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেনকে কল ও মেসেজ করলেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অতীতে দুদক ও রেলওয়ের নিজস্ব অনুসন্ধানে একাধিকবার প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির সত্যতা মিললেও রেলপথ মন্ত্রণালয় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বরং নিয়ম ভঙ্গ করে প্রকল্পের ক্রয় কার্যক্রমে নিযুক্ত কর্মকর্তাকে দীর্ঘদিন ধরে একাধিক দায়িত্বে বহাল রাখা হয়েছে। অনুসন্ধান শুরুর পরও মোহাম্মদ সেলিম প্রভাব খাটিয়ে বদলি ঠেকিয়েছেন। বর্তমানে তিনি নিয়মিত পদের পাশাপাশি চট্টগ্রাম রেলওয়ের দুটি মেগা প্রকল্পের আরও তিনটি পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
অভিযোগ রয়েছে, রেলওয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কারণে তিনি দীর্ঘদিন ধরে একই সঙ্গে বিভাগীয় দায়িত্ব ও প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। তার দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-গুনদুম সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প। এ প্রকল্পে পরিচালক ও পূর্বাঞ্চলীয় জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ সুবক্তগীনের সখ্যর কারণে তিনি দীর্ঘদিন ধরে উপপরিচালক (সিগন্যাল ও টেলিকম) এবং উপপরিচালক (পুনর্বাসন) হিসেবে বহাল রয়েছেন।
মোহাম্মদ সেলিম ২০১৭ সাল থেকে পুনর্বাসন পদের উপপরিচালক হিসেবে দায়িত্বে আছেন। ২০১৫ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত চট্টগ্রামে বিভাগীয় সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী পদে দায়িত্ব পালনের সময় তাকে একাধিক প্রকল্প দায়িত্বে রাখা হয়। কিন্তু ওই সময় অন্য কাউকে পদায়ন করা হলে তিনি ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে তাদের সেখানে দায়িত্ব পালন করতে দেননি। জন্মস্থান চট্টগ্রামের পাহাড়তলী হওয়ায় তিনি স্থানীয় প্রভাবও ব্যবহার করেন। অভিযোগ রয়েছে, অন্য বিভাগ থেকে কেউ দায়িত্বে এলেও তাদের স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে বাধা দিতেন তিনি।
২০২৫ সালের মাঝামাঝিতে প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর, ২০২৪ সালে আওয়ামী ঘরানার কর্মকর্তা পরিচয়ে তিনি আবারও ডিএসটিই-চট্টগ্রাম পদে ফেরত আসেন। একই সময়ে রেলের দুটি বৃহৎ প্রকল্পে তিনটি পদে থেকে প্রকল্প ও রুটিন কার্যক্রমে কেনাকাটা, মেরামতসহ নানা কাজে অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন।
দুদকসহ একাধিক নথিতে দেখা গেছে, প্রকল্পে নিম্নমানের কাজ, দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতা রয়েছে। ২৬ অক্টোবর দুদকের সহকারী পরিচালক ও অনুসন্ধান টিম লিডার মো. আবদুল মালেক রেল মহাপরিচালককে চিঠি দিয়ে প্রকল্পে মালপত্র ও যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের জন্য মোহাম্মদ সেলিমের জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্টের ছায়ালিপি, স্থায়ী ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর চেয়ে পাঠান।
চিঠিতে বলা হয়, প্রকল্পে মোহাম্মদ সেলিম ৫০ কোটি টাকার দুর্নীতি ও আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এজন্য প্রকল্পের বিভিন্ন নথিপত্র দুদকে জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। জানা গেছে, তিনি ২০১২ সালের ৩ জুন ৩০তম বিসিএসের মাধ্যমে রেলওয়েতে যোগদান করেন। রেলওয়ের আঁতুড়ঘর, পাহাড়তলীতে স্থায়ী ঠিকানা থাকা সত্ত্বেও তিনি দীর্ঘদিন ধরে নিজ এলাকায় দায়িত্ব পালন করছেন, যা সরকারি চাকরি বিধিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
বিভিন্ন অনিয়ম ও অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ৩ সেপ্টেম্বর তাকে চট্টগ্রামের বিভাগীয় সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী পদ থেকে বদলি করে সিআরবি-চট্টগ্রামে বিভাগীয় সংকেত প্রকৌশলী এবং অতিরিক্ত দায়িত্বে টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু বদলিকৃত পদে যোগ না দিয়ে মাত্র ১৩ দিনের মাথায়, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে, প্রভাব খাটিয়ে বদলি আদেশ বাতিল করান।
দুদক এরই মধ্যে দোহাজারী-কক্সবাজার প্রকল্পের ৯টি স্টেশনের সংকেত ও টেলিকম যন্ত্রাংশ ক্রয়ের দরপত্র, দরদাতাদের মূল্য তালিকা, গঠিত কমিটি ও প্রতিবেদন, দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও পরামর্শক নিয়োগ, সার-সংক্ষেপ, অনুমোদন, চুক্তি, অর্থ সংস্থান, পেমেন্ট এবং সংশ্লিষ্ট রেকর্ডের সত্যায়িত কপি চেয়ে পাঠিয়েছে। রেলওয়ের সংশ্লিষ্টদের মতে, এসব তথ্য পেলে প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রকৃত চিত্র স্পষ্ট হবে।
১৩ দিনের ব্যবধানে বদলি আদেশ বাতিলের বিষয়ে মোহাম্মদ সেলিম ‘কালবেলা’কে বলেন, প্রকল্পের কিছু অংশ নিয়ে অভিযোগ রয়েছে, তবে তদন্ত চলছে এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বিষয়টি দেখভাল করছে। তিনি দাবি করেন, এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি এবং তিনিও কোনো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন।
প্রকল্পের মেকানিক্যাল বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এখানে নিম্নমানের স্থানীয় মেকানিক্যাল পয়েন্ট মেশিন বসানো হয়েছে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ৯টি স্টেশনে ১৮টি মেকানিক্যাল পয়েন্ট বসানো হয়, যা স্থানীয় ঠিকাদার দিয়ে নির্মিত। এরই মধ্যে এসব যন্ত্রাংশে মরিচা ধরে নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সরেজমিন পরিদর্শনে এর প্রমাণ মিলেছে।
ব্লক কমিউনিকেশনের জন্য এক্সেল কাউন্টার স্থাপন করা হয়নি। চুক্তিতে রেলচাকা গণনার জন্য এ কাউন্টার ব্যবহার ও স্থাপন করার কথা থাকলেও, তা বাস্তবায়ন হয়নি। এতে যে কোনো সময় দুর্ঘটনার ঝুঁকি রয়েছে। এ ছাড়া, নিম্নমানের বন্ডিং ওয়্যার ব্যবহারের ফলে গত দুই বছরে ব্যবহৃত ক্যাকেল মরিচা পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এর ফলে ট্র্যাক সার্কিট কাজ না করায় সিগন্যাল সঠিকভাবে পৌঁছাচ্ছে না, ফলে ট্রেন চলাচলে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে।
সূত্র বলছে, দোহাজারী-কক্সবাজার প্রকল্পে অভ্যন্তরীণ তদন্তেও অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে। প্রকল্পের কাজ প্রায় শতভাগ শেষ হলেও বিভিন্ন স্টেশনের টেলিকম ও সিগন্যাল শাখায় ৪১টি অসংগতি শনাক্ত করেছেন অতিরিক্ত প্রধান সিগন্যাল ও টেলিকম প্রকৌশলী তারেক মো. শামস তুষার। তিনি বিষয়টি প্রকল্প পরিচালক, রেলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও সরকারি রেল পরিদর্শক বরাবর পাঠালেও আজ পর্যন্ত তা সংশোধন করা হয়নি। এতে করে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথের ট্রেন চলাচল মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে আশঙ্কা করছেন রেল সংশ্লিষ্টরা।
১০ ঘণ্টা আগে