তারেক রহমান ফেরার আগেই মাঠ গোছাতে চায় বিএনপি
বিএনপি এখন পুরোদমে নির্বাচনী মেজাজে। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে একদিকে ভোটের মাঠে চলছে জোর তৎপরতা, অন্যদিকে পর্দার আড়ালে ম্যারাথন বৈঠক। সব দিক সামলেই দলটি ক্ষমতার মসনদে ফেরার লড়াইয়ে নিজেদের প্রস্তুত করছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লক্ষ্য ধানের শীষের বিজয় নিশ্চিত করা। যার অংশ হিসেবে এখন ভোট সামনে রেখে এরই মধ্যে প্রাথমিকভাবে মনোনীত দলের সংসদ সদস্য (এমপি) প্রার্থীদের ডেকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ আগামী ২৫ ডিসেম্বর তারেক রহমান দেশে ফেরার আগেই নির্বাচন সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম গুছিয়ে নিচ্ছে বিএনপি। সেই লক্ষ্যে গতকাল বুধবার থেকে মনোনীত প্রার্থীদের সঙ্গে বৈঠক শুরু হয়েছে। প্রথম দিনে তিন বিভাগের ১০৭ জন এমপি প্রার্থীর সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয় দলের হাইকমান্ডের, যা আজ বৃহস্পতিবারও চলবে এবং শুক্রবার বিরতি দিয়ে শেষ হবে আগামী শনিবার। রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে শুরু হওয়া এই বৈঠকে দলের মহাসচিবসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সন্ধ্যায় প্রধান অতিথি হিসেবে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সমাপনী বক্তব্য দেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
দিনভর চলা এই বৈঠকে বিএনপির এমপি প্রার্থীদের ভোটের মাঠে করণীয় এবং প্রচার-প্রচারণা, মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ-পূরণ, জমাদানসহ বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। বিশেষ করে নির্বাচনে জিততে রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ দফা এবং জনসম্পৃক্ত অতিগুরুত্বপূর্ণ ৮ দফা নিয়ে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিএনপি রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলে পূর্বঘোষিত পরিকল্পনাগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সেসব বিষয়ে আরও সহজভাবে মানুষের মাঝে তুলে ধরতে বলা হয়েছে। সেইসঙ্গে মনোনীত প্রার্থীদের কাছ থেকে ৫৫ হাজার টাকা করে দলীয় মনোনয়ন ফি জমা নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ গতকাল শুরু হওয়া বৈঠকের মূল বার্তা হলো—তারেক রহমান দেশে ফেরার আগেই যেন প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় সাংগঠনিক শক্ত ভিত্তি তৈরি হয়, সে লক্ষ্যেই এই আগাম প্রস্তুতি। বৈঠকে তারেক রহমান বলেছেন, তিনি ধানের শীষ প্রতীকে মনোনীত প্রত্যেককেই সংসদ সদস্য হিসেবে দেখতে চান। আর এজন্য তিনি ফুলের মালা নিয়ে অপেক্ষায় থাকবেন। ধানের শীষের সবাইকে বিজয়ী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এ ছাড়া ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দলমত নির্বিশেষে সবাইকে কাজ করতে হবে। সবাইকে নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলে সরকার, নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করতে হবে। এক কথায়, নির্বাচনকে অর্থবহ করে তুলতে হবে এবং বিএনপির বিজয় নিশ্চিত করতে হবে। এ সময় উপস্থিত প্রার্থীরাও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের প্রত্যাশা পূরণে কাজ করছেন বলে জানান।
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের প্রচারে ভিন্নতা আনার কথা আগেই জানিয়েছে বিএনপি। সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ এমন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি বিশেষ কমিটিও গঠন করেছে দলটি। এরই মধ্যে নির্বাচন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গুলশানে নতুন অফিসও ভাড়া নেওয়া হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে গেছে, গতকাল সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে শুরু হওয়া বৈঠকে সংসদীয় আসন পঞ্চগড়-১ থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে ১০৭ জন প্রার্থীর সঙ্গে বৈঠক হয়। এতে অংশ নেওয়ারা ছিলেন রংপুর, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের। আজ এবং শনিবার পর্যায়ক্রমে অন্য প্রার্থীদের সঙ্গেও বৈঠক করবে বিএনপি। তার মধ্যে আজ বরিশাল, ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের প্রার্থীদের সঙ্গে বৈঠক হবে। কোরআন তিলাওয়াতের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া বৈঠকের মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিহউল্লাহ, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ বিষয়ক সহ-সম্পাদক নেওয়াজ হালিমা আর্লি ও নির্বাহী কমিটির সদস্য আব্দুস সাত্তার পাটোয়ারীর পরিচালনায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ড. মাহাদী আমিন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার, মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল এবং জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা রেহান আসাদ। এ ছাড়া নির্বাচনী প্রচার সংক্রান্ত বিষয়ে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য উপস্থাপন করেন জুবায়ের বাবু (প্রচার ব্র্যান্ডিং) ও জামাল হোসেন মজুমদার। সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ থেকে শুরু করে পূরণ ও জমাদান এবং আচরণবিধির বিষয়টি তত্ত্বাবধান করবেন নির্বাচন কমিশনের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব ড. মো. জকরিয়া।
বৈঠকে উপস্থিত থাকা একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপির আগামীর পরিকল্পনা ও প্রচার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অনেকে প্রশ্ন করেছেন, বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন। যেগুলো বিএনপির পরিকল্পনার মধ্যে নেই, সেই বিষয়গুলো নথিভুক্ত করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ মিডিয়াকে কীভাবে নির্বাচনী প্রচার কাজে ব্যবহার করা যাবে সেসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধে করণীয় বিষয়ে তুলে ধরা হয়। নির্বাচনে একজন প্রার্থী আচরণবিধিসহ সংশ্লিষ্ট বিধিমালা অনুসরণ ও সমালোচনার ঊর্ধ্বে কীভাবে থাকবেন সেসব বিষয় করণীয় তুলে ধরে নানা পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে এখনো ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। বিএনপির উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনাগুলো প্রচারের সময় প্রাধান্য দিয়ে সামনে নিয়ে আসতে হবে। ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবে।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক প্রার্থী জানান, গতকালের বৈঠকটি মূলত ছিল একটি কর্মশালা। সেখানে নির্বাচন সংক্রান্ত সার্বিক বিষয়ে প্রার্থীদের নির্দেশনা দেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষ ব্যক্তিরা। যেমন—নির্বাচনী এলাকার কেন্দ্র এবং আসনভিত্তিক ভোটারলিস্ট প্রার্থীরা কীভাবে ভোটারদের কাছে পাঠাবে বা প্রচার চালাবে সেসব বিষয়ে তুলে ধরে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বক্তব্য দেন।
জানা গেছে, ব্যাংকের ঋণ ও অন্যান্য আইনগত ঝামেলা আছে এমন প্রার্থীদের বিকল্প প্রার্থীও ঠিক করে রেখেছে বিএনপি। তবে খুবই সীমিত আসনে এ পরিবর্তন আসতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। অর্থাৎ মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ, পূরণ ও জমা দেওয়া থেকে শুরু করে জামানত ফিসহ সংশ্লিষ্ট সব কার্যক্রম সম্পন্ন করছে বিএনপি।
জানতে চাইলে গাইবান্ধা জেলা বিএনপির সভাপতি ও গাইবান্ধা-৩ আসনে দল মনোনীত এমপি প্রার্থী অধ্যাপক ডা. মাইনুল হোসেন সাদিক কালবেলাকে বলেন, ‘বৈঠকের মূল বিষয়বস্তু হলো নির্বাচন সামনে রেখে প্রার্থীদের করণীয়। বিশেষ করে নতুনভাবে ৮ দফা বা এইট পিলারকে সাধারণ মানুষ ও ভোটারদের কাছে আরও আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান চান ধানের শীষের সবাই এমপি হিসেবে নির্বাচিত হবেন।’
পঞ্চগড়-২ আসনে বিএনপি মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী ও জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ফরহাদ হোসেন আজাদ গতকাল সন্ধ্যায় কালবেলাকে বলেন, ‘ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বৈঠকটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৈঠকে মূলত বিএনপি মনোনীত প্রার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ভোটারসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার চালানো, বিএনপি ঘোষিত রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ দফা এবং জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত অতিগুরুত্বপূর্ণ ৮ দফা নিয়ে প্রচার চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ফ্যামিলি কার্ড, হেলথ কার্ড, কৃষক কার্ড, ইমাম-মুয়াজ্জিনের সম্মান, ক্রীড়া, যুবকদের কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও পরিবেশ বিষয়ে বিএনপির পরিকল্পনা তুলে ধরতে বলা হয়েছে।’
গাইবান্ধা-৫ আসনে দলটির মনোনীত প্রার্থী মো. ফারুক আলম সরকার বলেন, ‘১০৭ জন এমপি প্রার্থীকে ডেকে গুলশান কার্যালয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, জনগণের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ধানের শীষের প্রচার চালাতে হবে। জনগণের ভালোবাসা নিয়েই এমপি নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে। এ ছাড়া নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলাসহ দলের অন্যান্য কৌশল অবলম্বনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
১০ ঘণ্টা আগে