কালবেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ০৬ জুন ২০২৩, ০৫:৩৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

চার বন্ধুর সাইকেলে ৬১০ কিলোমিটার পাড়ি

লাল সবুজের পতাকা হাতে চার বন্ধু আরমান, মেহেদী, সাদিক ও বাঁধন।
লাল সবুজের পতাকা হাতে চার বন্ধু আরমান, মেহেদী, সাদিক ও বাঁধন।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পশুপালন অনুষদের চার শিক্ষার্থী আরমান, মেহেদী, সাদিক ও বাঁধন। ভ্রমণে যাদের নেশা ও ভয় করে না কোনো বাঁধা। বারবার বেরিয়ে পরে সাইকেল নিয়ে বহু দূরের গন্তব্যে। ঘুরতে ফিরতে যেন তারা সীমাহীন আনন্দ পায়। হঠাৎ চায়ের দোকানে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে তারা ঠিক করে এবার ক্রস কান্ট্রি ভ্রমণে যাবে। তাদের ক্রস কান্ট্রি চ্যালেঞ্জের গল্পটি তুলে ধরছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক রায়হান আবিদ।

প্রথম দিন : ময়মনসিংহের গোবড়াকুড়া বর্ডার থেকে রোমাঞ্চকর শুরু

যাত্রা শুরু হয় ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের গোবড়াকুড়া বর্ডার থেকে। ময়মনসিংহ শহর থেকে ৫৭ কি.মি দূরে অবস্থিত এই বাংলাদেশ-ভারতের বর্ডারটি। রাত ৯টায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হালুয়াঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা হই। হালুয়াঘাট বাজারে পৌঁছাই রাত দেড়টায়। সেখানে পৌঁছে রাতের খাবার খেয়ে বর্ডারের উদ্দেশ্যে রওনা হই। কারণ গোবড়াকুড়া বর্ডার থেকে তাদের ক্রস কান্ট্রি চ্যালেঞ্জ শুরু হবে। সেখানে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয় তারা। আহনাফ সাদিক সেদিনের ঘটনা বর্ণনাতে বলেন, বাংলাদেশ সীমানায় বিজিবি না থাকায় অজান্তেই আমরা সাইকেল নিয়ে বাংলাদেশ সীমানা ক্রস করে ইন্ডিয়া সীমান্তের কাছে ‘নো মেন্স ল্যান্ডে’ বা বাংলাদেশ-ভারতের মাঝে অনধিকৃত জায়গার মধ্য দিয়ে যাওয়া সড়কে গিয়ে অবস্থান করি। তখন প্রায় রাত ৩টা বাজে। সেখানে পরিবেশ খুব গোছানো, সড়কের দুই পাশে বাতি দেওয়া তবে একদম থমথমে। এতটাই থমথমে যে, কোনো কারণ ছাড়াই ভয় লাগতে শুরু হয়। হঠাৎ বিএসএফের সাইরেন বাজতে শুরু করল। তখন আমরা বুজতে পারলাম আমরা হয়তো ভুল সড়ক দিয়ে যাচ্ছি। হয়তো আমাদের সতর্ক করতেই এই সাইরেন বাজানো হয়েছিল। সাইরেনের আওয়াজ শুনে সে সময় বুকের ভেতরটা কেমন ধুকধুক করছিল। সত্যিই আমাদের খুব ভয় লাগছিল। আমরা সর্বোচ্চ গতিতে সাইকেল চালিয়ে আগের ১০০-১৫০ মিটার যাওয়ার পরে বাংলাদেশ জিরো পয়েন্ট লেখাটা দেখতে পাই। ময়মনসিংহ শহরে আসতে সকাল ৮টা বাজল। ময়মনসিংহে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে দুপুরে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হই। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে রং সাইডে বিপরীত দিক থেকে আসা অটো, সিএনজি, মোটর-সাইকেল। ময়মনসিংহ থেকে ত্রিশাল, ভালুকা হয়ে ঢাকা যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা করলেও গাজীপুর পর্যন্ত যেতেই রাত ১টা বাজল। ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের সামনে ছবি উঠানোর জন্য দাঁড়াই। সেখানে কয়েকজন পুলিশের (এসআই, কনস্টেবল) সাথে কিছুক্ষণের আড্ডায় মেতে উঠি আমরা। তাদের কাছ থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ছিনতাই, বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কথা শুনে সবারই ভয় লাগছিল। তারপর সিদ্ধান্ত নেই গাজীপুরে রাতে থাকব। তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেহেদীর বন্ধু শান্তর সাথে যোগাযোগ করে গাজীপুরে অবস্থান করলাম। তবে না বললেই নয় যে, শান্তর আতিথি আপ্যায়নে আমরা বেশ মুগ্ধ ।

দ্বিতীয় দিন : দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা ও পুলিশের দৌড়ানি

পরের দিন তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেলা ১১টায় মাওয়া ঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা হয় । ঢাকা যাওয়ার পথে বড় একটি দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পায় তারা। সেদিনের ঘটনা স্মরণ করে আরমান হাবিব বলেন, আমরা সাইকেলে করে মাওয়া ঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। সেদিন বড় একটা দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পায় মেহেদী। সম্রাট নামে ঢাকার এক লোকাল বাস মেহেদীর সাইকেলে পাশ থেকে ধাক্কা দেয়। ভাগ্যিস সে যাত্রায় বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। পেছন থেকে পুরো ঘটনা আমি দেখতেছিলাম। এ ঘটনায় মেহেদী আর আমি দুজনই বেশ ভয় পেয়েছিলাম। আমরা সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ বসলাম। সেখানে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যরা আমাদের কাছে আসল। আমাদের পরিচয় এবং সাইকেল ভ্রমণ সম্পর্কে বিস্তারিত শুনে তারা কিছুটা অবাক হলেন। পাশাপাশি জানালেন যে, সে-ও একজন অ্যাথলেট। খুব আন্তরিকতার সাথে আমাদের চা-নাস্তা করালেন। সেই সাথে জমল ৪০ মিনিটের আড্ডা। উনার থেকে আয়রনম্যান (রানিং+ সাইক্লিং+সুইমিং প্রতিযোগিতা) প্রতিযোগিতা সম্পর্কে আমাদের বললেন। ঢাকা থেকে বের হতে রাত ১০টা বাজল। ঢাকা-মাওয়া ৮ লেনের হাইওয়ে আমার দেখা বাংলাদেশের সেরা হাইওয়ে। কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে ছবি উঠানোর জন্য আমরা ট্রাইপড রাখছিলাম। এমন সময় একজন পুলিশ আমাদের ছবি তুলতে মানা করল। আমরা ট্রাইপড গুছিয়ে সেলফি তুলছিলাম। এতে ওই পুলিশ ক্ষেপে গিয়ে লাঠি নিয়ে দৌড়ে আসল। আমি ভাবতেছিলাম মনে হয় দু-এক ঘা বসাবে। এসে ধমকিয়ে ছবি ডিলেট করতে বলল। উনার কথায় তার সামনে ছবি ডিলেট করলাম। পরে মাওয়া ঘাটে পৌঁছাতে আমাদের রাত ৩টা বাজল। ট্রলার পরেরদিন সকাল ৮টায়। আশপাশে কোনো থাকার হোটেলও নাই। পরে মাওয়া ঘাটের ইলিশ খেয়ে হোটেলেই বসে বসে ঝিমালাম সকাল পর্যন্ত ।

সাগরকন্যা কুয়াকাটায় শূন্যে ভাসছে বাকৃবির পশুপালন অনুষদের চার শিক্ষার্থী আরমান, মেহেদী, সাদিক ও বাঁধন।

তৃতীয় দিন : ট্রলারে করে পদ্মা পার ও ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন

তৃতীয় দিনের শুরুটা হলো মাওয়া ঘাট থেকে বরিশালের উদ্দেশ্যে রওনা। প্রথমে তারা ট্রলারে করে পদ্মা নদী পার হয়। গুগল ম্যাপ দেখে হাঁটার সড়ক ধরে সাইকেলে যাচ্ছিল তারা। ঘটল এক রোমাঞ্চকর ঘটনা। সড়কটি তাদের সরিষা ক্ষেতে নিয়ে গেল। তাদের সামনে দেখতে পেল কয়েকটি বাড়ি। বাড়ির উঠানের সড়কটি ধরে হাইওয়েতে উঠে গেল তারা। যাত্রার তৃতীয় দিনের বর্ণনায় মেহেদী হাসান বলেন, চলে এলাম শরীয়তপুর হয়ে মাদারীপুর। মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলায় সাইকেল চালাচ্ছিলাম। আমাদের দেখে কয়েকজন আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল কোথা থেকে এসছি আমরা। আমাদের সাইকেল ভ্রমণের বর্ণনা শুনে খুব আন্তরিকতার সাথে চা-নাস্তার অনুরোধ করল। চা-নাস্তা শেষে গৌরনদীর উদ্দেশ্যে রওনা করলাম। কালকিনি থেকে আমরা ঢাকা-বরিশাল হাইওয়েতে উঠলাম। এই সম্পূর্ণ যাত্রার এটাই ছিল আমাদের সবচেয়ে ভয়ংকর পরিস্থিতি। এক লেনের ঢাকা-বরিশাল হাইওয়েতে ৮০-১০০ কি.মি বেগে চলা বাস, ওভারটেকিং, অন্ধকার রাত, আঁকাবাঁকা হাইওয়ে। প্রতিটা মুহূর্তে ভয়ানক পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছিলাম। ৮০ কি.মি বেগে বাস যখন ওভারটেকিং করছিল মনে হচ্ছিল যেন গা ঘেঁষে যাচ্ছিল। এমনও হয়েছে- সামনে থেকে বাস ওভারটেকিং করতে গিয়ে আমাদের মুখোমুখি, উপায় না পেয়ে সড়ক থেকে নিচে সাইকেল নামিয়ে দিতে হচ্ছিল। কালকিনি থেকে বরিশাল, প্রায় ৪৫ কি.মি পথ অতিক্রম করে ধানসিঁড়ি হোটেলে উঠি। পথটা দুঃস্বপ্নের মতো লাগছিল। এখানে হোটেল মালিকের চরম বাজে ব্যবহার আমাদের জন্য খুবই অপমানজনক ছিল। বরিশালে পৌঁছানোর পর একটা চমক অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। বাঁধনের এক বন্ধু আমাদের জন্য খাবার পাঠায় । সেই পরিস্থিতিতে বাড়ির খাবার যেন অমৃতের মতো লাগছিল।

চতুর্থ দিন : পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা

চতুর্থ দিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বাঁধন বলেন, তিন দিনের যাত্রার ক্লান্তি, পা ব্যথা ও শরীর ব্যথার কারণে আমরা সিদ্ধান্ত নেই চতুর্থ দিন সাইকেল কম রাইড করব। সেদিন দুপুরের খাওয়া শেষে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হই। আমরা জানতাম না বিশ্ববিদ্যালয়ে কার কাছে থাকব, তবে বিশ্বাস ছিল একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। অবশেষে মেহেদীর বন্ধু তন্ময়ের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের রকি, রিফাতের রুমে আমি আর সাদিক উঠলাম আর ২য় তলায় আরমান আর মেহেদী উঠল।

সাইকেলের ৬১০ কিলোমিটার পাড়ি দেন তাঁরা।

পঞ্চম ও শেষ দিন : গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো ও এক নতুন অভিজ্ঞতার গল্প

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের থেকে সকাল ৬টার দিকে কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় তারা। যেহেতু আগের দিন খুব বেশি সাইকেল চালায়নি তাই পঞ্চম দিনে গন্তব্যের বাকি থাকা ৮৫-৯০ কি.মি শেষ করার উদ্দেশ্যে বের হয় তারা। পথে খেজুরের রস খাওয়ার জন্য যে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তা ভুলার নয়। শেষ ৫০ কি.মি. বাতাস তাদের বিপরীতে আসছিল। সারাদিন সাইকেল চালিয়ে তারা রাত ৯টার দিকে কুয়াকাটা জিরো পয়েন্টে পৌঁছায়। গন্তব্যে পৌঁছানোর পরবর্তী অভিজ্ঞতা নিয়ে আহনাফ সাদিক বলেন, জিরো পয়েন্ট মাইলস্টোনে কুয়াকাটা লেখেটা কতটা ইমোশনাল ছিল আসলে ভাষায় বোঝাতে পারব না। আমাদের ক্রস কান্ট্রি ভ্রমণ শেষ হলো। স্ট্রাভা অ্যাপের হিসাব অনুযায়ী, ৬১০ কি.মি যাত্রা আমরা সাইকেলে করেছি। ৬১০ কি.মি. সাইকেল চালানোটা সত্যিই খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। ভিন্ন ভিন্ন মানুষের সাথে পরিচিত হয়েছি। কখনো ছিল ভীতিকর আবার ছিল আনন্দঘন। আশা করি, পরের বার আমরা সাইকেলে করে দেশের বাইরে যাব।

মো. রায়হান আবিদ শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পরীক্ষা শুরুর আগে হলেই কলেজছাত্রীর মৃত্যু

সীমান্তে ১১ বাংলাদেশিকে আটকের পরে ফেরত দিল বিএসএফ

বিস্ফোরণ মামলায় ফখরুলসহ ৬৫ জনকে অব্যাহতি

রাঙামাটিতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে দুদকের অভিযান

আর্জেন্টিনায় ম্যাচ চলাকালে সমর্থকদের তুমুল মারামারি

আশুলিয়ায় নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা জুয়েল গ্রেপ্তার

৬০০ কোটি আয় ছাড়াল রজনীকান্তের ‘কুলি’

শেখ হাসিনার বিচার চেয়ে ট্রাইব্যুনালে সাইদীর মামলার সাক্ষী সুখরঞ্জন বালি

গাজীপুরে সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

জাতিসংঘের প্রতিবেদন নিয়ে নির্দেশনা দিলেন হাইকোর্ট

১০

ডাকসু নির্বাচনে ব্যালট পেপারে প্রার্থীদের ছবি যুক্তের দাবি ছাত্র অধিকার পরিষদের

১১

ভারতের জন্য আকাশসীমা বন্ধের মেয়াদ আরও বাড়াল পাকিস্তান

১২

র‌্যাঙ্কিংয়ে উধাও রোহিত-কোহলির নাম, কারণ জানাল আইসিসি

১৩

রাজসাক্ষী হতে চান পুলিশ সদস্য শেখ আফজালুল

১৪

ভাঙন ভাঙন খেলায় দিশেহারা নদীপাড়ের মানুষ

১৫

চালককে ওয়াশরুমে রেখে প্রাইভেটকার নিয়ে ছুটছিলেন তিন বন্ধু

১৬

নথি গায়েব করে ১৪৬ কোটি টাকার কর ফাঁকি / কর কমিশনার মো. মুস্তাকসহ ৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করছে দুদক

১৭

‎আশাশুনি সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের স্থায়ী ভবন নির্মাণে জরুরি আলোচনাসভা

১৮

দেবের প্রশংসায় ইধিকা

১৯

গ্যাসের ব্যথা ভেবে হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ নিয়ে ঘুরছেন না তো?

২০
X