চালের বাজার হঠাৎ অস্থির
প্রতি বছর রমজান এলে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকলেও চালের বাজার স্থিতিশীল থাকে। তবে এবারের চিত্র ভিন্ন। এবার নিত্যপণ্যের দামে এমনিতেই সাধারণ মানুষের দিশেহারা অবস্থা, তার ওপর কয়েকদিন ধরে বাড়তে শুরু করেছে সব শ্রেণির চালের দাম। শস্যভান্ডার খ্যাত দিনাজপুর ও নওগাঁ এবং কুষ্টিয়ার মোকামগুলোতে সপ্তাহের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ২ থেকে ৪ টাকা। চরম মূল্যস্ফীতির এই বাজারে হঠাৎ চালের দাম বাড়ায় দুশ্চিন্তা ভর করেছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের ক্রেতাদের ওপর। এদিকে হঠাৎ চালের বাজার অস্থির হওয়ার পেছনে ধান সংকটকে দায়ী করছেন মিলাররা। আগামীতে চালের দাম আরও বাড়তে পারে বলে হুঁশিয়ারি তাদের। অন্যদিকে বিশ্লেষকরা চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের পাশাপাশি চালের আমদানি বাড়ানোর কথা বলেছেন। বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন কুষ্টিয়া শাখার সভাপতি ওমর ফারুক জানান, সরু চালের জন্য প্রসিদ্ধ কুষ্টিয়ার মোকামে ধানের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। যার কারণে চালের দাম কেজিতে ২-৪ টাকা বেড়েছে। প্রায় সবরকম চালই বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। এর কারণে মোকামে উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। বেচাকেনাও হচ্ছে না তেমন একটা। তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বার রমজানে চালের দাম খুব একটা বাড়ে না। কিন্তু এবারই চালের দাম বেড়েছে। বাজারে ধানের সংকট থাকায় এমনটি হয়েছে।’ কুষ্টিয়া পৌর বাজারের বিক্রেতা রঞ্জুর হোসেন নিশান জানান, তার দোকানে আগের চেয়ে বেচাকেনা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ক্রেতারা দোকানে আসছেন না। আবার মোকামে গিয়েও চাল আগের মতো পাচ্ছেন না। পেলেও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। ধানের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে বলেই চালের দাম বাড়িয়েছেন মিলাররা। এই বিক্রেতা বলেন, আগে যেখানে মিনিকেট (সরু) চাল ৬৪ টাকা কেজিতে বিক্রি করেছি, সেই চাল সপ্তাহ ব্যবধানে বিক্রি করতে হচ্ছে ৬৮ টাকা কেজিতে। একই অবস্থা কাজললতা, আটাশ, বাঁশমতিসহ অন্যান্য চালেও। কাজললতা ৫৮ টাকা থেকে বেড়ে ৬২ টাকা, বাঁশমতি ৭৪ টাকা থেকে বেড়ে ৭৮ টাকা এবং আটাশ চাল ৪৯ টাকা থেকে বেড়ে ৫৪ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। রমজানের শুরুতেই চালের বাজার অস্থির বলে জানান তিনি। চালকল মালিকরা জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে ধানের ভীষণ সংকট। বেশি দামেও ধান মিলছে না। কারণ কৃষকের গোলায় ধান নেই। এ বিষয়ে খাজানগরের দেশ এ্যাগ্রো ফুডের স্বত্বাধিকারী এমএ খালেক জানান, তারা বেশি দাম দিয়েও ধান কিনতে পারছেন না। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বড় করপোরেট ব্যবসায়ীরা বাজার কিংবা কৃষক পর্যায় থেকে অধিকাংশ ধানই কিনে রেখেছেন। তাই আমাদের মতো ক্ষুদ্র মিলাররা ধানের সংকটে পড়েছেন। তিনি বলেন, সপ্তাহ দু-এক আগেও যে ধান প্রতি মণ ১৬শ ৫০ টাকায় কিনেছি, সেই ধান এখন প্রায় ১৮শ টাকায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাজারে ধান নেই বললেই চলে। এভাবে চলতে থাকলে এখানকার অধিকাংশ চালকল বন্ধের উপক্রম হয়ে পড়বে। একই সঙ্গে আগামী বৈশাখ মাসের আগে অর্থাৎ নতুন ধান না উঠলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সুযোগ নেই। কুষ্টিয়া জেলা চালকল মালিক সমিতির একাংশের সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন প্রধান বলেন, মূলত তৃতীয় রমজানের পর থেকে চালের বাজার বৃদ্ধি পেয়েছে। ধান সংকটের কারণে চালের দাম বেড়েছে। তবে ঈদের পর নতুন ধান উঠলে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি। অর্থনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. আলমগীর হোসেন ভূইয়ার মতে, দেশে সম্প্রতি অনেক করপোরেট ব্যবসায়ী চাল ব্যবসায়ে ঝুঁকেছেন। চাল উৎপাদনে প্রচুর ধান প্রয়োজন তাদের। তাই বাজারের অধিকাংশ ধান তারা কিনে গুদামজাত করছেন। যার কারণে কুষ্টিয়ার মতো ছোট ছোট মিলার ধান সংকটে ভুগছেন। এতে করে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বড় বড় মিলার কারসাজির সুযোগ পাচ্ছেন। তবে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে চালের আমদানির বিকল্প নেই দাবি এই অর্থনীতি বিশ্লেষকের। তিনি বলেন, চালের আমদানি শুরু হলে বাজার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। একই সঙ্গে বাজার তদারকিতে সরকারি সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের খাদ্যভান্ডার দিনাজপুরে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৪ টাকা। এক সপ্তাহ আগে মিনিকেট চাল ৬৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়। গুটি স্বর্ণ গত সপ্তাহে ছিল ৪৫ টাকা। বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ টাকা। ২৮ চাল সপ্তাহের ব্যবধানে ৫৪ টাকা থেকে বেড়ে ৫৮ টাকা হয়েছে। ২৯ চাল ৪ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫৬ টাকায়। দিনাজপুরের সবচেয়ে বড় চালের বাজার বাহাদুর বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী রঞ্জিত বলেন, দিনাজপুরে চালের দাম একবার বাড়লে আর কখনোই কমে না। বাজার মনিটরিং না থাকায় চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। চাল কিনতে আসা জহুরুল জানান, সারা দিন অটো চালিয়ে যা আয় রোজগার করেন, তা দিয়ে কোনোমতে সংসার চলে। হঠাৎ করে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় তিনি বিপাকে পড়েছেন। দিনাজপুর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি হুমায়ুন রেজা শামীম বলেন, দিনাজপুরের হাটবাজারে চালের সরবরাহ নেই। মিল মালিকরা চাল কিনতে পারছেন না। সামনে ইরি ধান উঠলে চালের দাম কিছুটা কমবে। ধান না উঠা পর্যন্ত দাম কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। আরেক খাদ্যশস্য ভান্ডার হিসেবে খ্যাত নওগাঁ জেলাতেও বেড়েছে চালের দাম। ১০-১৫ দিনের ব্যবধানে পাইকারি মোকামে প্রকারভেদে কেজিতে ২-৩ টাকা বেড়েছে। তবে খুচরা বাজারে দাম স্থিতিশীল রয়েছে। প্রতি বছর এই সময়ে ধান এবং চালের বাজার ঊর্ধ্বগতি হয়। আমন মৌসুমে ধান কাটা-মাড়াই অনেক আগেই শেষ হয়েছে। বড় জোতদার কৃষকদের ঘরে কিছু ধান রয়েছে। হাট-বাজারে ধানের সরবরাহ কম হওয়ায় প্রতি মণ ধানে বেড়েছে ১০০-১৫০ টাকা। স্বর্ণা-৫ জাতের ধান বিক্রি হচ্ছে মনে ১ হাজার ৪০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৪৩০ টাকা। ধানের দাম বাড়ার অজুহাতে এর প্রভাব পড়েছে চালের বাজারেও। পাইকারি মোকামে প্রকারভেদে প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) দাম বেড়েছে ১০০-১৫০ টাকা। ১০-১৫ দিনের ব্যবধানে প্রকারভেদে প্রতি কেজিতে ২-৩ টাকা বেড়ে স্বর্ণা-৫ চাল ৫০-৫২ টাকা কেজি, জিরাশাইল ৬৪-৬৬ টাকা এবং কাটারিভোগ ৬৮-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবারে স্বর্ণা চাল কিনতে গিয়েছিলেন শহরের লাটা পাড়ার অটোরিকশাচালক জালাল। বাজারে গিয়ে কেজিপ্রতি দুই টাকা করে বেশি কিনতে হয়েছে তাকে। ক্ষোভ নিয়ে কালবেলাকে তিনি বলেন, এমনিতেই চিকন চাল আমাদের মতো গরিবরা কিনতে পারি না। মোটা চাল কিনে খেতে হয়। তার ওপর এই রোজার সময়ে চালের দাম বাড়ানো ঠিক হয়নি। নওগাঁ চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, ১০-১৫ দিন আগে ২-৩ টাকা বেড়েছে চালের দাম। বর্তমানে চালের বাজার স্থিতিশীল আছে। পাইকারি বাজারে দাম বাড়লে খুচরা বাজারেও প্রভাব পড়বে এটাই স্বাভাবিক। তিনি আরও বলেন, আর এক মাসের মধ্যে ধান কাটা-মাড়াই শুরু হতে পারে। নতুন ধান বাজারে এলে চালের দাম স্বাভাবিক হবে। এ প্রসঙ্গে নওগাঁর জেলা প্রশাসক মো. গোলাম মওলা কালবেলাকে বলেন, এর আগে চালের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় আমরা অভিযান চালিয়েছিলাম। সে সময় বড় বড় প্রতিষ্ঠানেও অভিযান চালিয়েছি। ভোক্তাদের জন্য আমাদের সবসময় চেষ্টা থাকবে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার। এই জন্য মিল মালিকদের ডাকা হয়েছে। তাদের নিয়ে সভা করব। তারপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
২৫ মার্চ, ২০২৪
X