পরিবার পরিকল্পনায় জনবল নিয়োগ নিয়ে অস্থিরতা
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মী সংকট দীর্ঘদিনের। চার বছর আগে শূন্যপদে লোকবল নিয়োগের জন্য ছাড়পত্র দেয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। ৪১ ক্যাটাগরিতে ৮ হাজার জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি করে অধিদপ্তর। করোনা মহামারি নিয়োগ প্রক্রিয়া কিছুটা বাধাগ্রস্ত করে। এরই মধ্যে দেশের ৬২ জেলায় নিয়োগ কার্যক্রম শেষ হয়েছে। ২০২০ সালে কয়েকটি পদের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। এরপর চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি ২৬ ক্যাটাগরির লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়। এতে ৯৬ হাজার আবেদনকারীর মধ্যে প্রায় ১৯ হাজার নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেন। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা (প্রশিক্ষণার্থী) পদে নিয়োগ পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। প্রায় ৩ লাখ ৩১ হাজার আবেদনকারীদের মধ্যে ১ লাখ ৩৩ হাজার আবেদনকারী পরীক্ষায় অংশ নেন। পরীক্ষাটি দেশের ৪৬টি জেলায় একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। প্রশ্ন প্রণয়ন থেকে ফল প্রকাশ, প্রতিটি ধাপে স্বচ্ছতা অনুসরণ করা হয়। নিয়োগ পরীক্ষার আগে দুই স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে প্রশ্নপত্র জেলা প্রশাসকদের কাছে পাঠানো হয়। এরপর জেলা পর্যায়ের (পরিবার পরিকল্পনা) উপপরিচালকদের সহায়তায় জেলা প্রশাসকরা অভিযোগহীনভাবে পরীক্ষা গ্রহণ করেন। এখানেই শেষ নয়। পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদে পাঠানো হয়। পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা (প্রশিক্ষণার্থী) মূলত ১৫ বেতন গ্রেডের একটি পদ। ইউনিয়ন পর্যায়ের এসএসসি পাস করলে এ পদে আবেদন করা যায়। চাকরিপ্রত্যাশী নারীদের কাছে এ পদের বেশ কদর রয়েছে। চাকরির পাশাপাশি গর্ভকালীন সেবা প্রদান করে বাড়তি আয়ের সুযোগ রয়েছে। আগ্রহের আরেক কারণ বিয়ে-পরবর্তী সময়ে সন্তান পরিজনের সঙ্গে থেকে স্থায়ী আয়ের পথ সুগম হবে। অভিযোগ রয়েছে, এই সুযোগে চাকরির প্রলোভন দিয়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। সেখানে এক শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ক্ষমতাসীন দলের মাঝারি মানের কয়েকজন নেতা এবং স্থানীয় একটি সিন্ডিকেটের নাম উঠে এসেছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত স্বচ্ছ পরীক্ষা পদ্ধতির কারণে নিজেদের পছন্দের লোক নিয়োগে ব্যর্থ হয়ে চক্রটি পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা পদের নিয়োগ বাতিলের দাবি তুলছে। যদিও এই চক্রের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করে নিয়োগ বন্ধ করার কোনো কারণ খুঁজে পায়নি তদন্তকারী দল। অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের বিভাগীয় নির্বাচন কমিটিতে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং সরকারি কর্ম কমিশনের প্রতিনিধির পদ অল্প সময়ে পরিবর্তন হয়। এরপর নতুন প্রতিনিধি কমিটিতে যোগদানের জন্য মনোনীত হয়। তখন স্বার্থান্বেষী একটি মহল নতুন প্রতিনিধিকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করে। একই কাজ বর্তমান স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ সচিব মো. আজিজুর রহমান যোগদানের পর করা হয়। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ সচিব বিষয়টি উপলব্ধি করে অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে সঙ্গে নিয়ে লিখিত পরীক্ষা-পরবর্তী কাজগুলো দ্রুত শেষ করেন। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা (প্রশিক্ষণার্থী) পদে নিয়োগ পরীক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে একটি গ্রুপের আগ্রহ দেখে সন্দেহ হয় অধিদপ্তরের। তাই জেলা পর্যায় থেকে পাঠানো উত্তরপত্রগুলো ফার্মেসি অনুষদে সংরক্ষিত রুমে আলাদা দুটি তালা দেন স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব এবং অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। একটি চাবি সংরক্ষিত হয় মহাপরিচালকের কাছে। অন্যটি ঢাবির ফার্মেসি অনুষদের ডিনের কাছে। রুমের নজরদারিতে স্থাপন করা হয় সিসিটিভি ক্যামেরা। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে গত ২ মার্চ পর্যন্ত ১ লাখ ৩৩ হাজার উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয়। এ সময় প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে মহাপরিচালক নিজে উপস্থিত হয়ে কিংবা তার প্রতিনিধি হিসেবে পরিচালক (অর্থ) এবং পরিচালককে (আইইএম) উপস্থিত রেখে উত্তরপত্র সংরক্ষণ এবং মূল্যায়ন কক্ষের সিলগালাকৃত ডাবল লক খোলা এবং আবদ্ধ করা হয়। এরপর স্ক্যানিং সম্পন্ন করার চার দিনই পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের বিভাগীয় নির্বাচন কমিটির সদস্যরা, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, সরকারি কর্ম কমিশনের প্রতিনিধি এবং কারিগরি সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল ও এটুআই প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। ফলাফল স্ক্যানিং শেষে ফার্মেসি অনুষদের ডিন একসেট ফলাফল প্রিন্ট করে এবং সফট কপি একটি পেনড্রাইভে করে সিলগালাকৃত অবস্থায় অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে হস্তান্তর করেন। সেইসঙ্গে ফলাফল সংরক্ষণের স্বার্থে এক কপি ফার্মেসি অনুষদের কম্পিউটারেও রাখা হয়। ফলে স্বার্থান্বেষী মহলটি স্বার্থ উদ্ধারে ব্যর্থ হয়। তারা চেয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদে যখন উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয়, তখন যেন তাদের পছন্দের কয়েকজন প্রার্থীর নাম তালিকার শীর্ষে রাখা হয়। কারণ, তারা এরই মধ্যে চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। এরপরও চাকরি পাইয়ে দিতে ব্যর্থ হলে বেকায়দায় পড়তে হবে। হয় অর্থ ফেরত দিতে হবে, নয়তো প্রতারণা মামলার আসামি হতে হবে। তাই নিয়োগ কার্যক্রম বাতিল করতে মাঠে নামা হয়। সেইসঙ্গে তাদের যারা সহায়তা করেনি, তাদের সামাজিকভাবে হেনস্তা করা হয়। গত ১৯ মে স্বার্থান্বেষী মহল একটি সংবাদ সম্মেলেনের আয়োজন করে। সেখানে আইন ও মানবাধিকার সুরক্ষা ফাউন্ডেশন এবং তার উপদেষ্টা ড. সুফি সাগর সামসের নাম উঠে আসে। অধিদপ্তর সূত্র জানায়, মূলত ড. সুফি সাগর সামসের পেছনে রয়েছেন কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা এবং একজন কর্মচারী নেতা। সম্প্রতি তিনি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। তিনিই মূলত মাঠ পর্যায় থেকে অর্থ সংগ্রহ, তার বিতরণ এবং সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করে আসছেন। যারা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ইতোপূর্বে সংঘটিত সব নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছেন, তাদের রয়েছে মাঠ পর্যায়ে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। ফলে একটি চাকরি পাওয়ার আশায় জমিজমাসহ সব মূল্যবান সম্পদ বিক্রি করে নিঃস্ব হওয়ার পথে হাজার হাজার পরিবার। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা কালবেলাকে জানান, এরই মধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. হেলাল উদ্দিন এবং এ কে এম নূরুন্নবী কবির ও উপসচিব মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিনের সমন্বয়ে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির মাধ্যমে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। তদন্তে অভিযোগটির পক্ষে কোনো ধরনের সত্যতা না পেয়ে বিষয়টি নথিভুক্ত করা হয়।
০৮ জুন, ২০২৩
X