এত একই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়
দেশে আরও দুটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে এবং দুটিই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নারায়ণগঞ্জ; হবে নারায়ণগঞ্জে। আর সাতক্ষীরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হবে সাতক্ষীরায়। গত সোমবার এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য পৃথক দুটি আইনের খসড়া অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা।
বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও নেই, কিন্তু দেশে বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছেই। সরকারি উদ্যোগে হচ্ছে, প্রাইভেটও হচ্ছে এবং এভাবে সংখ্যাটা একশ ছাড়িয়ে গেছে। বেসরকারিগুলো যদি হয় বাণিজ্যিক কারখানা, তাহলে সরকারিগুলো দুর্নীতি আর অনিয়মের আখড়া। স্বায়ত্তশাসন থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের প্রয়োজনে নিয়ম তৈরি করতে পারে। এরই অপব্যবহার করার প্রবণতা আবার ভয়ংকর রূপ নিয়েছে।
সেশনজট, শিক্ষার্থীদের ন্যূনতম সুবিধা না থাকা আর শিক্ষক নিয়োগে উপাচার্যদের স্বজনপ্রীতি, দলপ্রীতি ও দুর্নীতি এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে যে, মানুষ এখন তাদের ঘৃণা করতে শুরু করেছে। উপাচার্যরা আর্থিক দুর্নীতি করছেন, পারলে পরিবারের সবচেয়ে দূরতম সদস্যকেও নিয়ম ভঙ্গ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দিয়ে দিচ্ছেন, বিলাসবহুল বাংলো থাকার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বাড়ি ভাড়া ভাতা গ্রহণের মতো গর্হিত কাজ করে যাচ্ছেন অবলীলায়। আরও যেসব অভিযোগ আসছে সেগুলো হলো—বিধিবহির্ভূতভাবে এক গ্রেডভুক্ত কর্মকর্তাকে আরেক গ্রেড প্রদান, অনিয়ম করে পদোন্নতি ও স্কেল প্রদান, যোগদানের তারিখ থেকে পদোন্নতি, অননুমোদিত পদে নিয়োগ, অনেককে তাদের অনর্জিত ইনক্রিমেন্ট প্রদান, আপগ্রেডেশন ও বেতন প্রদানের অনিয়মসহ এমনসব কীর্তি হচ্ছে, যা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসব ঘটছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মানে কি শুধুই উপাচার্যদের অবাক করা সব কাণ্ড এবং আর্থিক অনিয়ম, নাকি তার চেয়েও বেশি কিছু? গবেষণার নামে চৌর্যবৃত্তি এখন নিয়মিত ঘটনা। দেশের সবচেয়ে বড় এবং জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এসব আলোচনা এখন নিয়মিত, যা সবাইকে হতাশ করে। এখানে যারা পড়েছেন, এখনো পড়ছেন, এখানে যেসব শিক্ষক এখনো শিক্ষা ও জ্ঞানের চর্চায় নিবেদিত তাদের সবার জন্যই এমন সব খবর বেদনার। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি বিদ্যা অর্জন করেছি, সাধ্যমতো সে বিদ্যা সমাজের জন্য কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছি, সে বিশ্ববিদ্যালয় আজ আমার কাছে এমনভাবে উপস্থিত হবে, সেটা ভাবতে কষ্ট হয়।
একদিকে আধিপত্য সংস্কৃতির ছাত্ররাজনীতি যার কারণে পদে পদে মেধাবী নিরীহ পড়ুয়ারা লাঞ্ছিত হচ্ছে, অন্যদিকে কদর্য শিক্ষক রাজনীতির কারণে নৈতিকতা বলতে কিছু আর নেই ক্যাম্পাসগুলোতে। দলভিত্তিক রাজনীতির বাইরে শিক্ষকদের আর কোনো পরিচয় নেই। সমস্যাটা শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে। প্রথম শ্রেণি পেলে শিক্ষক হওয়া যাবে, এই এক দর্শন পুরো সিস্টেমকে নষ্ট করেছে। এখন শিক্ষক নিয়োগ যতটা হয়, তার চেয়ে বেশি হয় ভোটার নিয়োগ। একবার শিক্ষক হয়ে গেলে আর কোনো ভাবনা নেই। গবেষণা, প্রশিক্ষণ ছাড়াই শুধু দলবাজি করে পদোন্নতি, পদ-পদবি পাওয়া যায়। এ পদ্ধতিকে অযাচার বলা যায় কি না, সেটা শিক্ষকরা নিজেরাই ভেবে দেখতে পারেন।
একজন উপাচার্য থাকেন যিনি সবকিছুর প্রধান। উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য একজন থাকেন ঠিকই। তার ভূমিকা একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা। কিন্তু আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য শুধু প্রশাসনিক প্রধান নন, তিনি নিজ নিজ ক্যাম্পাসে সরকারি রাজনীতিরও প্রধান। তিনি শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগেরও কর্ণধার।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনই বলছে যে, নজিরবিহীনভাবে অনেক উপাচার্য বেতনের বাইরে নানা নামে অতিরিক্ত অর্থগ্রহণ করে থাকেন। অনেক শিক্ষক এর জন্য গবেষণা, মোবাইল-টেলিফোন-ইন্টারনেট ভাতা গ্রহণ করছেন, কিন্তু গবেষণার কোনো খোঁজ নেই। কেউ কেউ লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে নিয়মের বাইরে বই-ভাতা গ্রহণ করছেন, কিন্তু তার কোনো প্রতিফলন নেই। অনেক কর্মকর্তা তাদের ড্রাইভারদের দিচ্ছেন নবম থেকে পঞ্চম গ্রেডের বেতন। দেখা গেছে, গবেষণা কিংবা অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক প্রতিষ্ঠানে কোনো ব্যয় হয়নি; তবু বেড়ে গেছে তাদের বরাদ্দ। বাস্তবতা এটাই যে, এখন প্রশ্ন হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কি জ্ঞানের আলো ছড়ায়, নাকি নিজেই অন্ধকারে নিমজ্জিত? শুরুতেই উল্লেখ করেছি যে আরও দুটি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। ঢাকার বাইরের জেলায় প্রান্তিক এলাকায় একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। স্থানীয় জনগণকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দিতে সরকারের উদ্যোগ কতটা কাজ লাগছে সেটা নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের হলে জায়গা হয় না, তাই বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও এর আশপাশের এলাকায় বসবাস করতে হয়; কিন্তু তাদের কোনো নিরাপত্তা নেই। এ অবস্থা আমরা চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও দেখেছি। যেখানে আশপাশের গ্রামে ধর্মান্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী চক্র শক্ত ঘাঁটি গড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তথা খোদ বিশ্ববিদ্যালয়কেই জিম্মি করে আতঙ্কের মধ্যে রাখত একসময়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনোটায় শিক্ষক কাঁচি নিয়ে ছোটেন ছাত্রদের চুল কাটতে, কোনোটায় উপাচার্য তার পরিবারের সবাইকে শিক্ষক বা অফিসার বানিয়ে ফেলেন, কেউ ঢাকায় বসে রিমোট কন্ট্রোলে ক্যাম্পাস পরিচালনা করেন। মন্ত্রী, এমপি, আমলা বা প্রভাবশালীরা নিজ নিজ এলাকায় একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন বাগিয়ে স্থানীয় মানুষের বাহবা পাচ্ছেন। কিন্তু এগুলোতে সুস্থ, স্বাভাবিক জ্ঞানের চর্চা, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক চর্চা, উদারতার চর্চা কতটুকু হচ্ছে সে নিয়ে কোনো ভাবনা নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই, রাজশাহীসহ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জাতির ক্রান্তিলগ্নে, গণআন্দোলনে বড় ভূমিকা রেখেছে। এ কথা বলতেই হয় যে, এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক অর্জন যতটা আছে, ততটা কি আছে একাডেমিক অর্জন? এখন মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়কে, উপাচার্য আর শিক্ষকদের সম্মানের সঙ্গে দেখে না।
পেছন ফিরে তাকালে মনে হয় এ অবহেলা এবং অপমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও তাদের অধ্যাপকদের প্রাপ্য ছিল না। কিন্তু সেটাই তারা অর্জন করেছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজের পরিবেশ নেই, জানার পরিবেশ নেই, ক্যাম্পাসে গণতন্ত্র চর্চা নেই, মুক্তমতের জায়গা নেই এবং অবকাঠামোও সেভাবে নেই। বেশিরভাগের একটি নির্মোহ মূল্যায়ন করলে মনে হবে এগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় না করলে ভালো হতো। বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা যায় না, বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে হয়। সেই হয়ে ওঠাটাই হচ্ছে না। নতুনগুলো তো হলোই না, পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের মর্যাদা হারিয়েছে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাটাই আজ উপেক্ষিত, শিক্ষার পরিবেশে ভয়ানক দুর্দশা চলছে।
বিদ্যাচর্চা সেখানেই বিকশিত হয় যেখানে শিক্ষক-গবেষকরা স্বাধীনভাবে পাঠ্য, পাঠক্রম, মূল্যায়ন ঠিক করতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সহায়কের ভূমিকায় থাকে। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কর্মকাণ্ড তথা নীতি-নৈতিকতা এখন ব্যাপক আলোচিত। উপাচার্যদের দুর্নীতি কতটা প্রমাণ করা যাবে বা যাবে না, সে বিষয়ে তর্ক বৃথা। বৃহত্তর নৈতিকতার দাবি বলবে, শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রদের সম্পর্ক শুধু আইনি সূত্রে বাঁধা নয়, এটি আত্মার সম্পর্ক।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্য নির্ভর করে শিক্ষকদের তৈরি পাঠ্যক্রমের ওপর। আমাদের এখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সেই ব্রত কম। অনেকেই আছেন ক্লাস আর পরীক্ষা কার্যক্রমে নিয়মিত অংশ নেন না। কিন্তু তাদের কিছু বলা যায় না। এমন শিক্ষকের কথা শুনেছি একটি কোর্সে মাত্র তিন দিন ক্লাসে গেছেন এবং তাও পুরো সময় শ্রেণিকক্ষে থাকেননি। কোনো ভালো পাবলিকেশন ছাড়া অধ্যাপক হয়েছেন, এমন সংখ্যা ভূরি ভূরি। শিক্ষকতার পাশাপাশি ব্যবসা বা অন্য জায়গায় ফুলটাইম চাকরি করছেন এমন নজিরও আছে। গবেষণার কথা বললেই শিক্ষকরা বলেন বরাদ্দ কম। কিন্তু কম বরাদ্দকেও কতটা কাজে লাগানো যায়, সে চেষ্টাটুকুও চোখে পড়ে না।
সরকার আসে সরকার যায়। চিরন্তন থেকে যায় শিক্ষক-গবেষকের আজন্মলালিত মূল্যবোধ। তার অবক্ষয় রোধ করার একমাত্র পথ সম্পূর্ণ পেশাদারি উপায়ে পুরস্কার ও তিরস্কার নীতি গ্রহণ করা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কি তা হবে?
লেখক : প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন
০৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩