শিক্ষানীতি সংশোধন না হলে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি হেফাজতের
বিবর্তনবাদ ও ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুর মতো ইসলামবিরোধী সব পাঠ্য সিলেবাস থেকে অপসারণসহ শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের দাবি জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। দ্রুততম সময়ের মধ্যে শিক্ষানীতি সংশোধন না করলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন সংগঠনের নেতারা। একই সঙ্গে সাত দফা তুলে ধরে তা বাস্তবায়ন এবং নেতাদের বিরুদ্ধে সব মামলা বাতিলের দাবি জানায় হেফাজত। গতকাল রোববার ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে (আইডিইবি) জাতীয় শিক্ষা সেমিনারে হেফাজত নেতারা এসব দাবি জানান। হেফাজতের আমির আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর সভাপতিত্বে সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন হেফাজতের নায়েবে আমির ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। হেফাজতের আমিরের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী। মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, আতাউল্লাহ আমীন ও মুফতি কিফায়াতুল্লাহ আজহারীর সঞ্চালনায় প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করেন হেফাজতের সিনিয়র নায়েবে আমির খলিল আহমাদ কাসেমী, নায়েবে আমির সালাহ উদ্দীন নানুপুরী, মুফতি জসিম উদ্দীন, মাওলানা মাহফুজুল হক, মাওলানা মুহিউদ্দিন রাব্বানী, মাওলানা মোবারকুল্লাহ, আহমাদ আলী কাসেমী, খোরশেদ আলম কাসেমী, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি, মাওলানা মীর ইদরিস, মাওলানা জালালুদ্দীন, মুফতি হারুন বিন ইজহার, সহকারী মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হুসাইন রাজী, মাওলানা আতাউল্লাহ আমিন, সাংগঠনিক সম্পাদক মুফতি বশিরুল্লাহ, অর্থ সম্পাদক মুনির হুসাইন কাসেমী, গবেষক ও শিক্ষক ড. আসিফ মাহতাব, ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, মাওলানা জাবের কাসেমী, মাওলানা এনামুল হক মূসা প্রমুখ। লিখিত বক্তব্যে মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, জাতীয় পাঠ্যবই নিয়ে একের পর এক বিতর্ক হচ্ছে। কোনো জাতিকে পরাজিত করতে হলে সেই জাতির শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করাই যথেষ্ট। ধর্মপ্রাণ মুসলিম হিসেবে সন্তানদের গড়ে তুলতে হলে এই বিতর্কিত পাঠ্যপুস্তক প্রত্যাখ্যানের বিকল্প নেই। তিনি আরও বলেন, দেশের সচেতন অভিভাবকদের প্রতি আমাদের আহ্বান, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ও কারিকুলামের ব্যাপারে আরও সরব হোন। ইসলামবিরোধী হিন্দুত্ববাদী পাঠ্যবই প্রত্যাখ্যান করুন। স্কুলে আপনার সন্তানদের কী শেখানো হচ্ছে, তা জনসমক্ষে তুলে ধরুন। অঙ্কুরেই মুসলমানের ছেলেমেয়েদের ইমানি চেতনা ধ্বংসের আয়োজন করা হচ্ছে। সেক্যুলারিজমের নামে ইসলাম নির্মূলের এ চক্রান্ত আমরা সফল হতে দেব না ইনশাআল্লাহ। সেমিনারে হেফাজতের মহাসচিব শায়েখ সাজিদুর রহমান সাতটি দাবি তুলে ধরেন। এগুলো হলো ‘ইসলামী শিক্ষা বিষয়’ প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সব শাখায় আবশ্যিক করা। দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির সামষ্টিক মূল্যায়ন তথা বোর্ড পরীক্ষায় ‘ইসলামী শিক্ষা বিষয়’ পুনর্বহাল করা। বিতর্কিত ও প্রত্যাখ্যাত কোরআনবিরোধী বিবর্তনবাদ ও ট্রান্সজেন্ডারবাদসহ ইসলামবিরোধী সব পাঠ্য-রচনা সিলেবাস থেকে অপসারণ। আরব দেশগুলোর শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার জন্য আরবি ভাষার পাঠদান সর্বস্তরে বাধ্যতামূলক করা। এনসিটিবিতে ঘাঁপটি মেরে থাকা ষড়যন্ত্রকারী ও তাদের সহযোগীদের অপসারণ করে দেশপ্রেমিক ও ইসলামী মূল্যবোধসম্পন্ন ব্যক্তিদের দায়িত্বদান। ভবিষ্যতে বিতর্ক এড়াতে বিজ্ঞ আলেমদের পরামর্শের আলোকে পাঠ্যবইয়ের পুনঃসংস্করণ করা। ২০১৩ থেকে এ পর্যন্ত হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা।
০৬ মে, ২০২৪

প্রসঙ্গ শিক্ষানীতি
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এর শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে বলা হয়েছিল—শিক্ষা, জ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষ, নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলা হবে। এটির পক্ষে-বিপক্ষে নানা মতামত থাকলেও বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (বাকবিশিস) এটিকে মন্দের ভালো বলে মতামত ব্যক্ত করেছিল এবং এর কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন ও সংযোজনসহ বাস্তবায়নের দাবি করেছিল এবং আজও করছে। শিক্ষার কাঠামোগত বিন্যাস: প্রাথমিক শিক্ষা—১. প্রাক-প্রাথমিক থেকে অষ্টম শ্রেণি; ২. মাধ্যমিক শিক্ষা—নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি; ৩. উচ্চশিক্ষা—স্নাতক (পাস/অনার্স) থেকে পিএইচডি পর্যন্ত। প্রাথমিক শিক্ষা: প্রাথমিক শিক্ষা হবে ১-৮ বছর অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। এর জন্য (১) অবকাঠামোগত আবশ্যকতা, (২) প্রয়োজনীয়সংখ্যক যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দান করা হবে। প্রাইমারি স্কুলে পাইলটিং হিসেবে কিছু স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়। নতুন ভবনের ব্যবস্থা করা হয় ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত হবে ৩০:১, প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির জন্য নতুন শিক্ষক নিয়োগের কথা থাকলেও সর্বত্র নিয়োগ হয়নি, অনেক প্রতিষ্ঠানে চারজন শিক্ষক থাকায় একাডেমিক কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নতুন ভবনের ব্যবস্থা করা হয় প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা থাকবে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে। এজন্য বেসরকারি স্কুলগুলোকে জাতীয়করণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা হবে। প্রাথমিক শিক্ষাকে বেসরকারি বা এনজিও খাতে হস্তান্তর করা যাবে না। শিক্ষক নিয়োগে সরকারি কর্ম কমিশনের অনুরূপ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। এ কমিশনকেই মাধ্যমিক পর্যায়ের বেসরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত এবং স্নাতক কলেজের শিক্ষক নির্বাচনে দায়িত্ব দেওয়া হবে। মূল্যায়ন পদ্ধতিতে: প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে ধারাবাহিক মূল্যায়ন, তৃতীয় থেকে সব শ্রেণিতে ত্রৈমাসিক, অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষা, পঞ্চম শ্রেণিতে আঞ্চলিক ভিত্তিতে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে সমাপনী পরীক্ষা এবং অষ্টম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। তবে বর্তমানে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির সমাপনী এবং অষ্টম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। মাধ্যমিক শিক্ষা: নবম-দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। বর্তমান উচ্চ বিদ্যালয়গুলোতে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি আর উচ্চ মাধ্যমিক কলেজগুলোতে নবম ও দশম শ্রেণি যুক্ত করা হবে। ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত হবে ৩০:১, সরকারি কর্ম কমিশনের অনুরূপ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। মাধ্যমিক স্তরে তিনটি ধারা থাকবে (যদিও এটি ১৯৭২ সালের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক) সাধারণ শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষা। নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের কাজে যোগদানের আগেই মৌলিক/বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ আর প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিতে হবে। শূন্যপদ পূরণের সময় প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। মূল্যায়ন পদ্ধতিতে দশম ও দ্বাদশ শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা হবে, পরীক্ষা হবে সৃজনশীল প্রশ্নে আর ফল হবে গ্রেডিং পদ্ধতিতে। তবে এগুলোও পরিবর্তন হতে চলেছে। উচ্চশিক্ষা: উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হবে জ্ঞানের সঞ্চারণ ও জ্ঞানের উদ্ভাবন/সৃষ্টি। উচ্চশিক্ষার স্তর হবে তিন বছরের স্নাতক পাস এবং চার বছরের অনার্স। মাস্টার্স, এমফিল, পিএইচডিকে বিশেষায়িত শিক্ষা হিসেবে গণ্য করা হবে। মাস্টার্স এক বছরের মধ্যে, এমফিল দুই বছর এবং পিএইচডি রেজিস্ট্রেশনের ছয় বছরের মধ্যে সমাপ্ত করতে হবে। মৌলিক গবেষণায় উৎসাহ ও অনুদান প্রদান করা হবে। উচ্চশিক্ষার মাপকাঠি হবে মেধা, বিত্তহীন মেধাবীদের রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পড়ানোর ব্যবস্থা থাকবে (২৫ অনুচ্ছেদ)। প্রকৌশল শিক্ষা, কৃষি শিক্ষা ও চিকিৎসা—এ স্তরের শিক্ষা তবে প্রফেশনাল এবং টেকনিক্যাল শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। মাধ্যমিক স্তরে এ বিষয়গুলোতে ডিপ্লোমা পড়ার সুযোগ রয়েছে। এ শিক্ষা কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য ইতিবাচক। বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা: দেশ-বিদেশের চাহিদা, ব্যাপক কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে বৃত্তিমূলক শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। অষ্টম শ্রেণি সমাপ্ত করে মাধ্যমিক স্তরে ভোকেশনাল ও বিএমটি এবং ডিপ্লোমা পড়ার সুযোগ রয়েছে। তবে এ শিক্ষা সম্পর্কে পজিটিভ ধারণার অভাবে বিকশিত হচ্ছে না। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও মালয়েশিয়ার অগ্রগতির পেছনের কারণ হলো কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা। আমাদের এখানে বৃত্তিমূলক শিক্ষায় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং সরকারি বরাদ্দ প্রয়োজনমতো নয়। সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো সুবিধাকে কেন্দ্র করে চলছে এই শিক্ষা। প্রতি উপজেলায় একটি করে কারিগরি প্রতিষ্ঠান করার প্রতিশ্রুতি থাকলেও এখনো কার্যকর হয়নি। ল্যাবে যন্ত্রাংশের অভাবও রয়েছে। আর্থিক বরাদ্দ: ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে জিডিপির ৫ শতাংশ এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে ৭ শতাংশ উন্নীত করার প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে অর্থ বরাদ্দের কথা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। এ ছাড়া শিক্ষায় বরাদ্দ পর্যায়ক্রমে নিম্নমুখী এবং তা ২ শতাংশের কম (১.৬৭ শতাংশ, ২০২৩-২৪) যেটা দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্র দেশগুলোর চেয়েও অনেক কম। শিক্ষা ও প্রযুক্তির টাকা প্রতিরক্ষা খাতের ক্যাডেট শিক্ষায় স্থানান্তর, প্রকল্পের নামে অর্থ তছরুপের কারণে শিক্ষায় যা বরাদ্দ হচ্ছে তাও পুরোপুরিভাবে ব্যবহার হচ্ছে না। ২০১৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব এডুকেশন ফোরামে গৃহীত এসডিজিসের চতুর্থ ধারায় (২০১৫-২০৩০) কোয়ালিটি, ইক্যুইটি ও ইনক্লুসিভ শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং ১২ ক্লাস পর্যন্ত শিক্ষা রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে হবে এমন সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ সরকার স্বাক্ষর করায় সবাই আশাবাদী হয়েছিলেন যে, বাজেটে বরাদ্দ বাড়বে কিন্তু শতকরা হিসাবে না বেড়ে কমেছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর যে বিষযগুলো এখনো বাস্তবায়ন হয়নি: শিক্ষা ছাড়া অন্য কোনো কাজে শিক্ষকদের যুক্ত করা হবে না বলা হলেও তা কার্যকর হয়নি; শিক্ষা আইন তৈরির কথা থাকলেও দুই দফা খসড়া প্রস্তাবনা দিলেও চূড়ান্ত আইন হয়নি। ২৭(১); শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ৩০:১ করার কথা থাকলেও নিশ্চিত করা হয়নি; সরকারি কর্ম কমিশনের অনুরূপ বিকল্প নিয়োগ কমিশন গঠনের কথা থাকলেও এখনো নিয়োগ হয়নি। ২৭(৩); শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য পৃথক বেতন কাঠামো গঠনের কথা থাকলেও করা হয়নি। ২৫(১); মেধা-দক্ষতার ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নির্বাচিত শিক্ষকদের শিক্ষা প্রশাসনে বিভিন্ন পদে পদোন্নতির কথা থাকলেও তা কার্যকর হয়নি। ২৫(৫); সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অন্যান্যদের মতো অর্জিত ছুটির ব্যবস্থার কথা বলা হলেও তা কার্যকর হয়নি। ২৫(১০); স্থায়ীভাবে শিক্ষা কমিশন গঠনের প্রস্তাবনা থাকলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি ২৭(২); এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলির কথা থাকলে তা এখনো পর্যন্ত কার্যকর হয়নি, শুধু এনটিআরসির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের এ আওতায় আনা হবে বলে জানা গেছে। ২৭(৩); শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য শিক্ষকদের ACR/বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরির কথা থাকলেও তা কার্যকর করা হয়নি। ২৭(৮(৩); প্রত্যেক বিভাগীয় শহরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্র স্থাপনের কথা থাকলেও তা কার্যকর হয়নি। (৬৭ পাত-২); সংবিধানের (১৭ ধারার ক)-এর আলোকে একই পদ্ধতির গণমুখী সর্বজনীন শিক্ষা বাস্তবায়নের কথা থাকলেও তা কার্যকর করা হয়নি। (সংযোজনী-১, পৃষ্ঠা-৭০); স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষার মূল্যায়ন প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা পদ্ধতির মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হবে। ২১(১৫) এটিও কার্যকর হয়নি; উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যকর করতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালের শিক্ষার্থীদের সাক্ষরতা আন্দোলনে সম্পৃক্ত করা হবে। ৩(১৭) তবে এটিও করা হয়নি; ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে জিডিপির ৫ শতাংশ এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে ৭ শতাংশ উন্নীত করার প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে অর্থ বরাদ্দের কথা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। এ ছাড়া শিক্ষায় বরাদ্দ পর্যায়ক্রমে নিম্নমুখী এবং তা ২ শতাংশের কম (১.৬৭ শতাংশ, ২০২৩-২৪), যেটা দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্র দেশগুলোর চেয়েও অনেক কম; শিক্ষা ও প্রযুক্তির টাকা প্রতিরক্ষা খাতের ক্যাডেট শিক্ষায় স্থানান্তর অব্যাহত থাকা, প্রকল্পের নামে অর্থ তছরুপের ঘটনার শিক্ষায়, যা বরাদ্দ হচ্ছে তাও পুরোপুরিভাবে কাজে ব্যবহার হচ্ছে না। লেখক: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (বাকবিশিস)
০৬ মে, ২০২৪

সেমিনারে বক্তারা / দেশীয় মূল্যবোধের আলোকে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে
‘দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা- জাতির ভবিষ্যৎ ও আমাদের করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, গবেষক ও বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, আধিপত্যবাদী শক্তি পরিকল্পিতভাবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তারা কৌশলে শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরে ইসলাম ধর্মের পরিপন্থি বিষয়সমূহ ঢুকিয়ে দিয়েছে। তারা বাংলাদেশের মুসলিম পরিবার ব্যবস্থা ভেঙে ফেলতে চক্রান্ত করছে। শনিবার (২ মার্চ) জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে শিক্ষা গবেষণা সংসদ-ঢাকার উদ্যোগে আয়োজিত সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। তারা বলেন, ইতিমধ্যেই শিক্ষা ব্যবস্থায় সুকৌশলে ট্রান্সজেন্ডারের মাধ্যমে সমকামিতাকে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। অন্যথায় আমাদের সন্তানরা এক সময় প্রতিবেশী আধিপত্যবাদের গোলাম হয়ে যাবে। ওহীর জ্ঞান বা শিক্ষা ছাড়া মুসলিমপ্রধান একটি রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হতে পারে না। বক্তারা বলেন, সেকুলার শিক্ষা ব্যবস্থার কুফল জাতি ভোগ করতে শুরু করেছে। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে মেধা পাচার হয়ে যাচ্ছে এবং জাতিকে বিভক্ত করে ফেলেছে। ফলে রাষ্ট্র ও শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। সেমিনারে বক্তারা বলেন, ইসলামী আদর্শ ও নৈতিকতাকে ভিত্তি করে নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ ও আদর্শকে সমুন্নত রেখে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে পরিকল্পনা নিতে হবে। মানারাত ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ড. চৌধুরী মাহমুদ হাসান বলেন, আমাদের ইসলাম ধর্মের সংস্কৃতি হচ্ছে ব্যপকভাবে সালামের প্রচলন করা। এখন সালাম দিলে ও আলহামদুলিল্লাহ বললে ট্রল করা হচ্ছে, এটা গত ১৫ বছরের সেকুলার কুশিক্ষার ফল। মানুষকে ইসলাম থেকে দূরে রাখতে ইসলামী ফোবিয়া সৃষ্টি করা হয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলাম ধর্মের বিরোধী বিষয় পাঠ্যবইয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে আমাদের নতুন প্রজন্মকে ইসলাম থেকে দূরে রাখতে এবং ইসলাম বিদ্বেষী করে গড়ে তোলার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে সচেতন মহলসহ দেশবাসীকে সোচ্চার হতে হবে। মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ড. মোহাম্মদ আবদুর রব বলেন, বাংলাদেশে ধর্মহীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন শুরু হয় কুদরতে খুদা শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে, পরবর্তীতে কবির চৌধুরী শিক্ষা কমিশন ধর্মহীনতা ও ইসলামবিরোধী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়নে আরেক ধাপ এগিয়ে যায়।  বাংলাদেশ ইসলামি ইউনিভার্সিটির সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ড. এম. কোরবান আলী বলেন, ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হবে। একটা সরকার পরিবর্তন হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে একটি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হওয়া এটা সন্দেহজনক। এটা বাহির থেকে কেউ করে দিয়েছে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কার করতে হলে রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংস্কার করতে হবে। সরকার পরিবর্তনের জন্য আমাদের কাজ করতে হবে। তা না হলে আধিপত্য থেকে আমরা মুক্তি পাব না। শিক্ষা গবেষণা সংসদ-ঢাকার সমন্বয়ক অধ্যাপক নুরুন্নবী মানিকের সঞ্চালনায় সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ড. আব্দুল লতিফ মাসুম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এটিএম ফজলুল হক, নজরুল গবেষক ও কবি আবদুল হাই শিকদার, অধ্যক্ষ ড. ইকবাল হোসাইন ভূঁইয়া, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহিদুল ইসলাম, ডা. নাজনিন আকতার। এ সময় উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক রবিউল ইসলাম, আব্দুস সাত্তার সুমন, মাকসুদুর রহমানসহ বিভিন্ন শিক্ষক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। 
০২ মার্চ, ২০২৪

নতুন শিক্ষানীতি দেশবিরোধী
নতুন শিক্ষানীতি ও কারিকুলামকে দেশবিরোধী বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, দেশ আর ধর্মীয় মূল্যবোধবিরোধী নতুন এ শিক্ষানীতি ও কারিকুলাম বাস্তবায়ন হলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। রিজভী বলেন, শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজানো হয় যাতে নতুন প্রজন্মকে তাঁবেদার বানানো যায়। জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার অসৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই এ শিক্ষা কারিকুলাম চালু করা হয়েছে। শিশুদের অনলাইনজাত প্রোডাক্ট দেওয়া হলে তারা এলোমেলো হয়ে যাবে, বিকৃতমনস্ক ও বিভ্রান্ত হতে পারে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমরা চাই, শিশু-কিশোরদের অনলাইন নির্ভরতা কমিয়ে পাঠ্যবই নির্ভর আগামী প্রজন্ম। এ সময় তিনি সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। সংবাদ সম্মেলনে দলের কেন্দ্রীয় নেতা জয়নুল আবদিন ফারুক, আবুল খায়ের ভুঁইয়া, মীর নেওয়াজ আলী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
২৬ জানুয়ারি, ২০২৪

গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি কত দূর
দু-দুবার স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের সর্বজনীন গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতির দাবি প্রথম উচ্চারিত হয় ১৯৬২ সালে। সেটি বিগত শতাব্দীর কথা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বেরিয়ে পূর্ব বাংলা, যা বর্তমান বাংলাদেশ; স্বাধীনতা লাভ করে যুক্ত হয়ে যায় পাকিস্তান নামক একটি সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে। তাতে সে সময়ের পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের সায় ছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরুর সময় থেকে পূর্ব পাকিস্তান নামের বাংলাদেশ ভূখণ্ডের জনগণের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না। রাষ্ট্রটির ৫৬ শতাংশ অধিবাসী বাংলা ভাষাভাষী হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার পরিকল্পনা করে। প্রারম্ভেই পাকিস্তানের দুই অংশের সঙ্গে সৃষ্টি হয়ে যায় মানসিক দূরত্ব। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাঙালির চেতনায় জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটে। পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রও প্রণীত হতে বিলম্ব ঘটে। প্রথম থেকেই একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা নিয়ে চলতে থাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি। সামরিক বাহিনীর হাতে জিম্মি হয়ে যায় পাকিস্তান জন্মলগ্নের শুরুতেই। ১৯৫১ সালে প্রথম সামরিক অভ্যুত্থানের সূচনা হয় এবং সেটি ব্যর্থ হলেও ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা কবজা করে নেয়। জেনারেল আইয়ুব খান একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। ড. শরীফ খান ছিলেন সেই কমিশনের প্রধান। তিনি একটি শিক্ষানীতির প্রস্তাবনা দেন। ওই শিক্ষানীতি ছিল বৈষম্যমূলক, পশ্চাৎপদ, মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক। বাঙালির চেতনায় ততদিনে স্থান করে নিয়েছে জাতীয়তাবাদের চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা এবং সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের পরিকল্পনা। শরীফ শিক্ষা কমিশনের শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে সূচিত হয় ছাত্র আন্দোলন আর সেই সময়ে একটি সর্বজনীন গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতির দাবি উচ্চারিত হয় খুব দৃঢ়ভাবে। ওই বছরে বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলন জোরদার হয়। রক্তপাতও ঘটে। ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার রাজপথে শরীফ শিক্ষা কমিশনের শিক্ষানীতি বাতিল ও সর্বজনীন গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়নের দাবিতে ছাত্রমিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে বাবুল, ওয়াজিউল্লাহ, মোস্তফা নামের তিনজন নিহত হন, আহত হন একাধিক। মূলত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের যৌথ আন্দোলন ছিল সেটি। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের দাবি ছিল সর্বজনীন গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়নের এবং তাতে ছাত্রলীগের সমর্থন ছিল। সেই থেকে বাংলাদেশে ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস পালিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। এটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন। এই কমিশনের কাছে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সব শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীর জন্য একটি শিক্ষানীতি প্রণয়নের দাবি পূরণ ছিল সব স্তরের জনগণের স্বাভাবিক ও যৌক্তিক আকাঙ্ক্ষা। যৌক্তিক ও স্বাভাবিক এ কারণে যে, পূর্বে পাকিস্তান শাসনামলে গঠিত হওয়া তিনটি কমিশন অর্থাৎ ১৯৫৯ সালে ড. শরীফ খানের শিক্ষা কমিশন, ১৯৬৬ সালে হামদুর রহমান কমিশন, ১৯৬৯ সালে গঠিত হওয়া নুর খাঁ কমিশন—কোনো শিক্ষা কমিশনই যুগোপযোগী বিজ্ঞানভিত্তিক সর্বজনীনতা গ্রাহ্য করেনি, বরং এ কমিশনগুলো বৈষম্যমূলক, অবৈজ্ঞানিক, ধর্মভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। নিজ মাতৃভূমিতে বৈষম্যহীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রণীত হবে এমন ধারণা পোষণ জনমনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া থাকলেও তা অর্জনে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ। ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন ১৯৭৪ সালের মে মাসে তার রিপোর্ট প্রকাশ করেন। রিপোর্টে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হিসেবে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, দেশাত্মবোধ ও আলোকিত নাগরিকত্ব, মানবতাবাদ এবং বিশ্ব নাগরিকত্ব, নৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক রূপান্তরের হাতিয়ার হিসেবে শিক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রায়োগিক শিক্ষা, কায়িক শ্রমের প্রতি যথাযথ মর্যাদা, প্রাতিষ্ঠানিক এবং নেতৃত্বের দক্ষতা, মৌলিক গবেষণা ও সামাজিক অগ্রগতি এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য শিক্ষা সন্নিবেশিত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং তৎপরবর্তীকালে জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বের সরকার এ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট ও সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন থেকে সরে আসে। ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনই ছিল একমাত্র শিক্ষা কমিশন, যা সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক, গণমুখী ও বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবিগুলোকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিয়েছিল। চল্লিশ বছর আগে মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিলের পরও ছাত্রসংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে সর্বজনীন গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়নের দাবি ছিল। কিছুদিন পরপরই একটা কমিশন হয়েছে। একটা কমিশন কমিশন খেলা চলেছে দীর্ঘসময়। ১৯৮৭ সালে জেনারেল এরশাদ মফিজউদ্দিন খানের নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে অধ্যাপক শামসুল হক শিক্ষা কমিশন। বিএনপি-জামায়াত ২০০১ সালে সরকার গঠন করে। এরপর ২০০৩ সালে গঠন করে ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান শিক্ষা কমিশন। কোনো কমিশনই তার রিপোর্ট বিস্তৃত আকারে প্রকাশ করেনি। আর তার কোনোটাই যুগোপযোগী বাস্তবসম্মত ছিল না। বাস্তবায়িত হয়নি কোনোটাই। ২০১০ সালে গঠিত হয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশন। এ কমিশন ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন ও অধ্যাপক শামসুল হক শিক্ষা কমিশনের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়নের চেষ্টা করে। সেটি বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাবে বলে ঘোষণা দেয় বর্তমান সরকার। এই শিক্ষা কমিশনের বেশিরভাগ সুপারিশ সরকার গত ১২ বছরে বাস্তবায়নই করতে পারেনি। যেমন এই শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছিল—শিশুদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক এক বছরের শিক্ষা প্রদান কার্যক্রম চালু করা, বলা হয়েছিল অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা উন্নীত করা, পঞ্চম ও অষ্টম (জেএসসি পরীক্ষা) শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। বলা হয়েছিল সৃজনশীল পদ্ধতিতে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাদান করা, উদ্দেশ্য ছিল কোচিং ও গাইড বই থেকে শিক্ষার্থীকে দূরে সরিয়ে নিয়ে আসা। উদ্দেশ্য পূরণ তো দূরের কথা, বাস্তবতা হচ্ছে—ঘটনা ঘটেছে উল্টোটি। শ্রেণিকক্ষে সৃজনশীল পদ্ধতি বুঝতে পর্যাপ্ত সময় না পেয়ে শিক্ষার্থী স্কুল শেষ করে আরও বেশি করে ছুটেছে কোচিং সেন্টারে। মাদ্রাসা শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে ভয়াবহভাবে। যে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা, যা এ ভূখণ্ডে উদ্দেশ্যমূলকভাবে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা পৃষ্ঠপোষক, দানকারী ব্রিটিশরাও স্বীকৃতি দেয়নি; তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে বর্তমান সরকার; যা প্রণীত শিক্ষা কমিশনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আদতে অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়িত হয়নি কিংবা সরকারের সদিচ্ছারও অভাব ছিল। আমরা শিক্ষাব্যবস্থায় চরম অরাজকতা সৃষ্টি করেছি। এমন করে চলতে থাকা শিক্ষাব্যবস্থায় সৃষ্টি হচ্ছে অপূর্ণাঙ্গ মানুষ; যারা প্রগতির বাইরে, মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধির চিন্তা, সংস্কৃতির চর্চার অনেক অনেক দূরে। এ মানুষ সমাজে সৃষ্টি করছে অস্থিরতা। ক্রমেই সমাজ হারাচ্ছে মানবিকতা, হারাচ্ছে উৎপাদনশীলতা। তৃতীয় শিল্প-বিপ্লবের ভেতর দিয়ে চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের দরজায় কড়া নাড়ছে পৃথিবী। আমরা আজও স্থির করতে পারিনি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। অধরাই থেকে গেছে প্রায় ষাট বছর আগের গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দাবি। লেখক : সদস্য সচিব, জাতীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতি আন্দোলন
০৩ ডিসেম্বর, ২০২৩
X