গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি কত দূর
দু-দুবার স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের সর্বজনীন গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতির দাবি প্রথম উচ্চারিত হয় ১৯৬২ সালে। সেটি বিগত শতাব্দীর কথা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বেরিয়ে পূর্ব বাংলা, যা বর্তমান বাংলাদেশ; স্বাধীনতা লাভ করে যুক্ত হয়ে যায় পাকিস্তান নামক একটি সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে। তাতে সে সময়ের পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের সায় ছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরুর সময় থেকে পূর্ব পাকিস্তান নামের বাংলাদেশ ভূখণ্ডের জনগণের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না। রাষ্ট্রটির ৫৬ শতাংশ অধিবাসী বাংলা ভাষাভাষী হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার পরিকল্পনা করে। প্রারম্ভেই পাকিস্তানের দুই অংশের সঙ্গে সৃষ্টি হয়ে যায় মানসিক দূরত্ব। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাঙালির চেতনায় জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটে। পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রও প্রণীত হতে বিলম্ব ঘটে। প্রথম থেকেই একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা নিয়ে চলতে থাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি। সামরিক বাহিনীর হাতে জিম্মি হয়ে যায় পাকিস্তান জন্মলগ্নের শুরুতেই। ১৯৫১ সালে প্রথম সামরিক অভ্যুত্থানের সূচনা হয় এবং সেটি ব্যর্থ হলেও ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা কবজা করে নেয়। জেনারেল আইয়ুব খান একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। ড. শরীফ খান ছিলেন সেই কমিশনের প্রধান। তিনি একটি শিক্ষানীতির প্রস্তাবনা দেন। ওই শিক্ষানীতি ছিল বৈষম্যমূলক, পশ্চাৎপদ, মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক।
বাঙালির চেতনায় ততদিনে স্থান করে নিয়েছে জাতীয়তাবাদের চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা এবং সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের পরিকল্পনা। শরীফ শিক্ষা কমিশনের শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে সূচিত হয় ছাত্র আন্দোলন আর সেই সময়ে একটি সর্বজনীন গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতির দাবি উচ্চারিত হয় খুব দৃঢ়ভাবে। ওই বছরে বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলন জোরদার হয়। রক্তপাতও ঘটে। ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার রাজপথে শরীফ শিক্ষা কমিশনের শিক্ষানীতি বাতিল ও সর্বজনীন গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়নের দাবিতে ছাত্রমিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে বাবুল, ওয়াজিউল্লাহ, মোস্তফা নামের তিনজন নিহত হন, আহত হন একাধিক। মূলত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের যৌথ আন্দোলন ছিল সেটি। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের দাবি ছিল সর্বজনীন গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়নের এবং তাতে ছাত্রলীগের সমর্থন ছিল। সেই থেকে বাংলাদেশে ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস পালিত হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। এটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন। এই কমিশনের কাছে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সব শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীর জন্য একটি শিক্ষানীতি প্রণয়নের দাবি পূরণ ছিল সব স্তরের জনগণের স্বাভাবিক ও যৌক্তিক আকাঙ্ক্ষা। যৌক্তিক ও স্বাভাবিক এ কারণে যে, পূর্বে পাকিস্তান শাসনামলে গঠিত হওয়া তিনটি কমিশন অর্থাৎ ১৯৫৯ সালে ড. শরীফ খানের শিক্ষা কমিশন, ১৯৬৬ সালে হামদুর রহমান কমিশন, ১৯৬৯ সালে গঠিত হওয়া নুর খাঁ কমিশন—কোনো শিক্ষা কমিশনই যুগোপযোগী বিজ্ঞানভিত্তিক সর্বজনীনতা গ্রাহ্য করেনি, বরং এ কমিশনগুলো বৈষম্যমূলক, অবৈজ্ঞানিক, ধর্মভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। নিজ মাতৃভূমিতে বৈষম্যহীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রণীত হবে এমন ধারণা পোষণ জনমনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া থাকলেও তা অর্জনে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ। ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন ১৯৭৪ সালের মে মাসে তার রিপোর্ট প্রকাশ করেন। রিপোর্টে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হিসেবে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, দেশাত্মবোধ ও আলোকিত নাগরিকত্ব, মানবতাবাদ এবং বিশ্ব নাগরিকত্ব, নৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক রূপান্তরের হাতিয়ার হিসেবে শিক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রায়োগিক শিক্ষা, কায়িক শ্রমের প্রতি যথাযথ মর্যাদা, প্রাতিষ্ঠানিক এবং নেতৃত্বের দক্ষতা, মৌলিক গবেষণা ও সামাজিক অগ্রগতি এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য শিক্ষা সন্নিবেশিত হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং তৎপরবর্তীকালে জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বের সরকার এ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট ও সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন থেকে সরে আসে। ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনই ছিল একমাত্র শিক্ষা কমিশন, যা সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক, গণমুখী ও বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবিগুলোকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিয়েছিল। চল্লিশ বছর আগে মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিলের পরও ছাত্রসংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে সর্বজনীন গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়নের দাবি ছিল। কিছুদিন পরপরই একটা কমিশন হয়েছে। একটা কমিশন কমিশন খেলা চলেছে দীর্ঘসময়। ১৯৮৭ সালে জেনারেল এরশাদ মফিজউদ্দিন খানের নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে অধ্যাপক শামসুল হক শিক্ষা কমিশন। বিএনপি-জামায়াত ২০০১ সালে সরকার গঠন করে। এরপর ২০০৩ সালে গঠন করে ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান শিক্ষা কমিশন। কোনো কমিশনই তার রিপোর্ট বিস্তৃত আকারে প্রকাশ করেনি। আর তার কোনোটাই যুগোপযোগী বাস্তবসম্মত ছিল না। বাস্তবায়িত হয়নি কোনোটাই।
২০১০ সালে গঠিত হয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশন। এ কমিশন ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন ও অধ্যাপক শামসুল হক শিক্ষা কমিশনের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়নের চেষ্টা করে। সেটি বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাবে বলে ঘোষণা দেয় বর্তমান সরকার। এই শিক্ষা কমিশনের বেশিরভাগ সুপারিশ সরকার গত ১২ বছরে বাস্তবায়নই করতে পারেনি। যেমন এই শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছিল—শিশুদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক এক বছরের শিক্ষা প্রদান কার্যক্রম চালু করা, বলা হয়েছিল অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা উন্নীত করা, পঞ্চম ও অষ্টম (জেএসসি পরীক্ষা) শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। বলা হয়েছিল সৃজনশীল পদ্ধতিতে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাদান করা, উদ্দেশ্য ছিল কোচিং ও গাইড বই থেকে শিক্ষার্থীকে দূরে সরিয়ে নিয়ে আসা। উদ্দেশ্য পূরণ তো দূরের কথা, বাস্তবতা হচ্ছে—ঘটনা ঘটেছে উল্টোটি। শ্রেণিকক্ষে সৃজনশীল পদ্ধতি বুঝতে পর্যাপ্ত সময় না পেয়ে শিক্ষার্থী স্কুল শেষ করে আরও বেশি করে ছুটেছে কোচিং সেন্টারে। মাদ্রাসা শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে ভয়াবহভাবে। যে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা, যা এ ভূখণ্ডে উদ্দেশ্যমূলকভাবে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা পৃষ্ঠপোষক, দানকারী ব্রিটিশরাও স্বীকৃতি দেয়নি; তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে বর্তমান সরকার; যা প্রণীত শিক্ষা কমিশনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আদতে অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়িত হয়নি কিংবা সরকারের সদিচ্ছারও অভাব ছিল।
আমরা শিক্ষাব্যবস্থায় চরম অরাজকতা সৃষ্টি করেছি। এমন করে চলতে থাকা শিক্ষাব্যবস্থায় সৃষ্টি হচ্ছে অপূর্ণাঙ্গ মানুষ; যারা প্রগতির বাইরে, মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধির চিন্তা, সংস্কৃতির চর্চার অনেক অনেক দূরে। এ মানুষ সমাজে সৃষ্টি করছে অস্থিরতা। ক্রমেই সমাজ হারাচ্ছে মানবিকতা, হারাচ্ছে উৎপাদনশীলতা। তৃতীয় শিল্প-বিপ্লবের ভেতর দিয়ে চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের দরজায় কড়া নাড়ছে পৃথিবী। আমরা আজও স্থির করতে পারিনি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। অধরাই থেকে গেছে প্রায় ষাট বছর আগের গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দাবি।
লেখক : সদস্য সচিব, জাতীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতি আন্দোলন
০৩ ডিসেম্বর, ২০২৩