হারিয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নিজস্ব সাদ্রি ভাষা
এক শ্রেণির ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নিজস্ব ভাষার নাম সাদ্রি। তাদের ছেলে-মেয়েরা নিজস্ব ভাষায় তেমন কথা বলতে পারে না। একাডেমিক বা বই পুস্তকের মাধ্যমে শেখা হয় না সেই ভাষা। তাই বাবা-মায়ের কাছ থেকে যেটুকু শেখা, সেটাই কোনোমতে ধরে রাখার চেষ্টা। ফলে ভুলেই যেতে বসেছে তাদের নিজস্ব ভাষা। কথা হয় সাদ্রি ভাষায় কথা বলা নওগাঁর বদলগাছীর উপজেলার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারের চার ছেলে-মেয়ের সঙ্গে। জানা গেছে, কলেজ পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতি বছর শিক্ষা ভাতা দেওয়া হয়। সেজন্য প্রত্যয়নপত্র নিতে এসেছিলেন উপজেলার আধাইপুর ইউনিয়নের চকআলম পুর এলাকার অমৃত ওড়াওয়ের ছেলে অজিত কৃমার ওড়াও, রসুলপুর এলাকার মাধবপাড়ার কিরণ চন্দ্র মিনজীর ছেলে প্রশান্ত মিনজী ও একই এলাকার বৃষ্টি তির্কী। এরা তিনজন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ওড়াও সম্প্রদায়ের। আর তাদেরই সহপাঠী শ্যমপাড়ার পংকরী রাণী পাহান সম্প্রদায়ের। তবে এদের মধ্যে আরও মিল রয়েছে, এরা সকলেই বদলগাছী বঙ্গবন্ধু সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী। পড়াশোনা করছে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে এবং একই বিভাগের শিক্ষার্থী তারা। প্রত্যয়নের জন্য আবেদন জমা দিতে এসেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে। সেখানে প্রশাসনিক কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র মন্ডল তাদের আবেদনের ভূলভ্রান্তি বুঝিয়ে ঠিক করে জমা দিতে বলেন। একাডেমিক বা বই পুস্তকের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব ভাষা শিখতে পারছে কিনা, স্কুল-কলেজে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাদের জন্য আলাদা কোনো ভাষার ব্যবস্থা আছে কিনা- এসব নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা হয় কালবেলা প্রতিবেদকের। কিন্তু এগুলোর কোনো কিছুরই ব্যবস্থা নেই। তাই তারা ভুলে যেতে বসেছে তাদের নিজস্ব সাদ্রি ভাষা। তবে জন্মের পর বাবা-মায়ের কাছ থেকে যেটুকু শেখা যায়। তাও ঠিকমতো আর বলতে পারেন না তারা। ‘আমি বা আমরা বাংলাদেশকে ভালোবাসি’ এই বাক্যটি তাদের নিজস্ব ভাষায় জানতে চাওয়া হয়। আমতা আমতা করে অজিত কুমার ওড়াও ও প্রশান্ত মিনজী বলেন, ‘হ্যাম বা হ্যাম্নি বাংলাদেশকে ভালোবাসিলা।’ আর ঝটপট বলল বৃষ্টি তির্কী। তারা সকলেই জানালেন তাদের এই সাদ্রি ভাষা কিছুটা হিন্দি ভাষার আদলে। অজিত ও প্রশান্ত বলেন, ‘আমরা গত বছরও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ২৫ হাজার করে টাকা পেয়েছি। তাই এবারও আবেদন করছি। ওই টাকাটা পেলে আমাদের অনেক কাজে দেয়। এই জন্য হ্যাম্নি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাইলা।’ পরিশেষে তারা চারজনই তাদের নিজস্ব ভাষা ধরে রাখার আহ্বান জানান। তাই তারা বললেন, ‘হ্যাম্নিকের ভাষা হ্যাম্নি ধ্যারকে র‌্যাখবেই।’ প্রশাসনিক কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র মন্ডল বলেন, প্রত্যয়নে একটু ভুল থাকলে তাদের জন্যই পরবর্তীতে সমস্যা হবে। তাই ভুলভ্রান্তি ঠিক করে জমা দিতে বললাম। তারা জমা দেওয়া মাত্রই তাদেরকে ইউএনওর স্বাক্ষরিত প্রত্যয়ন দেওয়া হবে। তিনিও শুনছিলেন তাদের নিজস্ব সাদ্রি ভাষায় কথা বলা। তিনি আরও বলেন, তাদের ভাষাটা ধরে রাখা উচিত। সেটা যে কোনো উপায়ে হতে পারে। আর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিচ্ছেন। তাদের পরিবারের সদস্যরাও পাচ্ছেন সুযোগ সুবিধা। আমরা চাই তারা তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলতে পারুক। বদলগাছীর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সামাজিক সংগঠনের সহকারী সাংগঠনিক সম্পাদক লিটন পাহান ও সভাপতি বিজয় পাহান কালবেলাকে বলেন, ওড়াও, পাহান, মাহাদীসহ এই উপজেলায় প্রায় ২৫ হাজার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী আছি। অন্যদের মতো আমাদের এই সাদ্রি ভাষার প্রচলন হওয়া উচিত। আমরা চাই আমাদের সন্তানরা সাদ্রি ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করুক। সরকার নাকি এটা নিয়ে কাজ করছে। আমরা শুনেছিলাম বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রাথমিক পর্যায়ে সাদ্রি ভাষার জন্য বই দিবে। প্রথম শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বই থাকবে। দেওয়া হবে শিক্ষা। আমরা চাই প্রাথমিক পর্যায়ে আমাদের আলাদা একজন শিক্ষক থাকবে, তারাই আমাদের এই সাদ্রি ভাষায় ছেলে-মেয়েদের পাঠদান করাবে। আর এটা দ্রুত কার্যকর করা হোক। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নানা ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি খুশি। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা অজানা কাহিনী ও ইতিহাস ঐতিহ্য তুলে নিয়ে আসা সামাজিক সংগঠন একুশে পরিষদ নওগাঁর সাধারণ সম্পাদক এম এম রাসেল কালবেলাকে বলেন, তাদের সাদ্রি ভাষা সংরক্ষণ করা দায়িত্ব। সেটা যে কোনো উপায়ে হতে পারে। আমার জানা মতে এই ভাষাটি ভারতের ঝাড়খণ্ড-উড়িষ্যা থেকে এই সাদ্রি ভাষা এসেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের চা বাগানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মানুষরা কাজ করতো। সেখানে এই ভাষাটি প্রচলন হতো। এদেরই একটা অংশ হয়তো এখানে এসেছে বা বংশ পরম্পরায় আছে। ওড়াও সম্প্রদায় সাদ্রি ভাষাকে তাদের নিজস্ব ভাষা করে নিয়েছে। তাই তাদের পড়াশোনার জন্য নিজস্ব ভাষার বইও থাকা দরকার। এ বিষয়ে নওগাঁ-৩ (মহাদেবপুর-বদলগাছী) আসনের সংসদ সদস্য সৌরেন্দ্র নাথ চক্রবর্ত্তী সৌরেন কালবেলাকে বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়নের জন্য দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারের জন্যও তিনি অনেক সুযোগ সুবিধা দিচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যার নির্দেশে আমি আমার এলাকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছি এবং ভবিষ্যতেও কাজ করে যাবো।
২৭ এপ্রিল, ২০২৪
X