আগুন নিভলেও দুদিন পর্যবেক্ষণে থাকবে সুন্দরবন
৪৩ ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে এসেছে সুন্দরবনে লাগা আগুন। গতকাল সোমবার সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে দাবি করেছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেছেন, আগুন যাতে আর না লাগে বা ছড়িয়ে না পড়ে, এজন্য দুদিন পর্যবেক্ষণে রাখা হবে সুন্দরবন।
এক ব্রিফিংয়ে তিনি দাবি করেন, শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টায় লাগা আগুন গতকাল সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। এজন্য ফায়ার সার্ভিস, নৌবাহিনী, বন বিভাগ, বিমানবাহিনী ও স্থানীয় শত শত স্বেচ্ছাসেবক অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। আগুন এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে জানিয়ে তিনি বলেন, কোথাও আগুনের ফুলকি বা ধোঁয়া নেই। তবে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আরও দুদিন কাজ করবেন কালো ছাই সাদা করার জন্য। এরপর তারা বন ত্যাগ করবেন।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক আরও বলেন, ভবিষ্যতে বনের ওই এলাকায় আগুন লাগার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এখনই আগামীর জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
ব্রিফিংয়ে নৌবাহিনীর কর্মকর্তা কমান্ডার মো. বাশারুল ইসলাম, চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) রানা দেব, মোরেলগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আশিকুর রহমান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম তারেক সুলতান, থানার ওসি মোহাম্মদ সামসুদ্দীন ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম হাওলাদার উপস্থিত ছিলেন।
সহকারী বন সংরক্ষক রানা দেব জানান, আগামী দুদিন এ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রেখে পানি ছিটানো হবে। তবে আপাতত আর ভয়ের কারণ নেই। আগুন যাতে আবার জ্বলে উঠতে না পারে বা ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেজন্য রোববার ফায়ার লাইন কেটে সেখানে পানি দিয়ে রাখা হচ্ছে।
এদিকে প্রধান বন সংরক্ষক আমির হোসেন চৌধুরী জানিয়েছেন, আগুনে ৫ একর বন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে আগুন যেন পুনরায় জ্বলে উঠতে না পারে, এজন্য আরও তিন দিন ওই এলাকা সতর্ক অবস্থায় থাকবে। আগুন লাগার ঘটনায় আজ মঙ্গলবার থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হবে। তিনি বলেন, আগুন লাগার ঘটনায় জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি নিরূপণ ও পরবর্তী সময়ে করণীয় নির্ধারণে সাত সদস্যের বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করা হয়েছে। খুলনার বন সংরক্ষক মিহির কুমার দের নেতৃত্বে গঠিত টিম ১০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে।
অপরিকল্পিত নদী খনন কাল হয়েছে: বন বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনে গত দুই দশকে যেসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, এর সবকটি ঘটেছে পূর্ব বন বিভাগে সুন্দরবনের ভোলা ও মরা ভোলা নদী সংলগ্ন এলাকায়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক মো. ওয়াসিউল ইসলামের মতে, পূর্ব সুন্দরবনের এই নদী দুটি অপরিকল্পিতভাবে খনন করে মাটি তুলে এমনভাবে রাখা হয়েছে, যা বাঁধের মতো মনে হয়। ফলে জোয়ারভাটার পানি প্রবেশ না করায় সেখানকার ভূমি একবারে শুষ্ক থাকে। বর্ষা মৌসুমের আগে আগে এটা আরও শুষ্ক হয়ে যায়। সেজন্য এখানে আগুন সহজভাবে ধরতে পারে।
তিনি বলেন, বনের মধ্যে পানির প্রবাহ না থাকা বড় একটা ইস্যু হয়ে গেছে। এজন্য বড় ধরনের একটা প্রকল্প দরকার। বাংলাদেশ বন বিভাগের সঙ্গে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের বিভিন্ন শাখা, নদী শাসনের কাজ যারা করেন, তাদের সবার একটা সমন্বয় দরকার। একটা পরিকল্পিত পদ্ধতিতে প্রকল্পটা নেওয়া দরকার। কারণ, আগের মতো প্রকল্প নিয়ে মাটি বনের মধ্যে ফেলা হলে, কিংবা বন উঁচু করে দেওয়া হলে ম্যানগ্রোভের জন্য যে পরিবেশ লাগে, সেটা নষ্ট হবে। তখন নতুন প্রকল্পেও কোনো লাভ হবে না।
জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি জানতে কমিটি
সুন্দরবনের আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এলেও এখনো ড্রোনের মাধ্যমে মনিটর করছে বন বিভাগ। বিভিন্ন গণমাধ্যমে বর্গকিলোমিটার এলাকার অগ্নিকাণ্ডের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপ্তি ছিল ৭ দশমিক ৯ একর। যার মধ্যে ৫ একর এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডে জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কমিটি গঠন করেছে বন অধিদপ্তর। প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরীর স্বাক্ষরে খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো-কে সভাপতি এবং খুলনার ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তাকে সদস্য সচিব করে এ কমিটি গঠন করা হয়। অন্য সদস্যরা হলেন পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি; সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ, বাগেরহাটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. এসএম ফিরোজ, আরণ্যক ফাউন্ডেশনের ম্যানগ্রোভ ইকোলজিস্ট এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটের প্রফেসর ড. স্বপন কুমার সরকার এবং ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটির প্রতিনিধি।
কমিটিকে আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে আগুনে বনজ সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ চিহ্নিত করে করণীয় সম্পর্কে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
এদিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর কোস্টগার্ড, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেছেন। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী, সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ এবং প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী সুন্দরবনের আগুন নির্বাপণ কার্যক্রম সার্বক্ষণিকভাবে তদারকি ও সমন্বয় করছেন।
০৭ মে, ২০২৪