স্বাধীনতা দিবস জিমন্যাস্টিকস
বাংলাদেশ জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশন আয়োজিত স্বাধীনতা দিবস জিমন্যাস্টিকস প্রতিযোগিতা গতকাল শুরু হয়েছে। বিকেলে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) জিমনেশিয়ামে শুরু হওয়া প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশনের সহসভাপতি আহমেদুর রহমান। ২৫ থেকে ২৭ এপ্রিল—তিন দিনের এ প্রতিযোগিতায় বিকেএসপি, বাংলাদেশ পুলিশ, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনসহ জুনিয়র-সিনিয়র বিভাগে ৩৫ দল ও ক্লাবের প্রায় ৫০ জন পুরুষ ও নারী জিমন্যাস্ট অংশ নিচ্ছে। ১২ থেকে ২০ মে উজবেকিস্তানে অনুষ্ঠেয় এশিয়ান (সিনিয়র ও জুনিয়র) জিমন্যাস্টিকস প্রতিযোগিতার দল নির্বাচনের বাছাইপর্ব প্রতিযোগিতা হিসেবে এ আসর আয়োজন করা হয়েছে। আগামীকাল সকাল সাড়ে ১১টায় প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান আয়োজিত হবে।
২৬ এপ্রিল, ২০২৪

বশেফমুবিপ্রবিতে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেফমুবিপ্রবি) স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদযাপন হয়েছে। মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামরুল আলম খান জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে দিনের কর্মসূচি উদ্বোধন করেন। পরে তার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানো হয়। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাইকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানান।
২৮ মার্চ, ২০২৪

স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বুয়েটে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত 
মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার (২৬ মার্চ) বুয়েট কাউন্সিল ভবনে অনুষ্ঠিত এ সভায় উপাচার্য অধ্যাপক ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার প্রধান অতিথি ও বুয়েটের উপউপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল জব্বার খাঁন বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এতে মুখ্য আলোচক হিসেবে বক্তব্য প্রদান করেন বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. খন্দকার সাব্বির আহমেদ। প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেন, আমাদের দেশপ্রেম আছে, সেটাকে যদি কাজে না লাগাই তাহলে হবে না। আমাদের বুয়েটের ওপর যে আস্থা আছে, সেটাকে যদি কাজে না লাগাই বা কোনো কাজে ব্যবহার না করি, তা হতে পারে না। আমাদের প্রযুক্তি আছে, আমরা গবেষণা করি, জ্ঞান তৈরি করি। সেটাকে কাজে লাগাতে হবে, আমাদের যা আছে তা ব্যবহার করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা যেকোনো কাজ করতে পারি। আমাদের শক্তি আছে, বুদ্ধি আছে, মেধা আছে। কাজেই আমাদের দক্ষতা, প্রযুক্তির প্রসার ঘটানো উচিত। আমাদের মেধা দিয়ে যাতে দেশের উন্নয়নে এগিয়ে আসতে পারি, আজকের দিনে আমাদের এই প্রত্যয় হওয়া উচিত। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের মাঠে পরিচালিত গণহত্যার ভিডিওচিত্র ধারণকারী বুয়েটের অধ্যাপক ড. নূরুল উলার অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে তিনি বলেন, নূরুল উলা স্যারের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বুয়েট ক্যাম্পাসে আমাদের কিছু একটা করা উচিত। সেটা হতে পারে নূরুল উলা স্যার যে ল্যাবরেটরিতে কাজ করতেন, সেটা উনার নামে নামকরণ করা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ভবন উনার নামে নামকরণ করা কিংবা নূরুল উলা স্যারের নামে স্কলারশিপ চালু করা। তাছাড়া, উনার নামে কোনো কিছু করা যায় কিনা সে বিষয়ে সরকারের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানো যেতে পারে। উপাচার্য বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের বুয়েটের ছাত্র-শিক্ষকদের ভালোবাসতেন। তিনি বুয়েটের প্রথম সমাবর্তনে এসেছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ডিন্যান্স করে দিয়েছিলেন। বুয়েটের ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কী রকম সম্পর্ক ছিল তা আমরা নূরুল উলার সঙ্গে সম্পর্ক দেখেই বুঝতে পারি। বুয়েটের ছাত্র-শিক্ষক বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন ছিল। তিনি নূরুল উলাকে ট্রান্সমিটার তৈরি করে দিতে আবদার করেছিলেন। আর নূরুল উলা মাত্র ৯ দিনে গোটা বাংলাদেশ কাভার করে এমন একটি ট্রান্সমিটার তৈরি করে দিয়েছিলেন। অধ্যাপক ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার আরও বলেন, অধ্যাপক নূরুল উলা জগন্নাথ হলের গণহত্যার ভিডিওচিত্র ধারণ করেছিলেন। তার এ কাজটি মুক্তিযুদ্ধের একটি দলিল। এ ভিডিও চিত্রটি মুক্তিযুদ্ধের একটি দলিল হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। এজন্য অধ্যাপক নূরুল উলা এবং তার কাজের স্বীকৃতি প্রয়োজন। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে কুয়েটের উপউপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল জব্বার খাঁন বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এত বর্ণাঢ্য ইতিহাস, আমাদের চর্চার অভাবে হারিয়ে যাবে, তা হতে পারে না। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের মাঠে গণহত্যার কিছু দুর্লভ ভিডিওচিত্র ধারণকারী বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক কৌশল বিভাগের তৎকালীন সহযোগী অধ্যাপক ড. নূরুল উলার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, আজকের এ স্বাধীনতা দিবসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সবার উদ্দেশ্যে বলতে চাই নূরুল উলা স্যারের অবদানের কথা বলি আর স্বাধীনতার মাধ্যমে আমাদের অর্থনৈতিক অর্জনের কথা বলি। যা বলি না কেন সবকিছুকেই যদি সমুন্নত রাখতে চাই তাহলে আমাদের কিছু বিষয়ে ভূমিকা রাখতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ধরনের সংগঠন আছে। সেসব সংগঠনের মাধ্যমে আমাদের বিভিন্ন দিবস যেমন: স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, জাতীয় শোক দিবসে সুর্নিদিষ্ট কিছু কার্যক্রম দেখতে চাই। কারণ, একটি কথা বলা হয়, যখন আপনি সংস্কৃতি চর্চা থেকে দূরে সরে যাবেন তখন অপসংস্কৃতি, অপ দিয়ে যা কিছু আছে সবকিছু সেখানে আস্তে আস্তে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ে গ্রাস করে। আমি আমাদের এ ক্যাম্পাসে এসব জাতীয় প্রোগ্রাম দেখতে চাই। কেন এখানে দুই দিনব্যাপী স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান হবে না? কেন এখানে দুই দিনব্যাপী বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান হবে না? মুক্তিযুদ্ধসহ আমাদের এত বর্ণাঢ্য ইতিহাস, আমাদের চর্চার অভাবে তা হারিয়ে যাবে, তা হতে পারে না। সভায় মুখ্য আলোচকের বক্তব্যে বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক খন্দকার সাব্বির আহমেদ বলেন, আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে অবদান রেখেছেন। কিন্তু, ড. নূরুল উলা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে ভিডিও করেছেন সেটা আমাদের সংরক্ষণ করতে হবে। বুয়েটের প্রযুক্তি কাজে লগিয়ে এআই ব্যবহার করে এ ডকুমেন্টকে আরও আপডেট করা যেতে পারে। স্বাধীনতার এসব দলিলসমূহ সংরক্ষণ করতে হবে অন্যথায় ইতিহাস বিকৃতি ঘটতে পারে। সভায় বুয়েটের শিক্ষক ড. নূরুল উলার ধারণকৃত ভিডিও যেটি এনবিসি নিউজে প্রকাশ করা হয়েছিল সেটি প্রদর্শন করা হয়। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে ড. নূরুল উলার সাক্ষাৎকার সম্বলিত একটি লিফলেট প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। বুয়েটের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. ফোরকান উদ্দিনের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় বুয়েটের সিন্ডিকেট সদস্য, ডিন, বিভাগীয় প্রধান, ইনস্টিটিউট, পরিদপ্তর ও দপ্তরের পরিচালক, হল প্রভোস্ট, শিক্ষকবৃন্দ ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।
২৭ মার্চ, ২০২৪

হবিগঞ্জে চা বাগানে প্রথমবারের মতো স্বাধীনতা দিবস উদযাপন
হবিগঞ্জের বাহুবল চা বাগানে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে ব্যতিক্রমী এক স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করা হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে মঙ্গলবার (২৬ মার্চ) বাহুবল উপজেলার শিতলাছড়া চা বাগানের প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে বিভিন্ন খেলাধুলার আয়োজন করা হয়। এ সময় আলোচনা সভাও অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন দ্বারিকাপাল মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ নসরুল হক। বক্তব্য দেন বাহুবল মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নিলুফার ইয়াসমিন, এসেডের নির্বাহী পরিচালক জাফর ইকবাল চৌধুরীসহ স্থানীয় লোকজন। পরে অতিথিরা শিক্ষার্থীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। স্থানীয়রা জানান, স্বাধীনতার পর এই প্রথম এখানে কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সম্প্রতি একটি এনজিওর মাধ্যমে বাগানের শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার  জন্য একটি প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। মূলত এই স্কুলের উদ্যোগেই স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করা হয়েছে। স্কুল প্রতিষ্ঠার পর চা শ্রমিক সন্তানরা শিক্ষার মুখ দেখতে পারছে বলেও স্থানীয় শ্রমিকরা জানিয়েছেন। 
২৭ মার্চ, ২০২৪

স্বাধীনতা দিবস ক্রিকেটে লাল দলের জয়
স্বাধীনতা দিবস ক্রিকেটে ১১ রানে বাংলাদেশ লাল দল হারিয়েছে বাংলাদেশ সবুজ দলকে। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে আগে ব্যাটিং করে নির্ধারিত ১০ ওভারে ৬ উইকেটে ১২০ রান করেছিল বাংলাদেশ লাল একাদশ। জবাবে বাংলাদেশ সবুজ একাদশ ১০৯ রানে থামে। জাভেদ ওমর ২৭ বলে ৪০ রানে অপরাজিত ছিলেন। মোহাম্মদ রফিক ৩৩ বলে ৬৬ রানে অপরাজিত থাকলেও দলকে জেতাতে পারেননি। আগে ব্যাটিং করে বাংলাদেশ লাল একাদশ ৬ উইকেট হারিয়ে ১২০ রান তুলেছিল। দুই ওপেনার ভালো করতে পারেননি। মেহরাব হোসেন অপি এবং হান্নান সরকার যথাক্রকে ৮ ও ১০ রান করেন। ফয়সাল হোসেন ১৭ বলে ৩৪ রান করেন। তুষার ইমরান করেন ১৬ বলে ৩১ রান। ১১ বলে ২০ রানে অপরাজিত ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। অতিরিক্ত খাতায় জমা হয় ১৩ রান। সজল চৌধুরী দুটি উইকেট নেন। রাজিন সালেহ এবং নাজমুল হোসেন একটি করে উইকেট নেন। সবুজ দলের পক্ষে দুই ওপেনার দারুণ ব্যাটিং করলেও তারা দলকে জেতাতে পারেননি। দুজনেই ৬টি করে বাউন্ডারি মেরেছেন। ৪টি ছক্কা মারেন রফিক। স্বাধীনতা দিবস উন্মুক্ত আরচারি স্বাধীনতা দিবস উন্মুক্ত আরচারি প্রতিযোগিতায় দেশের ৯ দল অংশগ্রহণ করে। রিকার্ভ ও কম্পাউন্ড ডিভিশনে পুরুষ ও নারী বিভাগে ৯১ তীরন্দাজ অংশগ্রহণ করেন। আসরে শুধু একক ইভেন্টে খেলা হচ্ছে। পল্টনের নূর হোসেন ভলিবল স্টেডিয়ামে সন্ধ্যার পর লাল দল ও সবুজ দলের মধ্যেকার এক প্রীতি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২০ দলের খেলোয়াড়রা দুই দলে বিভক্ত হয়ে প্রীতি ম্যাচে অংশগ্রহণ করেছে।
২৭ মার্চ, ২০২৪

ইস্টার্ন ভার্সিটিতে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন
মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। উপাচার্য অধ্যাপক ড. সহিদ আকতার হুসাইনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য ও সাবেক চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলাম। অতিথি ছিলেন বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী আজ্জম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স ও ইন্টারন্যাশনাল অফিসের ইনচার্জ ফরহাদ হোসেন মল্লিক। বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক শামছুল হুদা, মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. শরীফ মুনিরুজ্জামান সিরাজী, রেজিস্ট্রার ড. আবুল বাশার খান প্রমুখ।
২৭ মার্চ, ২০২৪

রোখসানা সুলতানার নিবন্ধ / ডায়েরি ১৯৭১
রাত দশটার সময় প্রথম কামানের শব্দ। রাজধানীর রাস্তাতে ট্যাঙ্ক। রাতে ঘুমাতে যাবার আগে বাধা পেলাম। একটা হট্টগোল, চিৎকার, মনে হচ্ছে শনিবারের জন্য যে হরতাল ডাকা হয়েছে তারই পূর্বমুহূর্তের প্রস্তুতি। আমরা সবাই নিশ্চিত মনে ঘুমাতে গেলাম, শুলাম ঘুমালাম জেগে উঠলাম। চারদিকের নীরবতা ভেদ করে বুলেটের শব্দ। তারপর হাজার হাজার। কামানের শব্দ শুনছি ইকবাল হলের দিকে। জানিনি তখনও কী হচ্ছে। সব মেনে নেবার পর আর কি দরকার থাকতে পারে কামানের। বুঝিনি এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা হতে পারে। কেন জানি মনে হচ্ছিল ভুট্টোকে আক্রমণ করতে গিয়েছিল—তারই ফলাফল শুনছি। কারণ মোটেও বিশ্বাস হয়নি বিনা উস্কানিতে কামানের দরকার হতে পারে... ১ মার্চ ১৯৭১ : ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করতে করতেই হঠাৎ মিছিলের আওয়াজ শুনলাম। পরে জানলাম ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করেছে। অবাক লাগে, এত শোষণ করার পরও এত সাহস কেমন করে হলো। সারা ঢাকা অশান্ত। ক্রিকেট মাঠে খেলোয়াড়দের মারা হয়েছে। চিৎকার, খোদা জানে কী হবে। কাল হরতাল। মুজিবুর রহমান ন্যায়সংগত কথাই বলেছেন। দেশের জন্য চিন্তা, মোস্তফার জন্য ভাবনা। যেরকম ছেলে, হয়তো মিছিলের পুরোভাগেই থাকবে। কেন আজ ওকে একটু সাবধান করে দিলাম না। বোকার মতো বাংলা একাডেমিতে ওকে ফেলে রেখেই চলে এসেছি। কথা পর্যন্ত বললাম না। যদি ও কাল আসত। আমার কোনো আশাই কোনোদিন অপূর্ণ থাকে না। যদি এটাও হতো। ভাইয়া যদি ইতালি থেকে চলে আসত কোনো গণ্ডগোল হবার আগে। ২ মার্চ ৭১ : সারাটা দিন গণ্ডগোল হয়েছে। রাত ৮টার কারফিউ দিয়ে আবার কয়েকজনের রক্তে ঢাকা লাল রং ধরেছে—তাই চৈত্রের বুগেনভেলিয়া এত লাল হয়। কারণ প্রতিটা রক্তপাত এদিনে হয়। চিন্তা ভাইয়ার জন্য, মোস্তফার জন্য অহেতুক চিন্তা। দেশ। বাংলা। নাহ, কিছুই ভালো লাগছে না। ৩ মার্চ ৭১ : ইয়াহিয়া খান ঢাকায় পার্লামেন্টারি নেতাদের সম্মেলন ডেকেছেন। ঈশ্বর জানেন এবার শান্ত হবে না সবাই। যদি আবার আগের মতো শান্ত হয়ে যেত। সবার কোনো সংবাদ যদি পেতাম তাহলে বেশ হতো। মুজিব সবাইকে শান্তির জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। ৬ মার্চ ৭১ : ২৫ তারিখ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের সম্মেলন ডেকেছে। জানি না এবার সবাই শান্ত হবে কি না। ভাইয়া কবে আসবে জানি না। মা-আব্বা ওর জন্য দুশ্চিন্তা করছেন। ও এলে একসাথে হওয়া যেত। মোস্তফা এলে পারত একদিন। ইউনিভার্সিটি বুধবার খুলবে। অনেকদিন নয় কি। ৭ মার্চ ৭১ : রেসকোর্সের ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির অধিবেশনে যোগ দেবার জন্য ৪ দফা দিয়েছেন। এসব মানলে উনি যোগ দেবেন। নির্ভেজাল সত্যি যে ইয়াহিয়া এসব মানবে না। সুতরাং পূর্ববাংলার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। ঈশ্বর জানেন কী হবে, কোথায় আমরা যাব। আশ্চর্য লাগে এত অরাজকতাকে কীভাবে শান্ত করবে সরকার। এর জন্য দায়ী আমাদের নেতারা। অসহযোগ আন্দোলন চলবে। আর ভাবা যায় না অথবা স্বপ্নও দেখা যায় না। ভাষণটি রেডিও থেকে প্রচারের কথা থাকলেও তা প্রচার করা হয়নি। ঢাকা বেশ চুপচাপ। সরকারি অফিস শুধু চলছে। আর সবই বন্ধ। মনে হয় অনেকেই একটা শঙ্কার আশা করছে। ১২ মার্চ ৭১ : শরীরটা খারাপ ছিল বলে একমাত্র নিজেকে ছাড়া আর কাউকে ভাবিনি। বাংলাদেশ। আজকাল এ চিন্তাও করি না—করব কি? ভেবে পাই না বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী? স্বাধীন বাংলা আমরা সবাই চাচ্ছি—অথচ যাদের মাধ্যমে পেতে চাচ্ছি তারা বলছে সংহতিতে তারা বিশ্বাসী। সুতরাং আমরা তো আর কথাতে স্বাধীনতা আনতে পারব না—অতএব কোনো চিন্তা নেই। একমাত্র চিন্তা কবে আবার সব স্বাভাবিক হবে। ভিয়েতনাম আমরা হতে চাই না—আমরা বাংলার মানুষেরা শুধু চাই শান্তিতে থাকতে। একদম শান্তিতে ভরা বাংলাদেশ। ১৫ মার্চ ৭১ : প্রেসিডেন্ট আজ আসছে। এর পরই বোঝা যাবে কী হতে পারে পাকিস্তানের অথবা একা বাংলাদেশের। ইয়াহিয়া খান বোকা হলে এর পরও কোনো গোলমাল করতে চাইবে—না হলে নয়। বরং মুজিবের সব মেনে নিয়ে দেশকে কিছুদিনের জন্য স্বাভাবিক হতে দেবে। তারপর জনতার ওপর যখন আস্থা হারাবে মুজিব, তখনই হয়তো কিছু একটা করবে। কিন্তু আর পারবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের লোকেরা সব বুঝতে শিখেছে। ১৬ মার্চ ৭১ : ইয়াহিয়া খানের সাথে আজ বেলা এগারোটার সময় মুজিব কথা শুরু করেছে প্রেসিডেন্ট ভবনে। দেখা যাক কী হয়। ১৯ মার্চ ৭১ : আলোচনা চলছে। সব আগের মতো। অসহযোগ আন্দোলন চলছে। দ্বিপক্ষীয় আলোচনা (মুজিব-ইয়াহিয়া) চলছে। এরপর কোনোরকম সমঝোতায় আসা একান্তভাবে দরকার। ২১ মার্চ ৭১ : ভুট্টো আজ ঢাকায় এসেছে। জানা অথবা বোঝা যাচ্ছে না ঠিক কী হবে। মোট কথা একটা কিছু সমঝোতায় আসা একান্তভাবে দরকার। আর কতদিন অসহযোগ আন্দোলন। হয় স্বাধীনতা, নয় কোয়ালিশন করতে হবে। ২৫ মার্চ ৭১ : রাত দশটার সময় প্রথম কামানের শব্দ। রাজধানীর রাস্তাতে ট্যাঙ্ক। রাতে ঘুমাতে যাবার আগে বাধা পেলাম। একটা হট্টগোল, চিৎকার, মনে হচ্ছে শনিবারের জন্য যে হরতাল ডাকা হয়েছে তারই পূর্বমুহূর্তের প্রস্তুতি। আমরা সবাই নিশ্চিত মনে ঘুমাতে গেলাম, শুলাম ঘুমালাম জেগে উঠলাম। চারদিকের নীরবতা ভেদ করে বুলেটের শব্দ। তারপর হাজার হাজার। কামানের শব্দ শুনছি ইকবাল হলের দিকে। জানিনি তখনও কী হচ্ছে। সব মেনে নেবার পর আর কি দরকার থাকতে পারে কামানের। বুঝিনি এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা হতে পারে। কেন জানি মনে হচ্ছিল ভুট্টোকে আক্রমণ করতে গিয়েছিল—তারই ফলাফল শুনছি। কারণ মোটেও বিশ্বাস হয়নি বিনা উস্কানিতে কামানের দরকার হতে পারে। ২৬ মার্চ ৭১ : আজিমপুরের দুটো ফ্ল্যাটে পাকিস্তানি মিলিটারি ঢুকেছিল। সারাদিন কারফিউ ছিল। মাঝে মাঝেই মেশিনগানের শব্দ আর পাঞ্জাবি মিলিটারির চলাচলের শব্দ। মাঝে কয়েকজন লোককে কলোনির ভেতর দিয়ে গোরস্তানের দিকে পালাতে দেখছি। কেন জানি ওদের অসহায় মনে হচ্ছিল না। ক্ষুদিরাম সূর্য সেন যেন ওরাই। নেতাজি সুভাষ বোসের শিষ্য। ওরা অমৃতের সন্তান, ওদের মৃত্যু নেই। চারদিকে আগুন, একটা বাংলাদেশের ফ্ল্যাগও কোথাও নেই। ২৭ মার্চ ৭১ : কারফিউ কিছুক্ষণের জন্য ছেড়েছে। বাসার নিচ দিয়ে অনবরত কাফেলা চলছে। বস্তির পর বস্তি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ওদের নিঃস্ব করা হয়েছে। ঢাকা ছেড়ে ওরা চলে যাচ্ছে। কোথায় যাবে তাও অনেকে বলতে পারে না। ওদের মুখেই শুনলাম রাস্তায় রাস্তায় নাকি লাশ পড়ে রয়েছে। বাসায় পানি নেই। প্রচণ্ড গরম। একটা হাহাকার ভাব চারদিকে। হাসি নেই, কান্নাও নেই। শুধু যেন একটা প্রশ্ন, বিংশ শতাব্দীতে এ কোন যুগে গেলাম। রাজ্য জয়ের অদ্ভুত নিদর্শন। রাতে বেশ কয়েকবার ফায়ারিংয়ের শব্দ শুনেছি। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা একেবারে ম্যাসাকার করে ফেলেছে। কেউ একজন বলল, বটগাছটা নাকি উপড়ে ফেলেছে। কতজন মরেছে তার কোনো হিসাব নেই। ২৮ মার্চ ৭১ ভারতের রেডিওতে বাংলাদেশের অত্যাচারের কথা বলা হয়েছে। লোকসভাতে এ নিয়ে কথা হবে আগামীকাল। ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। ২৯ মার্চ ৭১ রেডিও ঢাকা থেকে বলা হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানকে ধরা হয়েছে। জানি না কতদূর সত্যি। ৩০ মার্চ ৭১ কাল রাতে আকাশবাণী থেকে বলা হয়েছে মুজিবুর রহমান বিদেশি একটা দূতাবাসে রয়েছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ধরেছিলাম। সেখানেও বলল মুজিবুর রহমান ভালো। টিক্কা খানকে প্রেসিডেন্ট হাউসে যেয়ে মারা হয়েছে। এও জানি না কতদূর সত্যি। আমার কথা টিক্কা খানকে মারলেই কি সব শান্ত হবে। প্রত্যেকটা পাঞ্জাবি এক একটা টিক্কা খান, কি তার চেয়েও দুর্ধর্ষ। সবাই এক সমান। আমাদের ওরা সম্পূর্ণভাবে না মেরে শান্তি পাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক অধ্যাপক নাকি মারা গিয়েছেন। ৩১ মার্চ ১৯৭১ বাসা ছেড়েছি। কোথায় যাব জানি না। আপা ঢাকায় থাকবেন। সরকারি চাকরি—জমানো কোনো টাকা নেই, সুতরাং চাকরি না করে উপায়ও নেই। আমাদের বাড়িতে (দাদার বাড়ি) পাঠিয়ে দিলেন। চলে গেলাম। একদম দেশের বাড়ি। পথে পথে শুধু মানুষ, সবাই পালাচ্ছে। অনেকে জানে না কোথায় যাবে। কিছু রিকশায়, কিছু হেঁটে, কিছু বাসে করে রাতে বাড়িতে পৌঁছেছি। সারাদিনের ক্লান্তির পর নিরাপদ আশ্রয়ে নিজেকে দোষী মনে হয়েছে। অনেকে যখন মৃত্যুর সাথে করছে লড়াই, আমরা তখন বাঁচার জন্য নিরাপদ হতে গেলাম। ১ এপ্রিল ১৯৭১ একমাত্র আকাশবাণীর খবর শুনে কিছু বুঝি। গ্রামে গুজবের শেষ নেই। নতুন নতুন লোক আসছে, যা নয় তার চেয়ে অনেক বেশি বলছে বাহাদুরি নেবার জন্য। অথচ ওরা বোঝে না গুজব অন্তত এখন ছড়ানো উচিত নয়। সবাইকে কিছুটা আশ্বাসের কথা শুনিয়ে শান্ত করা দরকার। গ্রামে কেউ বিশ্বাস করে না শেখ সাহেব ধরা পড়েছেন। ওদের মনের সেই বিশ্বাসই ওদের বাঁচিয়ে রেখেছে। তাই থাকুক—এটাই সবচেয়ে বড় আশ্বাস। ২ এপ্রিল ১৯৭১ ভাবি, এর শেষ কোথায়। একে সব অস্ত্র ব্যবহার করেছে পাকবাহিনী। জিনজিরাতে প্লেন থেকেও বোম্বিং করে মানুষ মেরেছে। কী করে আমরা পারব, যেখানে আকাশ থেকে আক্রমণ হচ্ছে! ইকবাল হলের ছেলেরা মরেছে, স্যাররা মারা গেলেন, রোকেয়া হলেও গিয়েছিল মিলিটারি। শহীদ মিনার ধুলার সাথে মিশিয়ে দিয়ে মসজিদ করা হয়েছে। দুঃখজনক হলেও বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই মসজিদ ভেঙে আবার বাঙালি একদিন এটাকে শহীদ মিনারই করবে। সুতরাং ধর্মকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলা উচিত না। গ্রামকে গ্রাম পোড়াচ্ছে। মুক্তি হবে—আমরা কাপুরুষরা তা বেঁচে থেকে ভোগ করব। ওদের পায়ে নত হয়ে তাই শ্রদ্ধাঞ্জিল দিতেও লজ্জা পাচ্ছি। আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেন পাকিস্তানকে সাহায্য দেয়ার কথা ভাবছে না। বাংলাদেশের অত্যাচার সম্বন্ধে ওরা অবগত হতে চায়। ৩ এপ্রিল ১৯৭১ এত অত্যাচার চেঙ্গিস খানের পর আর কী হয়েছে? গ্রামে বসেও সারাদিন মেশিনগান আর কামানের শব্দ পাই। একটা আতঙ্ক সবসময় কাজ করে, মিলিটারি আসবে কি না। গ্রামে অভাব। শহর থেকে অনেক লোক আসছে। কারও হাতে নগদ টাকা নেই। তেল নেই, চিনি নেই। ৪ এপ্রিল ১৯৭১ নজরুল ইসলাম আজ হাতিরদিয়া বাজার দিয়ে পালালেন। কোনদিকে যাবেন সে ব্যাপারে নাকি কারও কোনো কথার জবাব দেননি। তাজউদ্দীন, মোশতাক আগেই পালিয়েছেন। বাংলাদেশের চাঁদ এত আলো পাচ্ছে কোথা থেকে? এপ্রিল, ৭১ (গ্রামের বাড়িতে বসে) একে একে সংগ্রামময় দিনগুলো কেটে যাচ্ছে। সবাই উত্তেজিত। সাধারণ মানুষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছে আমরা কী পেলাম। পাওয়ার বিষয়টি এতদিন ১০% মানুষও জানত না। এবার এই যুদ্ধ সবাইকে বুঝতে শিখিয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের শোষণ করে এসেছে এবং তাই করবে এটা বুঝতে পেরেছে বলেই আমাদের এবারের স্বাধীনতা সংগ্রাম সফল হবেই। আমি নাইবা পারলাম স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে, কিন্তু হাজার হাজার বাঙালি ছেলে যেভাবে প্রাণ দিচ্ছে তার জন্যই তো আমার প্রাণ গর্বে ফুলে উঠছে যে আমি একজন বাঙালি। ১৯৪৭ সালের পর আমরা ওদের কাছ থেকে কী পেয়েছি? ১৯৫২ সালেই আমাদের (স্বাধীনতার মাত্র পাঁচ বছর পর) ভাষার জন্য আমাদের প্রাণ দিতে হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও আমরা আমাদের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য প্রাণ দিয়েছি। প্রাণ দিয়েই প্রাণের ভাষা পেয়েছি। সৃষ্টি হয়েছে আমাদের ২১ ফেব্রুয়ারি। ১৯৬২ সালে শিক্ষানীতি বর্জনের দাবিতে আবার কয়েকটা সোনার প্রাণ নষ্ট হয়েছে। ১৯৬৯ সালে হল ছাত্র আন্দোলন। তবু আমরা এক পাকিস্তানে বিশ্বাসী ছিলাম। চেয়েছি স্বাধিকার। বাঁচার মতন বাঁচতে চেয়েছি। পাঁচশালা পরিকল্পনার সব টাকা আসে পূর্ববাংলার পাট আর চা রপ্তানি থেকে। অথচ টাকা সব খরচ করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। মঙ্গলা বাঁধ দিয়ে মরুভূমিকে করা হয়েছে সজীব অথচ পূর্ববাংলায় আশ্রয় কেন্দ্রের অভাবে এক রাতে মারা যাচ্ছে পাঁচ লক্ষ লোক। প্রতি বছর বন্যাতে ঝড়ে আমরা মরছি। ওদের সাথে আমাদের চলা হবে না এ কথাটা তারা এবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। যতই দিন যাচ্ছে আমার মনে হচ্ছে এই যুদ্ধের প্রয়োজন ছিল। তা না হলে আমাদেরও চোখ খুলত না। ৭ কোটি বাঙালি আজ অন্তত বুঝতে পারছে আমরা প্রকৃতপক্ষে কী চাচ্ছি! স্বাধীনতা ছাড়া ওদের সাথে আর কোনো সমঝোতা নয়। অসহযোগ আন্দোলনেও অনেকের মতো আমারও মনে হয়েছিল একটা সমঝোতা, কিন্তু এখন আর তা চাচ্ছি না। দলে দলে লোক ভারতে যাচ্ছে। মুক্তিসেনা হচ্ছে। জয় আমাদের হবেই। দেশে মুসলিম লীগ আর জামায়াতদের দাপট বাড়ছে অত্যন্ত বেশি। সবাইকে এর শাস্তি পেতে হবে। পাঞ্জাবি মিলিটারিদের ক্ষমা করা হলেও দেশের রাজাকারদের ক্ষমা করা হবে না। একই দেশ, একই কৃষ্টি এবং একই ভাষাভাষী যখন সর্বনাশ করে তখন তাদের কী করে ক্ষমা করা যায়? জনসমক্ষে এদের হত্যা করতে হবে। মাঝে মাঝে গভীর রাতে বাংলার আকাশের দিকে চেয়ে থাকি। হিমেল হওয়া বাতাসের কান্না আকাশের চাঁদ কদমের সুবাস ঝিঁঝির ডাক—এত সুন্দর বাংলা আমার। কার প্রাণ চায় বাঙালির জীবনে অশান্তি আনতে। গ্রামবাংলা নিয়েই আমরা সুখী হয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম। ঝিঁঝি ডাকা রাতে কান পেতে ঝিঁঝি ডাক শুনতে শুনতে কেঁদেছি—কেন বাংলার মাটিতে এত রক্ত। সোনার বাংলাতে এত লাল পলাশের রং কেন! আর সেই লাল রক্ত যে আমার প্রাণেও আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। চলে যেতে ইচ্ছা হয় মুক্তিবাহিনীতে। বাংলার শ্যামলিমাকে আবার ফিরিয়ে এনে সেই শহীদ মিনারের গায়ে মাথা রেখে প্রাণ ভরে যদি কাঁদতে পারতাম। আমি অতি সাধারণ। আমি তাই কাঁদতে চাই। বাংলার কান্না আমার আর সহ্য হচ্ছে না। তোমরা আমাদের ক্ষমা করো। ১২ এপ্রিল ১৯৭১ বিপ্লব ভরা দিন এমনি করেই এগিয়ে যাবে। তোমাদের চলার পথ চোখের জলে ভিজিয়ে অমঙ্গল করে দেব না। তোমরা আগাও আমরা কাপুরুষ তবু আমরাও বাঁচতে চাই স্বাধীনভাবে স্বাধীন রাষ্ট্রে। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ আজ বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার শপথ নিয়েছে কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে। তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট। জানি না মেহেরপুরে একটা ঘরও বোমার হাত থেকে রেহাই পাবে কি না। তবুও ওরা শপথ নিয়েছে। স্বীকৃতি পেলে হয় কোনো বড় দেশের। ২১ মে ১৯৭১ ঢাকার বাসায় ফিরে এলাম ২০ দিন পর। মনে হচ্ছে এত নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছেড়ে কেন বোকার মতো গিয়েছিলাম। এখানে থেকে মরতেও ভয় নেই। সবাই একসাথে আছি। আব্বা একা থাকতেন সেটাই বেশি ভয় ছিল। ৬ মে ১৯৭১ পঙ্গু জীবনের সমাপ্তি কবে কে জানে। বয়স্ক ছেলেরা ঘরে বসে রয়েছে। মেয়েরা জানালা দিয়ে তাকাতে চাইছেন। আমাদের জেনারেশন হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা হারিয়ে যাচ্ছি প্রবল পঙ্গুতার ভিড়ে। কোথাও ঠাঁই নেই। শান্তি নয় স্বাধীনতা। একমাত্র চিন্তা, একমাত্র ভাবনা। মরছি আরও মরব। ২১ জুন ১৯৭১ এক একে শহরগুলো হাতছাড়া হচ্ছে। অনেক মৃত্যুর খবর শুনছি। আশেপাশে অনেক খবর। বিচ্ছিন্নভাবে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করছে। মারছে এবং মরছে। ২২ জুন ১৯৭১ ২৮ তারিখে সেনাপতির ভাষণ আছে। দেখি ছক্কু মিয়া কী বলে। ২৮ জুন ১৯৭১ ছক্কু মিয়ার ভাষণ আজ হলো। সেই পুরোনো কথা। সব দোষ পূর্ববাংলার লোকেদের। সেনাবাহিনী উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছে। ৫ জুলাই ১৯৭১ আমাদের বাসার উল্টোদিকে নিউপল্টন লাইনে খসরুর বাসা। প্রায় প্রতি রাতেই ওদের বাসায় মিলিটারি আগুন লাগায়। সেই আগুন দেখে আশেপাশের সবাইকে ভয় পাইয়ে দেয়াই আর্মির কাজ। কারণ খসরু ইন্ডিয়াতে এবং যতদূর সম্ভব কোনো সেক্টরে যুদ্ধ করছে। ২১ জুলাই ১৯৭১ এখন মা বাজার করেন। ভাইয়া অথবা আব্বাকে বাজারে পাঠানো হয় না। আর আমাদের পক্ষে তো যাওয়াই সম্ভব নয়। পথ থেকে তুলে নিয়ে যাবে। ৩ আগস্ট ১৯৭১ মুক্তিবাহিনী ঢাকা ছাড়বার জন্য বলছে। কী লাভ ঢাকা ছেড়ে। ছোট্ট পূর্ববাংলা। সব জায়গাতে একই কথা। তার চেয়ে বরং এখানে থেকেই মরে যাব, সেই ভালো। সরাসরি মুক্তিবাহিনী হতে না পারাটাই একটা লজ্জা, তাছাড়া কোন লজ্জায় বাঁচার জন্য ছুটে বেড়াব। স্বাধীনতা সংগ্রামে নয়তো ঘরে বসেই মরব। সেই ভালো। অনেকদিন বেঁচেছি—অনেক দেখাও হলো—আর বেঁচে থেকে যদি কোনো কাজেই না আসতে পারি তাহলে কোনো লাভ নেই বেঁচে থেকে। ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধে যাইনি সত্যি, কিন্তু প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হচ্ছে একটা বিরুদ্ধ শক্তির সাথে। প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য অথবা প্রয়োজনীয় কাজে বাইরে যাওয়া দূরে থাক, কারও মারা যাবার খবর শুনলেও বের হওয়া যায় না। ভারতে যাব, আমাদের কেউ নেই। তাছাড়া আব্বার এমন কোনো টাকাও নেই যে সেটা হাতে নিয়ে চলে যাব। চাকরি না করলে কালকে খাবার মতো কিছু থাকবে না। ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ ইউনিভার্সিটি গিয়েছিলাম। এমনিতেই ঘুরতে। ঢাকা আগের মতো নেই। চারিদিক শান্ত। যদিও পাক সরকার ঢাকাকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ হঠাৎ করে কোনো ফেরিওয়ালা দেখলে মনে হয় বোধহয় মুক্তিবাহিনী। না চাইলেও পানি খেতে দিই, যদি মুক্তিবাহিনী হয়ে থাকে, একটু পানি তো খাওয়ালাম। ১১ অক্টোবর ১৯৭১ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বোম ফুটেছে। মুক্তিবাহিনী মেরেছে। ২৫ অক্টোবর ১৯৭১ সেই দিনগুলোকে ফিরে পেতে ইচ্ছা করে। আগের মতো করে, আগের সুরে আমরা কি আর কথা বলতে পারব। ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ রাত তিনটা পাঁচ মিনিটে প্রচণ্ড শব্দে জেগে উঠলাম। শুনলাম সাইরেনের আওয়াজ। বিশ্বাস হলো না এয়ার অ্যাটাকের তলে পড়লাম আমরা। তারপর জেগে কাটালাম। বোম্বিং হলো। রাতটা না ঘুমিয়ে কাটালাম। ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ এয়ারপোর্ট পুরো বিধ্বস্ত হয়েছে। পাকিস্তানি জাহাজ আর উড়তে পারবে না। ঈশ্বর কি সত্যি মুখ তুলে তাকাবে। আমরা কি সত্যিই মুক্ত হবো। অনেক আতঙ্কের মাঝেও অনেক সান্ত্বনা। সারাদিন প্রচুর বোম্বিং হয়েছে। ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ আজকের দিনটা একবারও সাইরেন পড়েনি। মনে হচ্ছে আমরা যেন নতুন সূর্যের স্বপ্ন দেখতে পারি। মনাক্কার বিয়ে আজকে। ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানি আর্মি হেলিকপ্টার থেকে বোম্বিং করেছে। এতিমখানার ওপর। অনেক শিশু মারা গিয়েছে। মনে হচ্ছে ওরা আমাদের মারবে। বেসামরিক লোকদের ওপর ইন্ডিয়ানরা বোম্বিং করছে না বলেই ওরা এ পন্থা বের করেছে। ঈশ্বরের কাছে কি ন্যায়ের জয় নেই। ওদের ধ্বংস কতদিনে হবে। দিন কি আজও ফুরাবে না? শুধু খিচুড়ি খাচ্ছি। বাসায় পানি নেই। ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১ অনেক লোক শহর ছেড়ে পালাচ্ছে। ভয়ে নয়—এক দৈত্যের আতঙ্ক থেকে রেহাই পাবার জন্য। রাতে আঁধারে বেসামরিক লোকদের ওপর পাকবাহিনী বোমা ফেলেই চলেছে। নিয়াজির পতন কতদিন। রাও ফরমান আলির সারেন্ডার করবার ইচ্ছা সত্ত্বেও নিয়াজির জন্য পারছে না। ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১ আজিমপুরের সাতটা বাড়ি আর্মিরা নিয়ে নিয়েছে। ওরা সিভিলিয়ন এলাকায় থাকবে—যাতে বোম্বিং ভুল জায়গায় হয়। কাল হয়তো আমরাও বাসা ছাড়ব। ১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ টুকুন খালার বাসায় চলে এসেছি। নাসিমরাও এসেছে। দেখি বাঁচতে পারি কি না। বাঁচার জন্য যে এত স্বাদ তা আগে বুঝিনি। আজ আমারও বারবার বলতে ইচ্ছা করছে ভালোবেসে হায় মিটিল না স্বাদ—এ জীবন এত ছোট কেন? ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ মৃত্যুর মুখোমুখি কাটালাম। রায়ট হলো। বিহারিরা শেষবারের মতন বাঙালিদের মেরে নিল। আমরা ওদের ক্ষমা করব না। বাঙালিরা মৃত্যু পর্যন্ত বিহারিদের ঘৃণা করতে শিখুক—এ প্রার্থনা করছি। ওদের যেন ক্ষমা না করি। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এরই নাম বোধহয় স্বাধীনতা। স্বাধীনতার আনন্দ যে এত সুন্দর আগে জানতাম না। হাসতে ইচ্ছা করছে বারবার। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে সবাইকে ‘আমরা স্বাধীন’। কোনো কষ্টই করিনি স্বাধীনতার জন্য। তবু নিজেকে এত মুক্ত মনে হচ্ছে কেন? বাংলার হাসি আজ আকাশে বাতাসে। নিয়াজি সারেন্ডার করেছে। সারেন্ডার পত্রে সাইন হয়েছে ৫টা ১ মিনিটে। আমরা স্বাধীন। আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। ইয়াহিয়া ভুট্টো আজও বিশ্বাস করতে পারছে না পূর্ব পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে। সবাই খুশি। ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ চারিদিকে হাসি। বেলা ২টার সময় রেডিও বাংলাদেশ, ঢাকার স্টেশন থেকে অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়েছে। সন্ধ্যা ৬-৩০ মিনিটে টিভি উদ্বোধন করেছে মেজর হায়দার (মুক্তি)। আমার চোখে সে দেবতা। ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ রাস্তায় রাস্তায় জয় বাংলা ধ্বনি। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী একসাথে রাস্তায় চলাচল করছে। পথে অনেক লাশ দেখলাম। মুনীর চৌধুরীকে হত্যা করেছে আলবদর বাহিনী। আরও অনেক বুদ্ধিজীবীকে মেরেছে। স্বাধীনতার জন্য অনেক রক্ত গেল।
২৬ মার্চ, ২০২৪

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা
স্বাধীনতার পক্ষের সবার ধারণা যে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিই আদপে স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা। এটা ছিল বাঙালিদের জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা। আর ২৫ মার্চ রাতের একাধিক ঘোষণা ছিল দুদেল বান্দা কলমাচোরদের সন্তুষ্টি ও বিশ্ববাসীর অবগতির জন্য। সেদিন তিনি যে তিনটি ঘোষণা দেন তার প্রথমটি ছিল: ‘THIS MAY BE MY LAST CALL. FROM TODAY BANGLADESH IS INDEPENDENT. I CALL UPON THE PEOPLE OF BANGLADESH WHEREVER YOU MIGHT BE AND WITH WHATEVER YOU HAVE, TO RESIST THE ARMY OF OCCUPATION TO THE LAST. YOUR FIGHT MUST GO ON UNTIL THE LAST SOLDIER OF THE PAKISTAN OCCUPATION ARMY IS EXPELLED FORM THE SOIL OF BANGLADESH AND FINAL VICTORY IS ACHIEVED.’ এ ঘোষণাটি ২৫ মার্চ দুপুরেই বঙ্গবন্ধু নূরুল হক নামের একজন বিভাগীয় প্রকৌশলীর কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। জনাব হক রাত সাড়ে ১০টার আগেই তা ইথারে ছেড়ে দিয়েছিলেন। নূরুল হক সম্পর্কে যেটুকু জানা যায় তা হলো, বঙ্গবন্ধু তাকে ট্রান্সমিটার সমেত ২৫ মার্চের আগেই খুলনা থেকে ঢাকায় এনেছিলেন। ২৫ মার্চ পাকিস্তানিদের অপারেশন সার্চলাইটের অগ্রগতি জেনেই তিনি এ ঘোষণাটি নূরুল হকের কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। নূরুল হক বলধা গার্ডেন থেকে সে মেসেজটি পাঠিয়েছিলেন। শহীদ প্রকৌশলী এ কে এম নূরুল হক সম্পর্কে তার স্ত্রী ও কন্যা জানান যে, তিনি ট্রান্সমিটার তৈরিতে পারদর্শী ছিলেন এবং পাকিস্তান সরকার তাকে সেজন্য তমঘা-ই-ইমতিয়াজ খেতাবে ভূষিত করেছিল। তিনি ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের কাছে ‘খোকা ভাই’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ২৫ মার্চ দুপুরে তিনি আমিরুলকে জানিয়েছিলেন যে, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে খুলনা হতে একটি শক্তিশালী ট্রান্সমিটার এনেছেন এবং তা দিয়ে কী করতে হবে তা সম্পর্কেও সম্যক অবগত আছেন। It will cost my life but I will do it বলেও মন্তব্য তিনি করেন, অর্থাৎ সাধারণভাবে তিনি জেনেশুনে বিষপানের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। নূরুল হক যে রাত সাড়ে ১০টার আগেই ঘোষণাটি ইথারে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, তা বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী হাজি মোর্শেদের বর্ণনায় এসেছে। তিনি তার ভাষ্যে আরও যা বলেছেন তা নিম্নরূপ—‘আমি বলধা গার্ডেন থেকে বলছি। মেসেজ পাঠানো হয়ে গিয়েছে, মেশিন নিয়ে কী করব?’ বঙ্গবন্ধু, হাজি গোলাম মোরশেদের মাধ্যমে উত্তর দিলেন, ‘মেশিনটা ভেঙে পালিয়ে যেতে বল।’ ইতিহাস বলে বঙ্গবন্ধু একটা বিকল্প ব্যবস্থাও রেখেছিলেন সেটা ছিল অধ্যাপক নূরুল্লাহর ট্রান্সমিটার যা সময়মতো কাজ করেনি। ঘোষণাটি পাঠানোর খবর জেনেই বঙ্গবন্ধু হাজি মোর্শেদকে স্পষ্ট জানালেন, ‘আমরা স্বাধীন হয়ে গেলাম।’ একই কথা তিনি সাংবাদিক আতাউস সামাদকেও বলেছিলেন। ঘোষণাটি স্বাধীনতার একতরফা ঘোষণা বলে বিবেচিত হয়ে যেত যদি না অপারেশন সার্চলাইটের শুরুটা প্রায় দুই ঘণ্টা এগিয়ে এনে রাত ১১টায় করা হতো। অপারেশন সার্চলাইটের দুষ্কর্ম শুরুর প্রায় এক ঘণ্টা পরই বঙ্গবন্ধু তার দ্বিতীয় ঘোষণাটি প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন। তার নির্দেশে ইপিআর সুবেদার শওকত আলী তা প্রচার করেন। শওকত আলী তার সংরক্ষিত ওয়ারলেস সেটটি ব্যবহার করেছিলেন কিন্তু তিনি ইপিআর চিফের মাস্টটি ব্যবহার করেছিলেন। সে সময় একমাত্র এই মাস্টটি ছাড়া অন্যান্য মাস্ট সম্পূর্ণ অকেজো করে ফেলা হয়েছিল। এ ঘোষণার ভাষ্য ছিল: ‘To-day Bangladesh is a sovereign and independent state. On Thursday night West Pakistani armed forces suddenly attacked the police barracks at Rajarbagh and the EPR Headquarters at Peelkhana in Dacca. Many innocent and unarmed people have been killed in Dacca city and other places of Bangladesh. Violent clashes between the East Pakistan Rifles and Police on the one hand and the armed forces off Pindi on the other, are going on. The Bengalis are fighting the enemy with great courage for an independent Bangladesh. Resist the treacherous enemy in every corner of Bangladesh. May Allah help us.’ “JOY BANGLA” তিনি বন্দি হওয়ার কিছু আগে তৃতীয় আরেকটি ঘোষণাও প্রচার করেন যার ভাষ্য ছিল: ‘The enemy has struck us. Hit them back. Victory is ours. Insa Allah, Joy Bangla, Mujibur Rahman.’ কথিত আছে যে, তিনি পুলিশের ওয়ারলেস সেটের মাধ্যমে এ ঘোষণাটি প্রচার করিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু একজন রহস্যময় মানুষও ছিলেন। তিনি তার সব কর্মকাণ্ড সবার কাছে উন্মুক্ত করতেন না। যেমন তার সশস্ত্র যুদ্ধের সিদ্ধান্ত। ২৮ ফেব্রুয়ারিতে তার সঙ্গে শেষ দেখার সৌভাগ্য শেখ ফজলুল হক মনি ও আমার জীবনে ঘটেছিল। সেদিন তার মুখে সশস্ত্র যুদ্ধের অবশ্যম্ভাবিতা ও প্রস্তুতির কথা আমাদের জানার সৌভাগ্য হয়েছিল; কথাগুলো তেমন স্পষ্ট ছিল না, তবুও স্পষ্টত বুঝে নিতে কষ্ট হচ্ছিল না। তিনি অতি ধীরস্থির ও সুকৌশলীও ছিলেন। কনফেডারেশনের ব্যাপারে সম্মতিটি ছিল শেষ মুহূর্তে আলোচনা ভেঙে দেওয়ার মোক্ষম কৌশল। ছাত্র ও যুবনেতাদের জ্ঞাতসারেও সম্মতিতে তিনি তা করেছিলেন। ছাত্র ও যুবনেতাদের পরামর্শ ছিল এক লাখ প্যারামিশিয়া ও দুটো মুদ্রা ব্যবস্থার কথা আলোচনায় সংযোজন। যেহেতু মিলিশিয়ার কথাটি আগেই বলা হয়েছিল তাই শেষ মুহূর্তে দুই প্রদেশের জন্য দুটো পৃথক মুদ্রা ব্যবস্থার কথা বলা হলো, যা ধন্বতরী ওষুধের ন্যায় কাজ করল এবং ক্র্যাকডাউনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করল। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাগুলো মুক্তিযুদ্ধকালে কিংবা তার শাসনামলে কোনো বিতর্কের জন্ম দেয়নি। তার অপমৃত্যুর পরই এসবের সূত্রপাত হয়েছে এবং জিয়াউর রহমানের শাসনামল পেরিয়ে খালেদা জিয়ার শাসনামলে ফুলে-ফসলে পল্লবিত হয়েছে। এসব অপপ্রচারকে প্রতিহত করার প্রয়াস লক্ষণীয় তবে দুঃখের বিষয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বুদ্ধিজীবীদের কারও লেখায় বা বক্তৃতায় স্পষ্ট এসব ঘোষণার কথা এই সেদিনও উল্লেখ ছিল না। সাম্প্রতিককালে তার স্পষ্টতা ঘটেছে দুটো কারণে—একটি হচ্ছে হাইকোর্টের একটি রায়ে, আরেকটি তাজউদ্দীন কন্যার প্রকাশিত একটি গ্রন্থে। শেষোক্তজন ও খালেদা জিয়ার বিতণ্ডার কারণে বিষয়টি চূড়ান্ত রূপ নেওয়ারই কথা ছিল, তবে তা ঘটেনি। হাইকোর্টের রায়টি হচ্ছে বিচারপতি মাহফুজুল হক ও বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদের। ঐতিহাসিক দলিল দস্তাবেজ, প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য ও circumstantial evidence বিশ্লেষণ করে উচ্চ-আদালতের এ সিদ্ধান্তের পর আর কোনো সন্দেহের অবকাশ ছিল না যে, বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এবং এর বিপরীতে যে কোনো বাক্যবাণ বা আপ্তবাক্যই আদালত অবমাননার শামিল। এ দৃষ্টিকোণ থেকে শারমিন আহমেদের লেখার প্রসঙ্গটি আদালত অবমাননার শামিল তো নয়, যা পূর্বতন অনেক আলোচনা-সমালোচনা অবসানে ঘটাতে যথার্থ। তার লেখাটি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। শারমিন আহমেদের কিছু বিশ্লেষণ ও অনুসিদ্ধান্ত বিস্ফোরণমূলক। সেগুলো প্রকাশিত হয়েছে তার রচিত গ্রন্থ ‘তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা’ গ্রন্থের প্রথম দিকে। ২০১৩ সালে প্রকাশিত বইটির ভূমিকায় কিন্তু এসবের স্থান নেই, স্থান পেয়েছে পরবর্তী অধ্যায় কটিতে। বইটি প্রকাশের পর এবং বিশেষত তার ওপর সুধীজনের আলোচনা ঘিরে প্রচণ্ড বিতর্কও জমে উঠেছিল। এ বিতর্কে আমিও অবতীর্ণ হই এবং অন্যান্য বিতার্কিকের মতো আমিও কতিপয় উক্তি সংযোজন করি। এসব অযৌক্তিক ছিল তা বলব না। যা হোক, ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সংসদীয় কমিটি বঙ্গবন্ধুকে নেতা নির্বাচন করে সব সিদ্ধান্তের ক্ষমতা তাকে অর্পণ করে, যার সদ্ব্যবহার তিনি করেন। তাই ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ সাল থেকে স্বাধীনতার একমাত্র ঘোষক হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং তা তিনি ঢাকা থেকেই প্রচার করেন, অন্যরা কেবলমাত্র পাঠক। লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং উপাচার্য, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
২৬ মার্চ, ২০২৪

মহান স্বাধীনতা দিবস আজ
আজ ৫৪তম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। তারা সারা দেশে গণহত্যা চালায়। পাকিস্তানিরা তাদের নীলনকশার নাম দেয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’। একই সঙ্গে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে হানাদার বাহিনী। কিন্তু গ্রেপ্তারের আগে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে ঢাকায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।  বঙ্গবন্ধুর ওই ঘোষণা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে প্রচারিত হয়। স্বাধীনতা ঘোষণার পাশাপাশি যে কোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু। তৎকালীন ইপিআরের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে ঘোষণাটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরে চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ বেশ কয়েকজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। বঙ্গবন্ধু তার ঘোষণায় উল্লেখ করেন, ‘ইহাই হয়তো আমাদের শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছেন, যার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও—শেখ মুজিবুর রহমান; ২৬ মার্চ, ১৯৭১।’ দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে একটি ভূখণ্ডের, যার নাম বাংলাদেশ। মহান স্বাধীনতা দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপনের লক্ষ্যে বর্ণিল কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। দিনটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। এদিন ঢাকাসহ সারা দেশে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবস উদযাপন শুরু হবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর নেতৃত্বে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি কূটনীতিক, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। দিবসটি উপলক্ষে সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাগুলো আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হবে। দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে এদিন সংবাদপত্রগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র, নিবন্ধ ও সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ করবে। এ ছাড়া ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করবে। দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে আওয়ামী লীগ, সহযোগী, সমমনা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো দুই দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এদিন সূর্যোদয় ক্ষণে বঙ্গবন্ধু ভবন, কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং সারা দেশে সংগঠনের সব কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। ভোর ৫টা ৫৬ মিনিট জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন। সকাল ৭টায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করা হবে। এ ছাড়া মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, গির্জাসহ সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দেশব্যাপী বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে।  এদিন সকাল ১১টায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের একটি প্রতিনিধিদল টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন এবং দোয়া ও মিলাদ মাহফিল কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করবেন। প্রতিনিধিদলে থাকবেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন, আফজাল হোসেন, সুজিত রায় নন্দী এবং কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ইকবাল হোসেন অপু। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে আওয়ামী লীগ। সভাটি ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় তেজগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 
২৬ মার্চ, ২০২৪
X