অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী
প্রকাশ : ২৬ মার্চ ২০২৪, ০২:২০ এএম
আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২৪, ০৮:৫৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা

স্বাধীনতার পক্ষের সবার ধারণা যে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিই আদপে স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা। এটা ছিল বাঙালিদের জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা। আর ২৫ মার্চ রাতের একাধিক ঘোষণা ছিল দুদেল বান্দা কলমাচোরদের সন্তুষ্টি ও বিশ্ববাসীর অবগতির জন্য। সেদিন তিনি যে তিনটি ঘোষণা দেন তার প্রথমটি ছিল: ‘THIS MAY BE MY LAST CALL. FROM TODAY BANGLADESH IS INDEPENDENT. I CALL UPON THE PEOPLE OF BANGLADESH WHEREVER YOU MIGHT BE AND WITH WHATEVER YOU HAVE, TO RESIST THE ARMY OF OCCUPATION TO THE LAST. YOUR FIGHT MUST GO ON UNTIL THE LAST SOLDIER OF THE PAKISTAN OCCUPATION ARMY IS EXPELLED FORM THE SOIL OF BANGLADESH AND FINAL VICTORY IS ACHIEVED.’

এ ঘোষণাটি ২৫ মার্চ দুপুরেই বঙ্গবন্ধু নূরুল হক নামের একজন বিভাগীয় প্রকৌশলীর কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। জনাব হক রাত সাড়ে ১০টার আগেই তা ইথারে ছেড়ে দিয়েছিলেন। নূরুল হক সম্পর্কে যেটুকু জানা যায় তা হলো, বঙ্গবন্ধু তাকে ট্রান্সমিটার সমেত ২৫ মার্চের আগেই খুলনা থেকে ঢাকায় এনেছিলেন। ২৫ মার্চ পাকিস্তানিদের অপারেশন সার্চলাইটের অগ্রগতি জেনেই তিনি এ ঘোষণাটি নূরুল হকের কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। নূরুল হক বলধা গার্ডেন থেকে সে মেসেজটি পাঠিয়েছিলেন। শহীদ প্রকৌশলী এ কে এম নূরুল হক সম্পর্কে তার স্ত্রী ও কন্যা জানান যে, তিনি ট্রান্সমিটার তৈরিতে পারদর্শী ছিলেন এবং পাকিস্তান সরকার তাকে সেজন্য তমঘা-ই-ইমতিয়াজ খেতাবে ভূষিত করেছিল। তিনি ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের কাছে ‘খোকা ভাই’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ২৫ মার্চ দুপুরে তিনি আমিরুলকে জানিয়েছিলেন যে, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে খুলনা হতে একটি শক্তিশালী ট্রান্সমিটার এনেছেন এবং তা দিয়ে কী করতে হবে তা সম্পর্কেও সম্যক অবগত আছেন। It will cost my life but I will do it বলেও মন্তব্য তিনি করেন, অর্থাৎ সাধারণভাবে তিনি জেনেশুনে বিষপানের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন।

নূরুল হক যে রাত সাড়ে ১০টার আগেই ঘোষণাটি ইথারে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, তা বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী হাজি মোর্শেদের বর্ণনায় এসেছে। তিনি তার ভাষ্যে আরও যা বলেছেন তা নিম্নরূপ—‘আমি বলধা গার্ডেন থেকে বলছি। মেসেজ পাঠানো হয়ে গিয়েছে, মেশিন নিয়ে কী করব?’ বঙ্গবন্ধু, হাজি গোলাম মোরশেদের মাধ্যমে উত্তর দিলেন, ‘মেশিনটা ভেঙে পালিয়ে যেতে বল।’ ইতিহাস বলে বঙ্গবন্ধু একটা বিকল্প ব্যবস্থাও রেখেছিলেন সেটা ছিল অধ্যাপক নূরুল্লাহর ট্রান্সমিটার যা সময়মতো কাজ করেনি। ঘোষণাটি পাঠানোর খবর জেনেই বঙ্গবন্ধু হাজি মোর্শেদকে স্পষ্ট জানালেন, ‘আমরা স্বাধীন হয়ে গেলাম।’ একই কথা তিনি সাংবাদিক আতাউস সামাদকেও বলেছিলেন। ঘোষণাটি স্বাধীনতার একতরফা ঘোষণা বলে বিবেচিত হয়ে যেত যদি না অপারেশন সার্চলাইটের শুরুটা প্রায় দুই ঘণ্টা এগিয়ে এনে রাত ১১টায় করা হতো। অপারেশন সার্চলাইটের দুষ্কর্ম শুরুর প্রায় এক ঘণ্টা পরই বঙ্গবন্ধু তার দ্বিতীয় ঘোষণাটি প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন। তার নির্দেশে ইপিআর সুবেদার শওকত আলী তা প্রচার করেন। শওকত আলী তার সংরক্ষিত ওয়ারলেস সেটটি ব্যবহার করেছিলেন কিন্তু তিনি ইপিআর চিফের মাস্টটি ব্যবহার করেছিলেন। সে সময় একমাত্র এই মাস্টটি ছাড়া অন্যান্য মাস্ট সম্পূর্ণ অকেজো করে ফেলা হয়েছিল। এ ঘোষণার ভাষ্য ছিল: ‘To-day Bangladesh is a sovereign and independent state. On Thursday night West Pakistani armed forces suddenly attacked the police barracks at Rajarbagh and the EPR Headquarters at Peelkhana in Dacca. Many innocent and unarmed people have been killed in Dacca city and other places of Bangladesh. Violent clashes between the East Pakistan Rifles and Police on the one hand and the armed forces off Pindi on the other, are going on. The Bengalis are fighting the enemy with great courage for an independent Bangladesh. Resist the treacherous enemy in every corner of Bangladesh. May Allah help us.’ “JOY BANGLA”

তিনি বন্দি হওয়ার কিছু আগে তৃতীয় আরেকটি ঘোষণাও প্রচার করেন যার ভাষ্য ছিল: ‘The enemy has struck us. Hit them back. Victory is ours. Insa Allah, Joy Bangla, Mujibur Rahman.’ কথিত আছে যে, তিনি পুলিশের ওয়ারলেস সেটের মাধ্যমে এ ঘোষণাটি প্রচার করিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু একজন রহস্যময় মানুষও ছিলেন। তিনি তার সব কর্মকাণ্ড সবার কাছে উন্মুক্ত করতেন না। যেমন তার সশস্ত্র যুদ্ধের সিদ্ধান্ত। ২৮ ফেব্রুয়ারিতে তার সঙ্গে শেষ দেখার সৌভাগ্য শেখ ফজলুল হক মনি ও আমার জীবনে ঘটেছিল। সেদিন তার মুখে সশস্ত্র যুদ্ধের অবশ্যম্ভাবিতা ও প্রস্তুতির কথা আমাদের জানার সৌভাগ্য হয়েছিল; কথাগুলো তেমন স্পষ্ট ছিল না, তবুও স্পষ্টত বুঝে নিতে কষ্ট হচ্ছিল না। তিনি অতি ধীরস্থির ও সুকৌশলীও ছিলেন। কনফেডারেশনের ব্যাপারে সম্মতিটি ছিল শেষ মুহূর্তে আলোচনা ভেঙে দেওয়ার মোক্ষম কৌশল। ছাত্র ও যুবনেতাদের জ্ঞাতসারেও সম্মতিতে তিনি তা করেছিলেন। ছাত্র ও যুবনেতাদের পরামর্শ ছিল এক লাখ প্যারামিশিয়া ও দুটো মুদ্রা ব্যবস্থার কথা আলোচনায় সংযোজন। যেহেতু মিলিশিয়ার কথাটি আগেই বলা হয়েছিল তাই শেষ মুহূর্তে দুই প্রদেশের জন্য দুটো পৃথক মুদ্রা ব্যবস্থার কথা বলা হলো, যা ধন্বতরী ওষুধের ন্যায় কাজ করল এবং ক্র্যাকডাউনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করল।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাগুলো মুক্তিযুদ্ধকালে কিংবা তার শাসনামলে কোনো বিতর্কের জন্ম দেয়নি। তার অপমৃত্যুর পরই এসবের সূত্রপাত হয়েছে এবং জিয়াউর রহমানের শাসনামল পেরিয়ে খালেদা জিয়ার শাসনামলে ফুলে-ফসলে পল্লবিত হয়েছে। এসব অপপ্রচারকে প্রতিহত করার প্রয়াস লক্ষণীয় তবে দুঃখের বিষয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বুদ্ধিজীবীদের কারও লেখায় বা বক্তৃতায় স্পষ্ট এসব ঘোষণার কথা এই সেদিনও উল্লেখ ছিল না। সাম্প্রতিককালে তার স্পষ্টতা ঘটেছে দুটো কারণে—একটি হচ্ছে হাইকোর্টের একটি রায়ে, আরেকটি তাজউদ্দীন কন্যার প্রকাশিত একটি গ্রন্থে। শেষোক্তজন ও খালেদা জিয়ার বিতণ্ডার কারণে বিষয়টি চূড়ান্ত রূপ নেওয়ারই কথা ছিল, তবে তা ঘটেনি।

হাইকোর্টের রায়টি হচ্ছে বিচারপতি মাহফুজুল হক ও বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদের। ঐতিহাসিক দলিল দস্তাবেজ, প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য ও circumstantial evidence বিশ্লেষণ করে উচ্চ-আদালতের এ সিদ্ধান্তের পর আর কোনো সন্দেহের অবকাশ ছিল না যে, বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এবং এর বিপরীতে যে কোনো বাক্যবাণ বা আপ্তবাক্যই আদালত অবমাননার শামিল। এ দৃষ্টিকোণ থেকে শারমিন আহমেদের লেখার প্রসঙ্গটি আদালত অবমাননার শামিল তো নয়, যা পূর্বতন অনেক আলোচনা-সমালোচনা অবসানে ঘটাতে যথার্থ। তার লেখাটি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।

শারমিন আহমেদের কিছু বিশ্লেষণ ও অনুসিদ্ধান্ত বিস্ফোরণমূলক। সেগুলো প্রকাশিত হয়েছে তার রচিত গ্রন্থ ‘তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা’ গ্রন্থের প্রথম দিকে। ২০১৩ সালে প্রকাশিত বইটির ভূমিকায় কিন্তু এসবের স্থান নেই, স্থান পেয়েছে পরবর্তী অধ্যায় কটিতে।

বইটি প্রকাশের পর এবং বিশেষত তার ওপর সুধীজনের আলোচনা ঘিরে প্রচণ্ড বিতর্কও জমে উঠেছিল। এ বিতর্কে আমিও অবতীর্ণ হই এবং অন্যান্য বিতার্কিকের মতো আমিও কতিপয় উক্তি সংযোজন করি। এসব অযৌক্তিক ছিল তা বলব না।

যা হোক, ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সংসদীয় কমিটি বঙ্গবন্ধুকে নেতা নির্বাচন করে সব সিদ্ধান্তের ক্ষমতা তাকে অর্পণ করে, যার সদ্ব্যবহার তিনি করেন। তাই ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ সাল থেকে স্বাধীনতার একমাত্র ঘোষক হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং তা তিনি ঢাকা থেকেই প্রচার করেন, অন্যরা কেবলমাত্র পাঠক।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং উপাচার্য, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বজ্রপাতে কলেজছাত্রের মৃত্যু

ঘুষ নিয়ে এএসআইয়ের দর-কষাকষির অডিও ভাইরাল

রাইসির খোঁজে যে ঘোষণা দিল এরদোয়ান

গণপিটুনির শিকার আ.লীগ নেতা

রাইসির খোঁজে এগিয়ে এসেছে যে সব দেশ

রাইসির খোঁজে ৩২ সদস্যের দল পাঠাচ্ছে তুরস্ক

ইরানের প্রেসিডেন্টের দুর্ঘটনাস্থল থেকে মিলল সংকেত

কেন এত সময় লাগছে অনুসন্ধানে

টানা চারটি লিগ জয়ীদের এলিট ক্লাবে ম্যানসিটি

হেলিকপ্টার পাওয়ার বিষয়ে যা জানাল রেড ক্রিসেন্ট

১০

রাইসির সঙ্গে হেলিকপ্টারে আর যারা ছিলেন

১১

উন্নয়নের নামে রাতের আঁধারে শাহবাগে গাছ কাটার অভিযোগ

১২

সবশেষ বিহারে ছিলেন এমপি আনার

১৩

‘অভিবাসী কর্মীদের জন্য আরও টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণে কাজ করছে সরকার’

১৪

ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিখোঁজ, যা বলছে যুক্তরাষ্ট্র

১৫

স্বামীর মোটরসাইকেলের চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে নারীর মৃত্যু

১৬

তবুও প্রার্থী হলেন সেই নাছিমা মুকাই 

১৭

গাজীপুরে কারখানার ১০ তলার ছাদ থেকে লাফিয়ে নারী শ্রমিকের মৃত্যু

১৮

রাজশাহীতে আগুনে পুড়ে ছাই ১০ বিঘার পানের বরজ

১৯

বিয়েবাড়ি থেকে কনের পিতাকে তুলে নিয়ে টাকা দাবি

২০
X