কথায় কথায় হামলা-মামলা / এমপি পরিবারের কবজায় হাতিয়া
নোয়াখালী-৬ আসনের সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদাউস ও তার স্বামী সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলীর কাছে অসহায় হয়ে আছে দ্বীপ জনপদ হাতিয়ার মানুষ। খাসজমি দখল, কথায় কথায় প্রতিপক্ষের ওপর হামলা-মামলা, অবৈধভাবে হাট ও ঘাট দখল বাণিজ্যসহ সর্বত্রই একচ্ছত্র আধিপত্য করছে এ পরিবার। আর এসব ক্ষেত্রে নিজ দলের নেতাকর্মীরাই যেন তাদের মূল টার্গেট। নৌকা প্রতীকের সংসদ সদস্য ও তার অনুসারীদের হামলা-মামলার শিকার হয়ে দিন কাটছে আওয়ামী লীগের শত শত নেতাকর্মীর। স্থানীয়দের অভিযোগ, এমপি পরিবারের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে পুরো হাতিয়া। তাদের ভয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খোলেন না।
হাতিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক এক নেতা কালবেলাকে বলেন, ‘মোহাম্মদ আলীর কথার বাইরে গেলেই যে কাউকে মামলার আসামি করেন তিনি। হাতিয়ার ১১টি ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কয়েকশ নেতাকর্মীর নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছেন মোহাম্মদ আলীর অনুসারীরা। তার প্রত্যক্ষ মদদেই এসব মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। হাতিয়ায় তিনি একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছেন। ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি, ভূমি দখল, হাটবাজারের অবৈধ ইজারা নেওয়া, সরকারি সব কাজের ঠিকাদারি ছেলে আশিকের প্রতিষ্ঠানকে দিতে বাধ্য করাসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত মোহাম্মদ আলী ও আয়েশা ফেরদাউস দম্পতি। সরকারি বরাদ্দ লুটপাট করে বিপুল সহায়-সম্পত্তির মালিক বনে গেছেন তারা। এ পরিবারের কবজা থেকে রক্ষা পেতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং জেলা আওয়ামী লীগের হস্তক্ষেপ চেয়েছি। তবুও সমস্যার সমাধান হয়নি।’
স্থানীয় এক গণমাধ্যমকর্মী জানান, ‘হাতিয়ায় মোহাম্মদ আলীর ইশারা ছাড়া কিছু চলে না। জলে-স্থলে সর্বত্র তার একক আধিপত্য চলছে। এখানে তার বিপক্ষে কথা বলার সাহস কারও নেই। হামলা-মামলা, খুন রাহাজানির নেপথ্যে তার ইন্ধন রয়েছে বলে মনে করে হাতিয়াবাসী। মানুষকে তিনি এক প্রকার জিম্মি করে রেখেছেন।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলার জন্য সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদাউসের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
তার স্বামী সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী কালবেলাকে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন সামনে এলে একটি পক্ষ আমাকে হেনস্তা করার উদ্দেশ্যে নানা অভিযোগ করে। তারা আমার পরিবারের নামে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ দিয়েছে। দুদক দুই বছর ধরে তন্ন তন্ন করে তদন্ত করে কোনো অভিযোগের সত্যতা পায়নি।’
আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নামে হামলা-মামলা: জানা গেছে, নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য (মেম্বার) মোহাম্মদ মেরাজ উদ্দিনকে মামলা দিয়ে এলাকা ছাড়া করেছেন মোহাম্মদ আলী। তিনি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক। ২০২২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর তিনি তার অসুস্থ মাকে দেখতে বাড়িতে গেলে তার ওপর হামলা হয়। হামলায় মেরাজ মেম্বারের ভাই ও ভাতিজা গুরুতর আহত হন। ঘটনার বিচার চেয়ে তিনি ফেসবুকে লাইভ করেন। পরে পুলিশি পাহারায় হাতিয়া থেকে নোয়াখালী জেলা সদরে চলে যান মেরাজ।
মেরাজ উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘আমার নামে ছয়টি হত্যা মামলাসহ মোট ২২টি মামলা করা হয়েছে। মোহাম্মদ আলীর নির্দেশেই এসব মামলা হয়েছে। মামলার কারণে আমি এলাকায় যেতে পারছি না। গত বছরের সেপ্টেম্বরে অসুস্থ মাকে দেখতে বাড়ি গেলে এমপির লোকজন আমাদের ওপর হামলা করে। এতে আমার ভাই ও ভাতিজা গুরুতর আহত হন।’
কেন আপনাকে মামলার আসামি করা হয়েছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘মোহাম্মদ আলী আমাকে গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তার পছন্দের আনারস প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে ভোট করতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি নৌকার পক্ষে কাজ করায় উনি আমার ওপর ক্ষুব্ধ।’
মেরাজ আরও অভিযোগ করে বলেন, ‘মোহাম্মদ আলী জাহাজমারা ইউনিয়নে ভূমিহীনদের নামে বন্দোবস্ত জমি জোরপূর্বক দখল করে ভোগ করছেন। তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারে না।’
ভুক্তভোগীরা জানান, নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য মোহাম্মদ আকরাম উদ্দিনের নামে হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলা করেছেন মোহাম্মদ আলীর অনুসারীরা। জেলা আওয়ামী লীগের আরেক সাবেক সদস্য নুরুল ইসলামের নামে হত্যাসহ একাধিক মামলা করা হয়েছে। হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে হাতিয়া পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন আহমেদের আসামি। একাধিক মামলা মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন নিঝুমদ্বীপ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক চেয়ারম্যান মেরাজ উদ্দিন। থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ টি এম সিরাজুল ইসলামের নামে রয়েছে একাধিক মামলা।
অভিযোগ রয়েছে, যারাই মোহাম্মদ আলী পরিবারের বলয়ের বাইরে রাজনীতি করছেন সবাইকে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দেওয়া হয়েছে। হাতিয়ার ১১টি ইউনিয়নের কয়েকশ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা দিয়েছেন মোহাম্মদ আলীর লোকজন। এসব মামলায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইন্ধনদাতা সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘যাদের নামে মামলা হয়েছে তারা হত্যাসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত। আমি কাউকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মামলা দেওয়ার নির্দেশ দেইনি। কিংবা আমার লোকজন কারও বিরুদ্ধে মামলা দিতে আমি বলিনি।’
সি-ট্রাক বন্ধ রেখে ট্রলার ও স্পিডবোট ব্যবসা: স্থানীয়রা জানান, হাতিয়ার চেয়ারম্যান ঘাট থেকে নলছিরা ঘাট পর্যন্ত বিআইডব্লিউটিসির ব্যবস্থাপনায় সি-ট্রাক চলাচল করত। সি-ট্রাকে জনপ্রতি ভাড়া মাত্র ৯০ টাকা। চলাচলও নিরাপদ। অভিযোগ আছে, মোহাম্মদ আলীর নির্দেশে সি-ট্রাক বন্ধ রেখে বিকল্প হিসেবে এ রুটে তিনটি ট্রলার চালানো হচ্ছে। ঈশিতা-১, ঈশিতা-২ এবং ঈশিতা-৩ নামে ট্রলারগুলোর মালিক এমপির পরিবার। এসব ট্রলারে জনপ্রতি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়। এ ছাড়া এমপি পরিবারের প্রায় ৩০টি স্পিডবোট রয়েছে। এগুলো জনপ্রতি ৫০০ টাকা করে ভাড়া নিচ্ছে। সি-ট্রাক বন্ধ করে দিয়ে নিজস্ব ট্রলার ও স্পিডবোট চালিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা আয় করছে এমপি-পরিবার। ট্রলার ও স্পিডবোটে একদিকে ভাড়া বেশি অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল সমুদ্র পার হতে হয় হাতিয়াবাসীকে।
এ অভিযোগ অস্বীকার করে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘সি-ট্রাক আমি বন্ধ করিনি। হাতিয়ায় সি-ট্রাক নেই। যেটি ছিল তার নিচে ফুটো হয়ে গেছে। এজন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। আপনি ভালোভাবে খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন।’
খাস জমি দখলে নিয়ে হোটেল ব্যবসা: এমপি আয়েশা ফেরদাউস ও তার স্বামী মোহাম্মদ আলী দলীয় প্রভাব খাটিয়ে তাদের নিজ নামের পাশাপাশি দুই ছেলে, কন্যা ও পুত্রবধূর নামে খাস জমি বন্দোবস্ত নিয়েছেন। ওই জমিতে তারা একটি চারতলা আবাসিক হোটেল গড়ে তুলেছেন। হাতিয়া বাজারের সেই ‘ঈশিতা আবাসিক হোটেল’ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। ওই বন্দোবস্ত বাতিল করে প্রকৃত ভূমিহীনদের মধ্যে বন্দোবস্ত জমি দেওয়ার দাবি তাদের।
জানা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রকৃত ভূমিহীনদের উচ্ছেদ করে জায়গাটি দখলে নেয় এমপি পরিবার। এরপর এক বছরের জন্য জমিটি লিজ নেন তারা।
নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, স্বামী, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে ও পুত্রবধূর নামে আধা ডেসিমেল করে ছয়টিসহ মোট ১০টি নথি অনুমোদন করিয়ে জমি বন্দোবস্ত নেয় এমপি পরিবার। উপজেলা পরিষদের রেজুলেশন নম্বর অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আয়েশা ফেরদাউসের নামে বন্দোবস্ত দেওয়া নথি নম্বর ১৮৬। তার স্বামী সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলীর নথি নম্বর ১৯৩, ছোট ছেলে মাহতাব আলীর বন্দোবস্ত নথি নম্বর ১৮১, বড় ছেলে আশিক আলীর নথি নম্বর ১৮২, মেয়ে সুমাইয়া আলীর নামে বরাদ্দকৃত নথি নম্বর ১৮৩ এবং পুত্রবধূ নাঈমা সুলতানার নথি নম্বর ১৯৪।
অভিযুক্ত সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী কালবেলাকে বলেন, ‘খাস জমি আমার পরিবারের লোকজন বিধি মোতাবেকই নিয়েছে। খুব বেশি জমি আমরা নিইনি।’
এমপিপুত্রের কবজায় সব ঠিকাদারি: সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানায়, হাতিয়ার বড় বড় সরকারি কাজের ঠিকাদারি পায় এম আলী করপোরেশন। প্রতিষ্ঠানটি মোহাম্মদ আলীর ছেলে আশিক আলীর। হিল্টন রোড থেকে জাহাজ মারা জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার রাস্তার কাজ পেয়েছিল অন্য একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে মোহাম্মদ আলীর লোকজন সেই কাজ করতে দিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
নলছিরা থেকে হিল্টন রোডের কাজ বাগিয়ে নিয়েছে এম আলী করপোরেশন। সাড়ে ১৪ কোটি টাকার এ রাস্তা পাকা করার কাজে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়রা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগও দিয়েছেন।
বয়ারচর বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ পেয়েছিল আলম অ্যান্ড ব্রাদার্স। কিন্তু মোহাম্মদ আলী জোরপূর্বক ওই কাজটি তার ছেলের প্রতিষ্ঠান এম আলী করপোরেশনকে দিতে বাধ্য করেন। এভাবে সরকারি সব কাজই প্রভাব খাটিয়ে বাগিয়ে নেয় এমপিপুত্রের প্রতিষ্ঠান এম আলী করপোরেশন।
অভিযোগ অস্বীকার করে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘৫০ বছর ধরে এম আলী করপোরেশন সেরা করদাতা হিসেবে এনবিআর থেকে ক্রেস্ট পেয়েছে। ই-জিপিতে টেন্ডার হয়। এম আলী করপোরেশন তার যোগ্যতার ভিত্তিতেই কাজ পায়। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই।’
০৫ অক্টোবর, ২০২৩