জাতীয় নির্বাচনের পর দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এ ইস্যুতে ঢাকায় আগামীকাল শনিবার অনুষ্ঠেয় সমাবেশ ঘিরে ব্যাপক শোডাউনের প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। সমাবেশে ব্যাপক জনসমাগমের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তিতে সরকারের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করতে চায় তারা। একই সঙ্গে ঢাকা মহানগর বিএনপি ও কেন্দ্রীয় যুবদলের নতুন কমিটি গঠন সামনে রেখে এ সমাবেশকে নেতৃত্ব বাছাইয়ের ক্ষেত্র হিসেবেও বিবেচনা করছে দলটির হাইকমান্ড। এর মধ্য দিয়ে পদপ্রত্যাশী নেতাদের পারফরম্যান্সের মূল্যায়ন করা হবে। সব মিলিয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তির সমাবেশ জনসমুদ্রে পরিণত হওয়ার প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।
সরকারবিরোধী বিগত আন্দোলনের মূল্যায়নের ভিত্তিতে ঘুরে দাঁড়াতে সাংগঠনিক পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে গত ১৩ জুন ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির সঙ্গে কেন্দ্রীয় যুবদলের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। সংশ্লিষ্টদের ধারণা ছিল, ঈদুল আজহার আগে কিংবা ঈদের পরপরই সেখানে নতুন কমিটি দেওয়া হবে; কিন্তু ১৪ দিন পার হলেও এখনো সেখানে কমিটি দেওয়া হয়নি। বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা জানিয়েছেন, ঢাকায় সমাবেশের পর এসব ইউনিটে নতুন কমিটি দেওয়া হতে পারে।
দুর্নীতির দুই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দি হন। দুই বছরের বেশি সময় কারাবন্দি ছিলেন তিনি। ওই সময় আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ঢাকাসহ দেশব্যাপী মানববন্ধন, অবস্থান, গণঅনশন, লিফলেট বিতরণ, বিক্ষোভ সমাবেশ, সমাবেশসহ নানান কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। পরে করোনা মহামারিকালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়ার সাজা ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকার নির্বাহী আদেশে সাময়িক স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছিল। তখন থেকে ছয় মাস পরপর তার সাজা স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ বাড়াচ্ছে সরকার। কারামুক্তির পর থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালে আসা-যাওয়ার মধ্যে ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় থাকছেন শারীরিকভাবে অসুস্থ বিএনপি নেত্রী। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে গত ২১ জুন গভীর রাতে তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার হৃদযন্ত্রে পেসমেকার বসানো হয়।
নতুন করে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের এই অবনতিতে গত সোমবার অনুষ্ঠিত দলের স্থায়ী কমিটির সভায় চেয়ারপারসনের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। এর অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে দলটি। ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, আগামীকাল ঢাকায়, ১ জুলাই সব মহানগর এবং ৩ জুলাই সব জেলা শহরে সমাবেশ হবে।
একদফা দাবিতে গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দেশজুড়ে রাজপথে বছরব্যাপী আন্দোলন করে বিএনপি। ওই নির্বাচনের পর সরকারের পদত্যাগ ও নতুন নির্বাচন দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় দলটি। তবে লিফলেট বিতরণ, র্যালি, সমাবেশসহ বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কর্মসূচি হলেও বড় কোনো কর্মসূচি করেনি। খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা ও নিঃশর্ত মুক্তিসহ সব রাজবন্দির মুক্তির দাবিতে সর্বশেষ গত ১০ মে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ ও মিছিল করে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি। তবে ওই সমাবেশে খুব কমসংখ্যক উপস্থিতি ছিল। তাই খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যানারে আগামীকাল ঢাকায় নির্বাচনের পর সবচেয়ে বড় সমাবেশ করতে চায় দলটি।
জানা গেছে, ঢাকার এই সমাবেশ সফলে ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু করেছে বিএনপি। সমাবেশ বাস্তবায়নে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে প্রধান সমন্বয়ক করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে সহায়তা করার জন্য দলের যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, আব্দুস সালাম আজাদ ও প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকেও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ জ্যেষ্ঠ নেতারাও সমাবেশ সফলে কাজ করছেন। সমাবেশে বড় ধরনের শোডাউন ঘটাতে ইতোমধ্যে কেন্দ্র থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট নেতারা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির সমাবেশের কর্মসূচি বাস্তবায়নে সদ্য বিলুপ্ত দলের ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ এবং কেন্দ্রীয় যুবদলের সাবেক নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, নতুন কমিটি সামনে রেখে এই সমাবেশ দিয়ে দলের পক্ষ থেকে পদপ্রত্যাশী নেতাদের পারফরম্যান্স যাচাই করা হবে। জানা গেছে, নতুন কমিটিকেন্দ্রিক আবহ থাকায় বিষয়টি মাথায় রেখে নিজ নিজ কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে সমাবেশে আলাদাভাবে ব্যাপক শোডাউনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন পদপ্রত্যাশী নেতারা। এ ছাড়া কর্মসূচিতে ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা ও মহানগরগুলো থেকেও বিএনপির নেতাকর্মীরা আসবেন। অংশ নেবেন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও। ছাত্রদলের সদ্যঘোষিত পূর্ণাঙ্গ কমিটিকেও সমাবেশে সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ নিশ্চিতের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে সমাবেশ সফলে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ইতোমধ্যে যৌথ সভা করেছেন। প্রস্তুতি সভা করেছে ছাত্রদল, বিলুপ্তকৃত ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদল। সমাবেশে সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ নিশ্চিতে প্রস্তুতি সভা করেছে বিএনপিপন্থি পেশাজীবীদের সংগঠন বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ (বিএসপিপি)।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদ্য সাবেক সদস্য সচিব আমিনুল হক কালবেলাকে বলেন, বেগম খালেদা জিয়া হচ্ছেন গণতন্ত্রের প্রতীক। তাকে মুক্ত করার অর্থ প্রাথমিকভাবে গণতন্ত্র মুক্ত করার মতোই। এমন প্রেক্ষাপটে গুরুতর অসুস্থ খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় সমাবেশ সফলে দলের প্রতিটি নেতাকর্মী বদ্ধপরিকর। মহানগর উত্তর বিএনপির বিলুপ্তকৃত কমিটির পাশাপাশি অধীন থানা ও ওয়ার্ড পর্যন্ত প্রস্তুতি চলছে। আমাদের প্রত্যাশা, খালেদা জিয়ার মুক্তির সমাবেশে নেতাকর্মীদের পাশাপাশি ব্যাপক সংখ্যায় সাধারণ মানুষও অংশগ্রহণ করবেন।
মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদ্য সাবেক সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু বলেন, সমাবেশ সফলে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে। আশা করছি, নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে সমাবেশ জনসমুদ্রে পরিণত হবে।
এদিকে ঢাকার বাইরে মহানগর ও জেলা শহরে অনুষ্ঠেয় সমাবেশের কর্মসূচি বাস্তবায়নেও প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। জানা গেছে, ঢাকার পাশাপাশি এসব সমাবেশও বড় পরিসরে পালনে ইতোমধ্যে কেন্দ্র থেকে সংশ্লিষ্ট নেতাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।