ড. নূহ-উল-আলম লেনিন / বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের অজানা কিছু তথ্য (শেষ পর্ব)
বঙ্গবন্ধুর হত্যার চতুর্থ ষড়যন্ত্র : ১৫ আগস্টের চূড়ান্ত আঘাত হানার আগে একাধিকবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৭৫ সালে বাকশাল করার পর বঙ্গবন্ধু একই বছর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তার জীবনের শেষ জনসভা করেন। এই জনসভায় বঙ্গবন্ধুকে হামলার ষড়যন্ত্র করেছিল মেজর ফারুক। বিষয়টি তৎকালীন ডিজিএফ প্রধান ব্রিগেডিয়ার আবদুর রউফ জানতে পারেন। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াও তিনি বিষয়টি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে জানান। ব্রিগেডিয়ার রউফ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন :  আমরা (বিগ্রেড কমান্ডার গোলাম দস্তগীর ও ব্রিগেডিয়ার রউফ) অফিসারদের ওয়াচ আউটে থাকতে বললাম। ডিফেন্স সেক্রেটারিকেও ঘটনাটা জানালাম। তারপর প্রেসিডেন্ট মুজিবকে গিয়ে বললাম, ৩২-নাম্বারের বাসায় স্যার এই ব্যাপারে ওটা করার জন্য কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তাও বললাম, প্রেসিডেন্ট সাহেব আমার কথা শুনে বললেন, এর তো আমি সবকিছু জানি।   প্রশ্ন : ফারুকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলো না কেন?   উত্তর : আমার কাজটা ছিল তথ্য জানানো। অ্যাকশন নেওয়ার দায়িত্ব প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের। প্রেসিডেন্ট আইন অনুযায়ী শাস্তি দিবেন। আর্মি চিফ বা অন্যদের মতামত নেওয়া হবে। তারা আর্মি অ্যাক্ট অনুযায়ী শাস্তি দিবেন।   বঙ্গবন্ধু-হত্যার পঞ্চম বা চূড়ান্ত ষড়যন্ত্র : বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় ও তা কার্যকর করার ফলে এখন সবাই জানেন কারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল। আত্মস্বীকৃত খুনি কর্নেল ফারুক ও কর্নেল রশিদ বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিচারের অনেক আগেই এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছে। মুক্তির কথা নামে ফারুক-রশিদ বইও লিখেছে।   বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে সপরিবারে হত্যা করা হয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য এবং তার রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘদিনের সহকর্মী খন্দকার মোশতাক আহমদকে অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়। মোশতাক কয়েকজনকে বাদ দিয়ে পুরোনো আওয়ামী লীগ মন্ত্রিদেরই তার মন্ত্রিসভায় বহাল রাখেন। সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী, রক্ষীবাহিনী ও পুলিশপ্রধান সবাই একে একে মোশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে।   বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাত ও তাকে হত্যার পরিকল্পনা প্রসঙ্গে ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের নেতা ফারুক রহমান ১৯৯২ সালের ১৪ আগস্ট মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড গ্রন্থের রচয়িতা সাংবাদিক মিজানুর রহমানকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সেই সাক্ষাৎকারে ফারুক বলেন :  ১৪ আগস্ট রাত একটা ৩০ মিনিটে ক্যান্টনমেন্টে আমি সবাইকে নির্দেশ দেই। ৩০ মিনিট ধরে বুঝিয়ে দেই কীভাবে কী করতে হবে? চারটা ৩০ মিনিটে ‘মুভ’ করার নির্দেশ ছিল, কিন্তু অভিযানের সাজসরঞ্জাম জোগাড় হতে বিলম্ব ঘটে। সিগনাল মসজিদে ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে প্রথম ট্যাংক ৩২ নম্বরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। আমি এত নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম, আর একটু দেরি হলে হার্টফেল করতাম। আমার নেতৃত্বাধীন বেঙ্গল ল্যান্সার এবং রশিদের নেতৃত্বাধীন গোলন্দাজ বাহিনীর ৭০০ থেকে ৯০০ সৈন্য এই অভিযানে অংশ নেয়।  ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড এবং অভ্যুত্থানের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে কারা জড়িত ছিল বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ড বিচারের রায়ে তার বিস্তারিত বিবরণ আছে।  ১৯৯৭ সালের ৭ এপ্রিল মামলার ঘটনাটির তদন্তপূর্বক ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৩ ধারা মোতাবেক বর্তমানে মৃত খন্দকার মোশতাক আহমেদ, মাহবুব আলম চাষী, ক্যাপ্টেন মোস্তফা ও রিসালদার সৈয়দ সারোয়ার হোসেনসহ অন্য যারা আসামি ছিলেন, তারা হলেন :  ১. লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ২. লে. কর্নেল মুশতাক শাহরিয়ার রশিদ ৩. লে. কর্নেল মহিউদ্দিন (আর্টিলারি) ৪. অনারারি ক্যাপ্টেন আবদুল ওয়াহাব জোয়ারদার ৫. তাহের উদ্দিন ঠাকুর (সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী) ৬. জোবায়দা রশিদ ৭. পলাতক লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদ ৮. পলাতক মেজর বজলুল হুদা ৯. পলাতক লে. কর্নেল এ এইচ এম বি নূর চৌধুরী ১০. পলাতক লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম ১১. পলাতক লে. কর্নেল আজিজ পাশা ১২. পলাতক লে. কর্নেল এম এ রাশেদ চৌধুরী ১৩. পলাতক মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন (ল্যান্সার) ১৪. পলাতক রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন ১৫. পলাতক মেজর শরিফুল হোসেন ১৬. পলাতক ক্যাপ্টেন মো. কিসমত হাসেম ১৭. পলাতক ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন ১৮. পলাতক ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ ১৯. পলাতক দফাদার মারফত আলী শাহ ও ২০. পলাতক এলডি আবুল হাশেম মৃধা।  উল্লিখিত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১২০বি/৩০২/৩৪/১৮৯/ ৩২৪/৩০৭/২০১/৩৮০/২০১ ধারা অপরাধের অভিযোগপত্র/চার্জশিট দাখিল করে বিচারের জন্য সোপর্দ করা হয়। মৃত ব্যক্তির বিচারের বিধান না থাকায় খন্দকার মোশতাক ও মাহবুব আলম চাষীসহ চারজন বিচার থেকে অব্যাহতি পান। জর্জকোর্টে ১৫ ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আসামি তাহের উদ্দিন ঠাকুর, অনারারি ক্যাপ্টেন আবদুল ওয়াহাব জোয়ারদার, দফাদার মারফত আলী এবং এলডি আবুল হাশেম মৃধার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সন্দেহাতিভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত তাদের মামলা থেকে মুক্তি দেয়। আসামি জোবায়দা রশিদ রিভিশন মামলায় হাইকোর্টের আদেশে এ মামলা থেকে অব্যাহতি পান। এই পাঁচজন ব্যতিরেকে অন্য ১৫ জনকে জজকোর্ট ‘বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সংঘটিত হত্যা মামলায়’ দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর নাজিমউদ্দিন রোডস্থ ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিশেষ এজলাসে বঙ্গবন্ধু-হত্যা মামলায় বিচারক মো. কাজী গোলাম রসুল ১৭১ পৃষ্ঠার দীর্ঘ রায় পাঠ করে শুনান।   পরে জজকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আসামিরা আপিল করেন। শেখ হাসিনার প্রথম সরকার তখনও ক্ষমতায়। আমাদের স্বাধীন উচ্চ-আদালতের একাধিক বেঞ্চ বঙ্গবন্ধু-হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্সের নিষ্পত্তি করতে বিব্রতবোধ করেন। অর্থাৎ তারা তাদের বেঞ্চে এই মামলার শুনানি করতে অপারগতা জানান। পরে অবশ্য ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিচারপতি রহুল আমিন ও বিচারপতি খায়রুল হককে নিয়ে গঠিত বেঞ্চ বিভক্তি রায় দেন। বিচারপতি রুহুল আমিন পাঁচজন আসামিকে খালাস দেন এবং বিচারপতি খায়রুল হক ১৫ জনের মৃত্যু দণ্ডাদেশ বহাল রাখেন। অবশেষে ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল বিচারপতি ফজলুল করিমের একক বেঞ্চ ডেথ রেফারেন্সের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করেন। অভিযুক্ত তিনজনকে খালাস দেন এবং ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।  স্বভাবতই আসামিরা সুপ্রিমকোর্টে আপিল করেন। ইতোমধ্যে ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট জয়লাভ করে। জোটের পাঁচ বছর এবং ২০০৭-০৮ এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর— মোট সাত বছর আপিল বিভাগে মামলাটি ঝুলে থাকে। রাষ্ট্রপক্ষ মামলা নিষ্পত্তির কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোট ও তিন-চতুর্থাংশ আসন পেয়ে আওয়ামী লীগ ও তার মহাজোট ক্ষমতায় আসে।  শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদের সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি চূড়ান্ত রায় দেয়। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। এই রায়ের পরই আটক খুনি ফারুক রহমানসহ অন্যদের ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা হয়। যে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়ে চূড়ান্ত রায় ঘোষিত হয়, তারা হলেন কারাবন্দি- (১) সৈয়দ ফারুক রহমান (২) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান (৩) মুহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি) (৪) বজলুল হুদা ও (৫) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার)। মৃত্যুদণ্ডাপ্রাপ্ত পলাতক আসামিরা হলেন (৬) খন্দকার আবদুর রশিদ (৭) শরিফুল হক ডালিম (৮) এ এম রাশেদ চৌধুরী (৯) এম এইচ এম বি নূর চৌধুরী (১০) আব্দুল মাজেদ (১১) রিসালদার মোসলেম উদ্দিন। আর দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আজিজ পাশা পলাতক অবস্থায় বিদেশের মাটিতে মারা যান।  দণ্ডপ্রাপ্ত সব আসামিই সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য। কোনো বেসামরিক ব্যক্তি শাস্তি পাননি। খন্দকার মোশতাক ও মাহবুব আলম চাষী অবশ্য মামলা শুরুর পূর্বেই মারা যান।  হত্যা-ষড়যন্ত্রের কুশীলবরা : আমরা আলোচনাটি এখানেই শেষ করতে পারতাম। কিন্তু আমাদের শুরুর প্রশ্নের জবাব আমরা এখনও পাইনি। প্রথমত, আমাদের কাছে এখন নানা দালিলিক প্রমাণ রয়েছে— যাতে বঙ্গবন্ধুর সরকার উৎখাত এবং তাকে হত্যার পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ষড়যন্ত্রে অনেকেরই সক্রিয় থাকার সাক্ষ্য মিলেছে। আমরা আগেই বলেছি, মামলাটি ছিল ‘বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড’ সম্পর্কে। অর্থাৎ মামলাটি দৃশ্যত ‘রাষ্ট্রদোহিতা’ এবং সেনাবাহিনীতে ‘মিউটিনি’-এর জন্য ছিল না। এই মামলা প্রসঙ্গে ঢাকা জজকোর্টের বিচারক কাজী গোলাম রসুল তার রায়ের শুরুতেই বলেন, ‘বিচারকার্যের ইতিহাসে এই জাতীয় হত্যার মামলা বিরল হইলেও নজিরবিহীন নহে। এই হত্যাকাণ্ডটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা সত্ত্বেও বিচার কার্যের ক্ষেত্রে আদালতের কাছে অন্যান্য হত্যা মামলার ন্যায় ইহাও কেবল একটি হত্যা মামলা।’ কারণ—  We have to dispense justice in accordance to our law and not according to our moral conviction with regard to the occurence. The strict requirement to law is that the onus lies on the prosecution to prove its case beyond reasonable doubt. When human life pends in the scales, caution becomes the primary duty of any tribunal called upon to assess the evidence of the case, having regared of this statutory rule of caution.  বিচারকার্যের এই অবিস্মরণীয় নীতি অনুসরণ করেই উভয়পক্ষের উপস্থাপিত মৌখিক, দালিলিক, তথ্যগত অবস্থাগত সাক্ষ্য ও আলামতের ভিত্তিতে এই মামলায়ও সুচিবার নিশ্চিত করার সাধ্যমতো প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। আদালতের বিচারক কোনো রাখ-ঢাক না করেই মানদণ্ডটি ব্যাখ্যা করেছেন। তার অভিমত ‘আদালতের কাছে অন্যান্য হত্যা মামলার ন্যায় ইহাও কেবল একটি হত্যা মামলা।’ অতএব বঙ্গবন্ধু-সরকারের বিরুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত দেশি-বিদেশি কেউই এই মামলার তদন্তের আওতায় ছিল না বা তাদের আসামি করা হয়নি। এ কথা তো এখন বিশ্ববাসী জানে, বঙ্গবন্ধু-সরকারের বিরুদ্ধে অভিযুক্ত সেনা-কর্মকর্তারা ছাড়াও দেশের ভেতরের অনেকেই গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। উদাহরণ হিসেবে কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে :   ১. খন্দকার মোশতাক আহমেদ ২. তাহেরউদ্দিন ঠাকুর ৩. শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ৪. মাহবুব আলম চাষী প্রমুখ। খন্দকার মোশতাক যে শেখ মুজিবকে যৌবনের শুরু থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন, সে কথা শেখ মুজিবের চেয়ে আর কেউ বেশি জানেন না। মোশতাক ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭১-এর পূর্বে বহু প্রশ্নে দলের সঙ্গে বিশেষত, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। এক বা একাধিকবার দল থেকে পদত্যাগও করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি মাহবুব আলম চাষী (পররাষ্ট্র সচিব)-কে নিয়ে গোপনে মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।   প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মোশতাক ও মাহবুব আলম চাষীর কর্মকাণ্ড জানতে পেরেছিলেন, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরদারিতে এ তথ্য বেরিয়ে আসে, খন্দকার মোশতাক ও মাহবুব আলম চাষী কলকাতায় মার্কিন কনসুলেটরের সাথে গোপনে যোগাযোগ করেছেন। মোশতাকের এই বেআইনি গোপন তৎপরতা জানার পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাককে কার্যত নিষ্ক্রিয় করেছিলেন।   মোশতাক মুক্তিযুদ্ধকালে লিফলেট বিতরণ করে বঙ্গবন্ধুর জীবনরক্ষার মেকি দরদ দেখিয়ে যুদ্ধ পরিহার করে পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতার মতবাদ (নিজ নামে নয়) প্রচার করেছেন। বস্তুত, মুক্তিযুদ্ধকালেই খন্দকার মোশতাক এবং মাহবুব আলম চাষী গং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের অন্যান্য নেতারা এবং ভারত সরকার তা জানতেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তিনি কি মোশতাকের এই ভূমিকার কথা জানতে পারেননি? এটা সহজেই অনুমেয় শেখ মুজিব অবশ্যই মোশতাকের কথা জানতেন। কিন্তু জানা সত্ত্বেও তিনি মোশতাককে সরকার ও দল থেকে সরিয়ে তো দেনইনি বরং প্রশ্রয় দিয়েছেন। এমনকি ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে মন্ত্রিসভার একমাত্র সিনিয়র সদস্য খন্দকার মোশতাকের নিশ্চিত পরাজয় থেকে অবৈধ উপায়ে জিতিয়ে আনেন। পক্ষান্তরে, সারা জীবনের পরীক্ষিত বিশ্বস্ত সহকর্মী মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবকে ১৯৭৪ সালে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। ১৯৭২ সাল থেকে মেজর ফারুক রহমান বঙ্গবন্ধু-সরকারকে উৎখাত এবং তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র শুরু করেন।   মার্কিন সাংবাদিক লরেঞ্জ লিফসুলজের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের অবমুক্ত করা গোপন নথিপত্রে দুটি জিনিস পরিষ্কার— ১. ফারুক-রশিদ বঙ্গবন্ধু-হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ১৯৭২ সাল থেকেই সক্রিয় ছিল এবং ২. বঙ্গবন্ধু-সরকার উৎখাত ও ১৫ আগস্টের ঘটনাবলির সঙ্গে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সংশ্লিষ্টতা ছিল।     মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্রের গোপন দলিলেই উল্লেখ রয়েছে—  ‘১৯৭২, শেখ মুজিব সরকারের অগোচরে মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে গিয়েছিলেন অস্ত্র সংগ্রহের ব্যাপারে আলোচনা করতে।’  এরপর বছর না ঘুরতেই ‘১৯৭৩ সালের ১১ জুলাই একইভাবে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য মার্কিন দূতাবাসে যান আরেকজন মেজর। তিনি ফারুকের ভায়রা ভাই মেজর আবদুর রশিদ। ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটির পক্ষে সেনাবাহিনীর জন্য অস্ত্র ক্রয় নিয়ে কথা বলতে তাকে পাঠানো হয় বলে দাবি করেছিলেন তিনি।     এখানেই শেষ নয়। ১৩ মে ১৯৭৪। সৈয়দ ফারুক রহমান ‘উচ্চতম পর্যায়ের বাংলাদেশ সেনা কর্মকর্তার নির্দেশে’ শেখ মুজিবুর রহমান সরকার উৎখাত করতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সহায়তা চান।    ‘ডকুমেন্ট নং কনফিডেনশিয়াল ঢাকা ৩১৫৬, ঢাকা থেকে তারবার্তাটি প্রেরণ করেন ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস কর্মকর্তা নিউবেরি। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে প্রকাশকাল, ৩০ জুন ২০০৫।’  ‘ডকুমেন্ট নং সিক্রেট ঢাকা ২১৫৮। ঢাকা থেকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে তারবার্তাটি প্রেরণ করেন, ডেভিড ইউজেন বোস্টার, প্রকাশকাল ৩০ জুন ২০০৫।’     ‘এর ঠিক ২৫ মাসের ব্যবধানে ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত অভ্যুত্থান ঘটে। ফারুক রহমান ১৯৭২ সালের আগস্টে লেখককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, তিনি ১৫ মাস ধরে মুজিব-হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন।’    এখানে দুটি বিষয় পরিষ্কার করার জন্য এই প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয়েছে। প্রথমত; বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা যে আকস্মিক নয়, দীর্ঘ প্রস্তুতি ছিল, সেটি পরিষ্কার করা এবং দ্বিতীয়ত; বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডে সিআইএ তথা মার্কিন সংশ্লিষ্টতা। দীর্ঘ প্রস্তুতির কথা যেমন আমরা মার্কিন গোপন নথি থেকে দেখলাম তেমনি মার্কিন সাংবাদিক লরেঞ্জ লিফসুলজের লেখা দ্য আনফিনিশড রেভল্যুশন (সহলেখক কাই বার্ড) গ্রন্থ থেকেও মার্কিন সংশ্লিষ্টতার কথা সুস্পষ্টভাবে বেরিয়ে এসেছে। আমরা এখানে এ ষড়যন্ত্রের বিস্তারিত বর্ণনা দেব না। আমরা খুনি ফারুকের বয়ান থেকেও জানতে পেরেছি, তারা এই ষড়যন্ত্র ও তাদের অভিলাষের কথা সেনাবাহিনীর ডেপুটি প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে জানিয়েছিলেন এবং সহায়তা কামনা করেছিলেন।    জিয়াউর রহমান তাদের ষড়যন্ত্রের কথা ৫ মাস আগেই জেনেছিলেন। এন্থনি ম্যাসকারেনহাস লিখেছেন : আমিই ফারুক ও রশীদের সাক্ষাৎকার নেই। এ সময় ফারুক আমাকে বলে সে জেনারেল জিয়াকে ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ জানিয়েছেন তারা সরকার পরিবর্তন করতে চায়। জেনারেল জিয়া তাদের বলেন ‘দুঃখিত আমি জঙ্গি কিছু করতে পারব না। তোমরা ইয়ং অফিসার যা খুশি করো গিয়ে।    কোরআন ছুঁয়ে ফারুক আমাকে এ কথা বলেছেন। জুলাই মাসে ঢাকা এলে আমি জেনারেল জিয়াকে এ কথা ঠিক কি না জিজ্ঞেস করি। তিনি বলেছিলেন, ভেবে দেখবেন আমার জবাব দেবেন কি না।’   সেনাবাহিনী ডেপুটি প্রধান হিসেবে সরকারের বিরুদ্ধে এ ধরনের ষড়যন্ত্র এ অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টার কথা জানার পরও তা রাষ্ট্রপ্রধান/সরকারপ্রধানকে না জানানো সেনাবাহিনীতে চাকরির শর্ত আনুযায়ী গুরুতর অপরাধ। জিয়া যে বঙ্গবন্ধু-হত্যায় ইন্ধন জুগিয়েছেন এবং উৎফুল্ল হয়েছেন তা ১৫ আগস্ট প্রত্যুষেই তিনি প্রকাশ করেছিলেন।  সেনাবাহিনীর ঢাকা গ্যারিসনের কর্নেল শাফায়েত জামিল জিয়াকে বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের সংবাদ জানালে জিয়া স্বাভাবিক কণ্ঠে উত্তর দেন, ‘So what, প্রেসিডেন্ট মারা গেছে তো ভাইস প্রেসিডেন্ট আছে।’ 
১৫ আগস্ট, ২০২৩

ড. নূহ-উল-আলম লেনিনের নিবন্ধ / বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের অজানা কিছু তথ্য (প্রথম পর্ব)
বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দশক পূর্ণ হতে চলেছে। সময়ের ব্যবধানে এমন একটা প্রজন্ম জীবনের মধ্যগগন স্পর্শ করতে চলেছে, বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের সময় যাদের জন্মও হয়নি। অচিরেই এই প্রজন্ম আগামীর বাংলাদেশকে যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে। ১৯৭৫-এ আমরা যখন তরুণ ছিলাম, তারা এখন অস্তাচলগামী। যারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধিকার আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ করেছি এবং মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ও অভিঘাতের সঙ্গে কম-বেশি যুক্ত ছিলাম, বড়জোর আর এক বা দেড় দশক পর তারা ‘পরলোকে’ চলে যাবেন। ঝাঁপসা স্মৃতিতে মিলিয়ে গিয়ে একসময় ‘অজ্ঞাত পূর্ব-পুরুষে’ পরিণত হবেন।  কিন্তু ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর নাম লেখা থাকবে ইতিহাসে। নতুন প্রজন্মের শিশু-কিশোর তরুণ-তরুণী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিরা তার নাম, জীবন ও কর্ম অধ্যয়ন করবেন। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয়, বিকৃত না হলেও সে ইতিহাস হবে অসম্পূর্ণ। কেননা, এখন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পূর্ণাঙ্গ কোনো জীবনীগ্রন্থ রচিত হয়নি। বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে, কিন্তু সে-বিচারও অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে হয়তো ইতিহাসে লেখা হবে : দীর্ঘ একুশ বছর বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধ ছিল; মোশতাক-জিয়ার ইনডেমনিটি অ্যাক্টের জন্য কারও বিচার দাবি করার অধিকার পর্যন্ত ছিল না।   ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ২১ বছর পর আবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাসীন করলে সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল হয় এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার আপিল বিভাগে সে বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ রাখে। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হলে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিচারের আপিল নিষ্পত্তি হয় এবং রায় কার্যকর হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের যারা গ্রেপ্তার হয়েছিল, কেবল তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েকজন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পলাতক রয়েছে।  বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে প্রচলিত আইনে। দণ্ডবিধির ৩২০/৩৪ এবং দণ্ডবিধির ১২০(ক) ধারায়। আর দশজন সাধারণ মানুষের যেমন বিচার হয়, এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। দ্বিতীয়ত; এই বিচারে কেবল হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত অভিযুক্তদেরই বিচার হয়েছে। বিচার হয়েছে ফৌজদারি অপরাধের। রাজনৈতিক অপরাধের বিচার হয়নি। এখানেই বিচারের অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে।  স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি এবং সংবিধানসম্মত রাষ্ট্রপতিকে বন্দুকের জোরে ক্ষমতাচ্যুত এবং সপরিবারে হত্যা করার ভেতর দিয়ে হত্যাকারীরা কেবল ফৌজদারি অপরাধ করেনি, একইসঙ্গে তারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। জানা সত্ত্বেও সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান ও অন্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা (আসামিদের একটি অংশ) রাষ্ট্রপতিকে হত্যার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে অবহিত করেনি; বরং তারা ষড়যন্ত্রে মদত দিয়েছে, যুক্ত হয়েছে। বলাবাহুল্য, এই হত্যা-ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আন্তর্জাতিক নানা শক্তিও যুক্ত হয়েছিল।  নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধু-হত্যার পেছনে একটা সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল। সুতরাং, এই হত্যাকাণ্ড একটা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে যেমন এদের বিচার হতে পারে, তেমনি বিদেশি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যুক্ত থাকলে তাদেরও বিচারের সম্মুখীন করা যেতে পারে।   সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য মার্শাল ল’ কোর্ট করা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা হয়তো ভেবেছেন বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে কেউ যেন কোনো প্রশ্ন তুলতে না পারে, সেজন্য প্রচলিত ফৌজদারি আইনে বিচারিক আদালতে বিচারকার্য সম্পন্ন হোক। সত্য বটে, তাদের এই ধারণা ছিল বাস্তবসম্মত। দেশ-বিদেশের কেউই বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলতে পারেনি। কিন্তু তাতে বিচারের অসম্পূর্ণতার ব্যত্যয় ঘটেনি। উদ্ঘাটিত হয়নি বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের সাথে দেশি-বিদেশি কোন কোন শক্তি বা ব্যক্তি যুক্ত ছিল।  এ প্রসঙ্গে এ কথাটাও আলোচনা জরুরি, স্বয়ং বঙ্গবন্ধু তো জানতেন, তার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীতে একটা ক্ষুদ্র অংশ ষড়যন্ত্র করছে। এসব বিষয় জানা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু কেন কোনো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিলেন না? কোনো বাঙালি তাকে হত্যা করতে পারবে না— তার এই আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি কী?  আমরা এ দুটি প্রসঙ্গের ওপর আলোকপাত করতে চাই। জানতে চাই, বুঝতে চাই— হত্যা-ষড়যন্ত্রের সঙ্গে কারা এবং কেন জড়িত? আর বিশেষভাবে অনুসন্ধান করতে চাই, সেই মানুষটির মনস্তত্ত্ব যিনি তার নিরাপত্তার বিষয়ে কেবল নির্লিপ্তই ছিলেন না, এক অন্ধবিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে হত্যাকারীদের জন্য সুযোগ করে দিয়েছিলেন। উপেক্ষা করেছিলেন দেশ-বিদেশের সব বন্ধু-শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শ এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রসারিত হাত। বঙ্গবন্ধু-হত্যার প্রথম ষড়যন্ত্র : এ কথা আমরা সবাই জানি, ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব পূর্ববাংলার স্বাধিকারের দাবি সংবলিত ৬-দফা দাবি উত্থাপন করেন। ৬-দফা দাবি অচিরেই বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ৬-দফা প্রকৃতপক্ষেই পূর্ববাংলার মানুষের ‘মুক্তি সনদ’ হিসেবে পরিগণিত হয়। বস্তুত, ৬-দফা ছিল স্বাধিকার ও আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাঙালির জাতীয় জাগরণের অনুঘটক। ৬-দফা আন্দোলনের বিস্ফোরক উপাদান পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে শঙ্কিত করে তোলে। পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে ৬-দফা মেনে নেওয়া তাই সম্ভব ছিল না।  শেখ মুজিবুর রহমানের ৬-দফা ঘোষণার পরপরই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী অস্ত্রের ভাষায় ৬-দফার জবাব দেওয়ার হুমকি দেয়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক ডিকটেটর আইয়ুব খানের এই হুমকি পূর্ববাংলার মানুষের মধ্যে তীব্র ঘৃণা এবং ক্ষোভের সঞ্চার করে। আইয়ুব খান প্রমাদ গুণে। ১৯৬৬ সালের ৮ মে শেখ মুজিবকে জামিনঅযোগ্য আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু তার গ্রেপ্তার বাংলার মানুষকে আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন আহূত সর্বাত্মক হরতালে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। দেশে গণঅভ্যুত্থানের সম্ভাবনা দেখা দেয়।  পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তীব্র দমনপীড়ন-গ্রেপ্তার-নির্যাতন করেও স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের দাবিতে বাঙালির গণজাগরণের বাঁধভাঙা জোয়ার ঠেকাতে ব্যর্থ হচ্ছিল। এই পটভূমিতে ১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে দমনমূলক নতুন মামলা ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব গং’ মামলা সাজানো হয়। এই মামলাই ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলা হিসেবে খ্যাত। এই ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ মামলার অভিযোগ ছিল— শেখ মুজিবের নেতৃত্বে মামলায় অভিযুক্তরা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থান বা বিদ্রোহ সংঘটিত করার ষড়যন্ত্র করেছিল। তারা পাকিস্তান ভাঙার জন্য ভারতের সঙ্গে যোগসাজশ করে এবং সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীতে গোপন সংগঠন গড়ে তুলছিল। এই রাষ্ট্রদ্রোহের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।  প্রকৃতপক্ষে, এটিই ছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রণীত নীলনকশার অংশ। আগরতলা মামলার প্রধান আসামি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে এই মামলা একেবারে ভিত্তিহীন ছিল না। আগরতলা মামলার আসামিদের জবানি থেকে, তাদের স্মৃতিচারণ ও সাক্ষাৎকার থেকে সুস্পষ্ট, মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগে থেকেই অভিযুক্তরা পাকিস্তানের সশস্ত্রবাহিনীর বাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের সশস্ত্র উপায়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে সংগঠিত করার চেষ্টা করছিল। শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং গোপনে ভারতের আগরতলা গিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বস্তুত, ষাটের দশকের শুরু থেকেই শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণ ও সশস্ত্র- উভয় ধরনের সংগ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।  ছাত্রদের মধ্যে ষাটের দশকের শুরুতে (শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান ও কাজী আরেফ প্রমুখ ছাত্রলীগ নেতাদের মাধ্যমে) নিউক্লিয়াস গড়ে তোলার চেষ্টা ছিল এই সশস্ত্র প্রস্তুতিরই অংশ। বাঙালি সেনা-কর্মকর্তাদের উদ্যোগের সাথেও তিনি যুক্ত হন। ১৯৬৪-৬৫ সালেই শেখ মুজিব পাকিস্তানের করাচির ক্লিফটন বিচের অদূরে এক গোপন স্থানে বাঙালি সেনা-কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। চট্টগ্রাম বন্দরেরও নৌবাহিনীর সদস্যদের কয়েকজনের সাথে তার গোপন বৈঠক হয়।  শেখ মুজিবের আগরতলা যাওয়া এবং বাঙালি সেনা, নৌ ও সিভিল প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় এবং সশস্ত্র সংগ্রামের এই প্রস্তুতির খবর একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনা গোয়েন্দা আইএসআইর নজরে আসে। গোপন অনুসন্ধানে নিশ্চিত হয়েই তারা সিদ্ধান্ত নেয়, রাষ্ট্রদ্রোহের অকাট্য প্রমাণ হাজির করে বৈধ পথেই শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে ঝুলানো হবে। কিন্তু তাদের সেই অভিসন্ধি ব্যর্থ হয়ে যায়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ফলে খোদ আইয়ুব খানকে গদি ছাড়তে হয়। বিনাশর্তে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২২ ফ্রেরুয়ারি মুক্তিলাভ করেন। নিঃশর্তভাবে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ফলে শেখ মুজিবকে বিচারের নামে হত্যার প্রথম রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যায়।  পাকিস্তানের অনেক সামরিক কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ-বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তি আগরতলা মামলার দীর্ঘ শুনানির জন্য আইয়ুব খানের সমালোচনা করেছেন। তারা বলেছেন, আগরতলা মামলায় শেখ মুজিবের জবানবন্দি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ায়, তার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠার পরিবর্তে বাঙালি জনগোষ্ঠী তাতে আরও বেশি করে উজ্জীবিত হয়েছে। ফলে মামলাটি বুমেরাং হয়ে যায়। তাদের মত ছিল, সামরিক ট্রাইব্যুনালে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করে শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ফাঁসিতে লটকানো উচিত ছিল।  তবে এ-কথাও মনে রাখতে হবে, কেবল বিচারের মাধ্যমে নয়, কারাগারের ভেতরও শেখ মুজিব ও আগরতলা মামলার সহবন্দিদের কয়েকজনকে হত্যার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। ১৯৬৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ক্যান্টমেন্টে বন্দি অবস্থায় আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টার মনগড়া ও মিথ্যা অভিযোগে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই ঘৃণ্য ঘটনা আইয়ুব খানের পতনকে তরান্বিত করে। বিক্ষুব্ধ বাঙালি জনতা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে ঢুকে শেখ মুজিবকে মুক্ত করে আনার জন্য উদ্বেল হয়ে ওঠে। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভা থেকে ছাত্রনেতাদের তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খানের পতন হয়। সেনাবাহিনীপ্রধান ইয়াহিয়া খান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সারা দেশে সামরিক আইন জারি করেন।  বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দ্বিতীয় ষড়যন্ত্র : ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা ক্ষমতা সংহত করার পর ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। সাময়িক আইনের কঠোর বিধিনিষেধ সংবলিত লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক তথা ‘এলএফও’র মধ্যে এক ব্যক্তি এক ভোট নীতির ভিত্তিতে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনকে বঙ্গবন্ধু স্বাগত জানান। এলএফও ছিল নানাবিধ নিষেধাজ্ঞাপূর্ণ একটি কালাকানুন। কিন্তু জনগণ পক্ষে থাকায় এলএফও-র মধ্যেই বঙ্গবন্ধু নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেন। শুরু হয় নতুন ষড়যন্ত্র।  ‘১৯৬৯ সালের ২০ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু জানতে পারেন ত্যাকে হত্যার জন্য দুজন আততায়ীকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছে।’ এই তথ্য সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবমুক্ত বা প্রকাশিত গোপন নথিপত্র থেকে বিস্তারিত জানা যায়। এ-সংক্রান্ত মার্কিন নথিটি নিম্নরূপ :  ২৯ ডিসেম্বর ১৯৬৯, প্রেরক মার্কিন কনস্যুলেট ঢাকা। প্রাপক : পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ওয়াশিংটন ডিসি। অনুলিপি আমেরিকান কনসাল : করাচি, লাহোর, পেশোয়ার। কনফিডেনশিয়াল, ঢাকা। বিষয় : পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে হত্যার চক্রান্ত।  ১. ২৩ ডিসেম্বর ১৯৬৯ শেখ মুজিবুর রহমানের (Protect)) সঙ্গে ডেপুটি চিফ অব মিশন সিডনি সোবার এবং কনসাল ইনচার্জ সাক্ষাৎ করেন। এ সময় আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিব তার বিরুদ্ধে হত্যা ষড়যন্ত্রের তথ্য প্রকাশ করেন। মুজিব বলেন, ২০ ডিসেম্বর ১৯৬৯ তিনি বিষয়টি সম্পর্কে প্রথম জানতে পারেন, কিন্তু তখন গুরুত্ব দিতে চাননি। কিন্তু ২২ ডিসেম্বর তিনি এ বিষয়ে যাচাইকৃত সাক্ষ্য-প্রমাণ লাভ করেন। ফলে তার মনে আর কোনো সন্দেহ নেই, তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে।  ২. শেখ মুজিব বিশ্বাস করেন, ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যকার পাঞ্জাবিদের একটি ক্ষুদ্র চক্র রয়েছে। ওই পাঞ্জাবি সেনাচক্র, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের ধারণা মেনে নিতে পারছে না। দুই আততায়ীর মধ্যে একজন ইতোমধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানে পৌঁছে গেছে। মুজিবের সমর্থকরা অবশ্য তার প্রতিটি পদক্ষেপে নজর রেখে চলেছেন। মুজিবকে যখন প্রশ্ন করা হয়, এ বিষয়ে সামরিক আইন প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে কি না, তখন তিনি কিছুটা দ্বিধান্বিত হন। কিন্তু স্বীকার করেন, তাদের জানানো হয়েছে। (মন্তব্য : মুজিবের এই দ্বিধান্বিত হওয়াটার পেছনের কারণ হয়তো এটাই—এ বিষয়ে সামরিক আইন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে।)  ৩. মুজিব মনে করেন, ষড়যন্ত্রকারীরা যদি মনে করেন থাকেন, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় তাকে সরিয়ে দেওয়াই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উপায়, তবে পাগল ছাড়া তারা আর কিছুই নয়। তার দৃঢ় প্রত্যয় রয়েছে, পশ্চিম পাকিস্তানিদের উসকানিতে যদি তাকে হত্যা করা হয়, অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার শেষ সুযোগ হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে।  ৪. মন্তব্য : মুজিবকে হত্যার ষড়যন্ত্র সত্য-মিথ্যা যা-ই হোক, মনে করিয়ে দেওয়ার পক্ষে এটা একটা সময়োপযোগী বিষয়, পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিকদের নিরাপত্তাব্যবস্থা কল্পনাতীত রকম শূন্যের কোঠায়। আসন্ন অবাধ রাজনৈতিক কার্যক্রমকালে, বিশেষ করে শেখ মুজিব হাজার হাজার কিংবা কোনো একদিন লাখো লোক তাকে ঘিরে থাকবে। এ রকম ভিড়ের মধ্যে একজন আততায়ী মুহূর্তের মধ্যে তার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিতে পারে এবং পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য তার ফল দাঁড়াতে পারে বিয়োগান্ত।  ৫. মুজিব আলোচনাকালে অন্য যেসব প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোচনা করেছেন, তা পৃথক এয়ারগ্রাম মারফতে পাঠানো হচ্ছে।– কিলগোর উদ্ধৃত বক্তব্য থেকে এ কথা স্পষ্ট, ১৯৬৯-এর হত্যা-ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন থেকে চক্রান্তকারীরা পিছিয়ে যায়। কারা ছিল এই হত্যা ষড়যন্ত্রের পেছনে তা স্পষ্ট করে জানা না গেলেও সামরিক কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু অবহিত করার পর— এই হত্যা ষড়যন্ত্র থেমে যায় তা থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, সেনাবাহিনী বা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কোনো একটি অংশ এতে জড়িত ছিল।  মার্কিন দলিলে উল্লেখ আছে সামরিক কর্তৃপক্ষকে খবরটি জানাবেন কি না— এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু দ্বিধান্বিত ছিলেন। তবুও শেষ পর্যন্ত জানিয়েছেন। আততায়ীরা বাঙালি হলে শেখ মুজিব হয়তো বিশ্বাসই করতেন না এবং সেনা-কর্তৃপক্ষকে তা জানাতেন না। ফল যা হওয়ার তাই হতো।  বঙ্গবন্ধু-হত্যার তৃতীয় ষড়যন্ত্র: ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তারপরেই পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তাকে গ্রেপ্তার করে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের পর তাকে পাকিস্তানের লায়ালপুর কারাগারে আটক রাখা হয়।  ১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট পাকিস্তান টেলিভিশনে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন শেখ মুজিবের বিচার হবে। ৯ আগস্ট ১৯৭১ পাকিস্তানের সরকারি প্রেসনোটে ঘোষণা করা হয় বিদ্রোহ ও রাষ্ট্রদোহিতার জন্য শেখ মুজিবের বিচারের জন্য সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। ১১ আগস্ট থেকে ক্যামেরা ট্রায়াল হবে। এটা ধরেই নেওয়া হয়েছিল, এই বিচার-প্রহসনের নামে শেখ মুজিবকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে হত্যা করা হবে। এ সম্পর্কে জার্মানির বন থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা উবৎ ঝঢ়রপমবষ-এর ৩০ আগস্ট সংখ্যায় বলা হয়, ‘অবশ্যই শেখ মুজিবকে ফাঁসি দেওয়া হবে। বিশেষ সামরিক আদালতে পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি শফি ইতোমধ্যে জ্ঞাত হয়েছেন, শেখ মুজিবকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হবে। পরে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, পাকিস্তানের প্রখ্যাত আইনজীবী এ কে ব্রোহিকে বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। বিচার প্রহসনে বঙ্গবন্ধুকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।’  এদিকে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছিল। ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে। শুরু হয়ে যায় ভারত-পাকিস্তান পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ। একই সঙ্গে বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের যৌথ কমান্ড গঠিত হয়। ভারতীয় এবং বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী সমন্বিত কৌশল নিয়ে বাংলাদেশকে হানাদার মুক্ত করার অভিযান চালায়। মাত্র ১২ দিনের যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহওয়ার্দী উদ্যান) যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।  পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয়ের মুখে বঙ্গবন্ধুকে লায়ালপুর কারাগার থেকে শেহাল নামের একটি রেস্ট হাউসে স্থানান্তর করা হয়।  সেখানে ভারতীয় যুদ্ধবন্দিদের দিয়ে কবর খোঁড়া হয়। হত্যার পর ইয়াহিয়া তাকে সেখানে কবরস্থ করার উদ্দেশ্যেই এই নির্দেশ দেন। ইতোমধ্যে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার ফলে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় কে থাকেন এ প্রশ্নে একটা ‘সরকারহীন’ অবস্থার সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য জুলফিকার আলী ভুট্টো চাপ সৃষ্টি করে। বাধ্য হয়ে ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে জেনারেল ইয়াহিয়া।  কিন্তু ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বে শেখ মুজিবকে হত্যার অনুমতি চায় ভুট্টোর কাছে। ভুট্টো পাকিস্তানের ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দি এবং লাখ লাখ অবাঙালি পাকিস্তানি নাগরিকের নিরাপত্তার কথা বলে, ইয়াহিয়াকে মুজিব হত্যার উদ্যোগ থেকে বিরত রাখে।  ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বিখ্যাত মার্কিন টেলিভিশন ভাষ্যকার ডেভিট ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এই বিখ্যাত সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের কারাগারে তাকে হত্যার পরিকল্পনা সম্পর্কে যে কথাগুলো বলেছেন, নিচে তা উদ্ধৃত করা হলো : ফ্রস্ট : আপনার বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ?  শেখ মুজিব : রাজদ্রোহের। পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ইত্যাদি। সব মিলিয়ে ১২টা অভিযোগ। তার মধ্যে ছয়টার শাস্তি— মৃত্যুদণ্ড।  ফ্রস্ট : আপনি কি আত্মপক্ষ সমর্থন করেছিলেন?  শেখ মুজিব : বিচারের বাণী যেখানে নীরবে নিভৃতে কাঁদে সেখানে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়ার মানে ভাওতার আশ্রয় নেওয়া। পাকিস্তান সরকার যেখানে আমার বিচার করতে বদ্ধপরিকর সেখানে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ কোথায়? কোর্টে নেওয়ার পর আমি কোর্টের কাছে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য একজন আইনজ্ঞ নিয়োগের অনুমতি প্রার্থনা করি। কেননা, আমি একজন অসামরিক ব্যক্তি। একজন অসামরিক ব্যক্তির বিচার সামরিক আদালতে কখনও হতে পারে না, কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান ইয়াহিয়া খান শুধু রাষ্ট্রপ্রধান নন, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকও। কাজেই সামরিক আদালত ডাকার ক্ষমতা একমাত্র তারই। তাছাড়া সবাই জানে বিচারের নামে একটা প্রহসন চলছিল।  ফ্রস্ট : তাহলে কি আপনার বিচারের শাস্তির সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ছিল ইয়াহিয়া খানের?  শেখ মুজিব : হ্যাঁ, তিনি ছিলেন সিদ্ধান্তদাতা।  ফ্রস্ট : তারা কি যথাযথ রায় দিতে সক্ষম হয়েছিল?  শেখ মুজিব : ডিসেম্বর মাসে চার দিন কোর্ট মুলতবি ঘোষণা করে ইয়াহিয়া খান সব বিচারক, লে. কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার সবাইকে নিয়ে রাওয়ালপিন্ডিতে এক জরুরি সভায় মিলিত হয়ে বিচারের রায় কী হবে সে সম্বন্ধে তার মতামত ব্যক্ত করেন। সর্বসম্মতিক্রমে আমাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।  ফ্রস্ট : আপনি কি তখন আপনার পাশের সেলে আপনার কবর আবিষ্কার করেন?  শেখ মুজিব : হ্যাঁ, আমার সেলের খুব কাছেই আমার কবর খোঁড়া হয়। কবরটাকে স্বচোখে দেখেছি।  ফ্রস্ট : ইয়াহিয়া খান যখন আপনাকে হত্যা করার জন্য নিতে আসে তখন জেল প্রশাসক আপনাকে লুকিয়ে রেখেছিলেন বলে আমি খবরের কাগজে পড়েছি। তথ্যাটা কি সঠিক?  শেখ মুজিব : ইয়াহিয়া খানের সাগরেদরা জেলের ভেতর একটা তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলেছিলেন। কিছু কয়েকদিকে আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা হয়েছিল। খুব ভোরে আমাকে আক্রমণ করে হত্যা করার একটি পরিকল্পনা আঁটা হয়েছিল; কিন্তু জেলের একজন অফিসার আমার প্রতি বেশ সদয় ছিলেন। তিনি ইয়াহিয়া খানের জেলে আসার দিনক্ষণ সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতেন। একদিন রাত ৩টার সময় তিনি আমাকে কারাগারের বাইরে নিয়ে এসে তার বাংলোয় আমাকে মিলিটারি পাহারা ছাড়াই লুকিয়ে রাখেন। দুদিন পর আমাকে ওই বাংলো থেকে সরিয়ে রাখেন। সেখানে তিনি আমাকে চার-পাঁচ কিংবা ছয় দিন লুকিয়ে রাখেন। কেউ আমার অবস্থান জানত না। জেলের কয়েকজন গরিব অফিসার শুধু আমার সন্ধান জানত।  ফ্রস্ট : ইয়াহিয়া খান যখন আপনাকে ভুট্টোর হাতে তুলে দেন তখন তিনি আপনাকে আবার ফাঁসি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন— এটা কি সত্য?  শেখ মুজিব : নির্ভেজাল সত্য। এ প্রসঙ্গে মি. ভুট্টো আমাকে একটি মজার গল্প বলেছিলেন। ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় ইয়াহিয়া খান মি. ভুট্টোকে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবকে হত্যা না করে আমি একটি বিরাট ভুল করে ফেলেছি।’  ফ্রস্ট : ইয়াহিয়া খান কি ঠিক এ কথাই বলেছিলেন?  শেখ মুজিব : হ্যাঁ, ইয়াহিয়া খান ভুট্টোকে বলেছিলেন, ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে মুজিবকে হত্যার অনুমতি দিন। তিনি আরও বলেছিলেন : দিন তারিখ পিছিয়ে দিন, ক্ষতি নেই। কিন্তু দয়া করে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে মুজিবকে হত্যা করার অনুমতি দিন। কিন্তু ভুট্টো মত দেননি। প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেছেন।  ফ্রস্ট : এর জবাবে ভুট্টো কি বলেছিলেন তা কি তিনি আপনাকে বলেছিলেন?  শেখ মুজিব : হ্যাঁ, ভুট্টো বলেছিলেন, তিনি তা পারেন না, কারণ এর প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। এক লাখ বিশ হাজার সৈন্য এবং বেসামরিক ব্যক্তি তখন বাংলাদেশে বন্দি, বাংলাদেশ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর কব্জায় তারা দিন কাটাচ্ছে। এ ছাড়া পাঁচ থেকে দশ লাখ অবাঙালির অবস্থান বাংলাদেশে। এ অবস্থায় শেখ মুজিবকে যদি হত্যা করা হয় এবং আমি যদি ক্ষমতা দখল করি তাহলে বাংলাদেশ থেকে একজন পাকিস্তানিও পশ্চিম পাকিস্তানে আর কোনো দিন ফিরে আসতে পারবে না। এরা ফেরত না এলে পশ্চিম পাকিস্তানে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে এবং আমার অবস্থাও শোচনীয় হবে। মৃত্যুর কালো গহ্বর থেকে বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন— মুজিব হত্যার তৃতীয় ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলো। (চলবে....)  ড. নূহ-উল-আলম লেনিন: একজন বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ, গবেষক, লেখক ও সংগঠক। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর মুখপত্র মাসিক 'উত্তরণ' এর সম্পাদক ও প্রকাশক।
১৪ আগস্ট, ২০২৩
X