জন্মদিন / আনোয়ারা সৈয়দ হকের ‘তৃষিতা’জীবনতৃষ্ণার মূল্যবান আকর
আনোয়ারা সৈয়দ হকের ‘তৃষিতা’ আখ্যানের কেন্দ্রীয় চরিত্র আবেগে উদ্বেলিত তুলি (রাহিজা)। আবহমানকাল ধরে আদিগন্ত সমতলচরাচরব্যাপী সোনালি গোধূলি-ক্যানভাসকে কালো কালিতে চোব্রানো তুলির আঁচড়ে ঢেকে দিয়ে, সেই আন্ধারের পটে আনোয়ারা জ্বালিয়ে দিয়েছেন সোনালি পিদিম শিখা। মাটির সোঁদা গন্ধে সুরভিত উঠোন, বাড়ি, বাঁশবাগান, নারিকেলগাছের ছড়ানো আবছায়া পেরিয়ে কেবলই পিদিম শিখাকে নিশানা করে লক্ষ্যে পৌঁছানোর মানসব্রত ধারণ করেন তুলি। এই তুলি-চরিত্রটির বরাতে উপন্যাসিক আনোয়ারা সৈয়দ হক একঝলক অলীক পিদিম শিখা এঁকে দেখিয়েছেন আমাদের হাজার-হাজার বছরের সুগন্ধভরা ভাত ও জাউয়ের ঐতিহ্যের ইন্দ্রজালিক দৃশ্যকল্প।
২.
যদিচ তার কাহিনিটি নিরাভরণ, চপলচরণ দুপায়ে চলার মাধুর্যনির্ভর নাগরিক চিত্রনাট্য। তুলি মেডিকেল কলেজের ছাত্রী। তার জীবনে প্রেম এসেছে। মুশতাক। একজন লেখক। সে তুলিকে ভালোবাসে। তুলিও ভালোবাসে মুশতাককে। তুলি ভাবে : ‘এসব কোনো দিনও সত্যি হবে না। এ কেবল মেয়েমানুষ হয়ে জীবন উপভোগ করবার কল্পনা—যে জীবন বর্ণময়, গন্ধময়, রোমাঞ্চকর এবং যে জীবন উপভোগ করার সাহস বোধকরি কোনো দিন হবে না।’ তুলির এই হৃদয়বৃত্তি শতদল পাপড়ি মেলতে চায়। তুলি ভাবে তার মুশতাক আছে। কিন্তু সুদর্শন পাঞ্জাবি যুবক ফাররুখ তুলির রবীন্দ্রসংগীত শুনে অনুষ্ঠান শেষে তার সঙ্গ খুঁজে-পেতে দেখা করে। এই একতরফা দেখা করার বিরাম নেই। এদিকে মুশতাক যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে। ঝোঁক চাপলে তুলি নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। তুলিকে পরামর্শ দিয়েছে মুশতাক—নিজেকে স্থির রাখতে পারাটাই নাকি বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু সমগ্র উপন্যাসে তুলি এই বুদ্ধির কাজটুকু করতে ব্যর্থ হয়েছে। এটা কি নারী-চরিত্রের সাধারণ বৈশিষ্ট্য? কুমকুম, লিলি, হাসিনাসহ সহপাঠিনীদের সঙ্গে যে শিক্ষাজীবন চলমান ছিল, তুলির সম্মুখে তার নিরুপদ্রব প্রেমপ্রবাহ দ্বিধাবিভক্ত করে দেয় মিলি চৌধুরীর উপস্থিতি, যে মিলি চৌধুরী মুশতাকের পূর্বপরিচিতা কিংবা প্রেমিকা। এসব টানাপোড়েন এক নাটকীয় অস্থিরতার জন্ম দেয় তুলির জীবনে। কিন্তু একসময় স্থিরতা ফিরে-পাওয়া তুলি নিজেই ফিরে আসে মুশতাকের বাড়িতে। এখানেই কাহিনি চরম পরিণতি পায়। চরম নাটকীয়তার মুখে মুশতাক তুলিকে কক্ষে বন্ধ করে পাশাপাশি বসে। তুলির কোনো ভয় নেই। মুশতাকেরও কোনো আগ্রাসী ঔদ্ধত্য নেই। আছে দুজনের চরম বিরক্তিকর মুহূর্তের মাঝেও অটুট অবিনাশী প্রেম। তারা কথা বলে—পাশাপাশি শুয়ে। তুলি প্রস্তাব দেয় সাত দিনের মধ্যেই বিয়ের আয়োজনের। তাদের কথন-উপকথনের মধ্য দিয়ে মুশতাক তার দার্শনিক ভাষ্য প্রকাশ করে। আর এভাবেই কাহিনির সমাপ্তি ঘটে। ‘তৃষিতা’ উপন্যাসের এ ভাষ্য চরিত্রদের স্বকীয় অভিজ্ঞতালব্ধ এক মূল্যবান সংযোজন : মুশতাক ধীরগলায় বলল, ‘তুমি আমাকে ছেড়ে যাবার পর থেকে অনেক ভেবেছি। রাতদিন ভেবেছি। ভেবেছি মৃত্যু কী? মৃত্যু হচ্ছে এই মহাজীবনেরই একটা ট্রানজিশনাল পিরিয়ড। এক থেকে অন্য এক রূপান্তর। সেই হিসেবে সত্যিকারের মৃত্যু কখনোই নেই। আর ভালোবাসা কী? ভালোবাসা বলে কিছু নেই। স্থায়ী কিছু নেই। ভালোবাসা হচ্ছে, এই তুমি যেমন এখন আমার চোখের সামনে। এই বর্তমান। বর্তমানের এই মুহূর্তে। মুহূর্তের এই অনুভব। এই আকুলতা। এই দেহ ও মনকে এই মুহূর্তে ছুঁয়ে যাবার বাসনা এবং এ এমন একটা জিনিস, যা আজ থেকে কাল, কাল থেকে পরশু রং পাল্টাচ্ছে। মিলির জন্য আমার যে ভালোবাসা, তা বর্তমানে এক রূপান্তরিত শিলা। তার অবয়ব আছে কিন্তু আবেগ নেই। তা অনুভবহীন, শীতল। হয়তো সেই অর্থে আমি তোমাকেও একদিন ভালোবাসব না। আমি কাউকেই আর একদিনও ভালোবাসব না তুলি। সেদিন আর কোনো বিচ্ছেদ আমাকে বিচলিত করবে না। কোনো আক্ষেপও আমাকে আচ্ছন্ন করবে না অপরাধবোধে।’
জীবনের অগ্রগামী যাত্রাপথের শেষ নিঃশ্বাস মৃত্যু। তারপর কী? তারপর মহাজীবন। মহাজীবনের প্রবেশপথই মৃত্যু। ট্রানজিশনাল পিরিয়ড। শেষ বলে কিছু নেই। রূপান্তর ঘটে কেবল। জীবনের এ রূপান্তর অনিবার্য এসব দর্শনকথনের ভেতর লুকিয়ে আছে জীবনের প্রাণশক্তিও। শক্তির ক্ষয় নেই, লয় নেই। একপর্যায় থেকে আরেক পর্যায়ে তার রূপান্তর ঘটে। এ প্রক্রিয়ায় জীবনের নির্যাস অর্থাৎ ‘সময়’-এর যথাযথ ব্যবহার করে কর্মের মাধ্যমে অনন্ত সময় বেঁচেও থাকতে পারে মানুষ। তাই তো শব্দশৃঙ্খলে বেঁধে মুশতাক বলতে পারে, ‘সত্যিকারের মৃত্যু কখনোই নেই।’
৩.
সুখে-দুখে উপভোগ্য জীবনের আরেকটা অনিবার্য সত্য ‘আবেগ’। এটা সহজাত। ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা, সুখ-আনন্দ, রাগ-ক্রোধ, ঈর্ষা-হিংসা ঘৃণা এসব আবেগের উদাহরণ। ভালোবাসাও এক পজিটিভ ইমোশন, ইতিবাচক আবেগ। এটাও একধরনের শক্তি, মনের শক্তি। মনের এ তীব্র টান, মনের আকুলতা-ব্যাকুলতা লুকিয়ে থাকে অন্তর্গত শক্তি বা তাড়না, ‘ইনার ফোর্সে’র মধ্যে। এ ভালোবাসা নিয়ে মুশতাক বলছে, ‘ভালোবাসা বলে কিছু নেই। স্থায়ী কিছু নেই।’
কী ভয়াবহ কথা! এমন কথা পড়তে গিয়ে চমকে উঠবেন পাঠক।
মূলত দুজন মানব-মানবী দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকার কারণে একটি অদৃশ্য মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে যান। এই বাঁধনে শক্ত গিঁট এঁটে দেয় এন্ডোরফিনস নামক রাসায়নিক উপাদান এবং অক্সিটোসিন নামক হরমোন। এন্ডোরফিনস দুজনার মধ্যে শান্ত-সৌম্য নিরাপত্তার অনুভূতি জাগায়, বিশ্বাস জাগায়, উন্মাতাল ঢেউ জাগায় না। এ মায়ার বাঁধন ও নিরাপত্তা বোধের অসাধারণ স্কেচও আমরা দেখেছি তুলি আর মুশতাকের সম্পর্কে। প্রধানত উত্তাল অনুভূতি তৈরি হয় কমবয়সী প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে। ‘পি পদার্থের’, উপস্থিতিই এখানে মুখ্য। কম বয়সের প্রেম দ্রুত মিলিয়ে গেলেও নিঃশেষ হয়ে যায় না। এদের প্রেম পাত্র থেকে পাত্রে সঞ্চারিত হয়। নতুন মুখ, নতুন চোখ, নতুন হাসি তুমুল উদ্দীপনায় আবার মস্তিষ্ককে উদ্দীপ্ত করে, নতুন করেই সমান মাত্রায় ‘পি পদার্থ’র নিঃসরণ বাড়িয়ে তুলতে পারে। নতুন প্রেমের জোয়ার পূর্ণোদ্যমে আবার চলে আসে এভাবেই। আর এন্ডোরফিনসের কারণে ভালোবাসায় স্থিতি আসে বিধায় প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রী নিজেদের অনেক ভুলত্রুটি সয়ে নিতে পারে। হুট করে এদের ভালোবাসা চলে যায় না, রং বদলায় না। এখানে ‘বিশ্বাস’ বড় শক্তিরূপে হাজির হয়। জনম জনম একে অন্যকে ভালোবাসব, ‘বর্তমান’-এর এ বিশ্বাসই বর্তমানকে রাঙিয়ে দেয়। ভবিষ্যতে তা স্থায়ী না হলেও বর্তমান হয় উপভোগ্য, আনন্দময়। বিজ্ঞানের এসব সত্যকথনও আমরা দেখতে পাই মুশতাকের দর্শনতত্ত্বে। তাই জীবনের শিকড় উপড়ে মুশতাক বলতে পারে, ‘ভালোবাসা বলে কিছু নেই। স্থায়ী কিছু নেই।’
এখানে আমরা দেখেছি মুশতাকের অসাধারণ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। আর আবেগের টানে চলতে গিয়ে বুদ্ধির ধার কমে গেছে তুলির, তাও দেখেছি সমগ্র উপন্যাসে।
‘তৃষিতা’ উপন্যাসের গভীরতলে মনস্তাত্ত্বিক এক চেতনা-প্রবাহও রয়েছে নিয়তই বর্তমান, যা উপন্যাসটিকে অনন্য মর্যাদার আসনে তুলে ধরে রাখতে পেরেছে বলে বিশ্বাস।
০৩ নভেম্বর, ২০২৩