বিনামূল্যে ১ মিনিটের ঈদবাজার
সারি সারি সাজানো নতুন পোশাক। একদল শিশু ঘুরে ঘুরে পোশাক পছন্দ করছে। কেউ জামা পছন্দ করছে, কেউবা শার্ট। শিশুদের সঙ্গে অভিভাবকরাও আছেন। সাজানো পোশাকগুলো কিনতে শিশু কিংবা তাদের অভিভাবকদের ব্যয় করতে হচ্ছে না কোনো টাকা। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে করতে পারছেন ঈদের কেনাকাটা। ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে সোমবার (৮ এপ্রিল) ব্যতিক্রমী এই আয়োজন সাজানো হয়েছে সাভারের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের হেমায়েতপুর এলাকায়।  ‘উৎসব হোক সবার জন্য’ স্লোগানকে সামনে রেখে তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফখরুল আলম সমর ও ওয়াসিল উদ্দিন ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে ১ মিনিটে ঈদ বাজারের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে মাত্র ১ মিনিটেই এলাকার অসহায় দরিদ্র পরিবারের সদস্যরা মনের খুশিতে ঈদের বাজার করছেন।  ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ফখরুল আলম সমর ব্যতিক্রমী এ উদ্যোগের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন।  ঈদ বাজারের উদ্বোধন করেন সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীব। ইউনিয়নের হেমায়েতপুর বড় মসজিদ রোডে অবস্থিত চেয়ারম্যান বাড়িতে এ বাজারের আয়োজন করা হয়। অস্থায়ী এই বাজারের বিভিন্ন স্টল থেকে শিশুকিশোরসহ নানা বয়সী মানুষরা বিনামূল্যে ঈদের নতুন জামাকাপড়, শাড়ি, লুঙ্গি  জুতাসহ পাচ্ছেন। এ ছাড়া মিলছে মুরগি, চাল-ডাল, সেমাই, চিনি-দুধসহ আরও অনেক রকম খাদ্যসামগ্রী। দিনব্যাপী চলা বিনামূল্যের এই বাজার থেকে ঈদের জামাকাপড়, শাড়ি, লুঙ্গি জুতাসহ দরকারি খাদ্যপণ্য পেয়ে খুশি সমাজের নানা বয়সী অসহায় হতদরিদ্র পরিবারের মানুষ। এ ঈদ বাজারে কেনাকাটা করতে এসে সুমন ইসলাম নামে এক প্রতিবন্ধী যুবক বলেন, এখান থেকে শার্ট, জুতা এবং পরিবারের জন্য ঈদের বাজার নিয়েছি। এই শার্ট পরেই ঈদের দিন নামাজে যাব। চেয়ারম্যান ফখরুল আলম সমর কালবেলাকে বলেন, অসহায় হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর পাশে থাকতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। যতদিন বেঁচে থাকব, সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখ কষ্টগুলোকে ভাগাভাগি করে একসঙ্গে বেঁচে থাকতে চাই। সমাজের বিত্তবানদের অসহায় ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে পাশে থাকার আহ্বান জানাই।
০৮ এপ্রিল, ২০২৪

নওগাঁয় জমে উঠেছে ঈদবাজার
ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে নওগাঁর নিয়ামতপুরে জমে উঠেছে ঈদবাজার। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ফুটপাত থেকে শুরু করে অভিজাত বিপণিবিতানগুলোতে ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড় বেড়েছে। মূলত গত সপ্তাহ থেকে শুরু হয়েছে উৎসবের কেনাকাটা। চৈত্রের প্রবল তাপ উপেক্ষা করে পরিবার-পরিজনের জন্য নতুন পোশাক, জুতা, প্রসাধনী কিনতে বিপণিবিতানগুলোতে ভিড় করছেন নানা বয়সী মানুষ। ঈদ যত এগিয়ে আসছে নিয়ামতপুরে মার্কেটগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় ততই বাড়ছে। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে মার্কেটগুলোতে করা হয়েছে আলোকসজ্জা। তবে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে ক্রেতারা এবার ঈদে হাত খুলে কেনাকাটা করতে পারছে না বলে জানিয়েছেন ক্রেতারা। বুধার (৩ এপ্রিল) নিয়ামতপুর সদর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বিপণিবিতানগুলোতে পোশাক থেকে শুরু করে জুতা, গহনা, ঘরের অন্দরসজ্জাসামগ্রী, ক্রোকারিজ ও ইলেকট্রনিক জিনিসপত্রসহ বিভিন্ন পণ্য কিনতে ক্রেতারা ভিড় করছেন। উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে ক্রেতারা ঈদের কেনাকাটা করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। শাড়ি, লুঙ্গি, শিশু পোশাকের দোকানসহ গার্মেন্টস দোকানে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। প্রচণ্ড গরম উপেক্ষা করে ক্রেতারা প্রিয়জনের ঈদের পোশাক কিনতে বিভিন্ন দোকানে ভিড় করছেন। দোকানিরা ক্রেতাদের পছন্দ মাথায় রেখে আলিয়া কাট, আরিগ্রাউন্ড, ইন্ডিয়ান গ্রাউন্ড, নাইরা কাট, সারারা, গাড়ারা ও পাকিস্তানি গাউন দোকান সাজিয়েছেন। এর মধ্যে ক্রেতাদের প্রধান আকর্ষণে পরিণত হয়েছে নারীদের আলিয়া কাট আর নাইরা কাট জামা। এ ছাড়া বাচ্চাদের পোশাক, বিশেষ করে বিভিন্ন নকশার পাঞ্জাবিতেও রয়েছে সমান আকর্ষণ। মেয়েকে নিয়ে কেনাকাটা করতে আসা মোরশেদা বেগম বলেন, সব জিনিসপত্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কাপড়ের দাম। জামা কাপড়ের দাম অনেক বেশি। গত বছরের চেয়ে এবার দ্বিগুণ বেশি দামে পোশাক বিক্রি হচ্ছে। মেয়ে বায়না ধরেছে এজন্য যত কষ্টই হোক না কেন, মেয়েকে নতুন পোশাক কিনে দিতেই হবে। ব্যবসায়ী লিটন ইসলাম বলেন, সব বয়সী শিশুদের বিভিন্ন ডিজাইন ও রঙিন জামা নিয়ে দোকান সাজিয়েছি। ঈদ যতই ঘনিয়ে আসছে ততই ক্রেতারা দোকানে আসতে শুরু করেছে। আশা করছি বিগত বছরগুলোর চেয়ে এবার ব্যবসা ভালোই হবে।
০৩ এপ্রিল, ২০২৪

জমে উঠেছে ঈদবাজার
ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে রাজধানীতে জমে উঠেছে ঈদবাজার। মূলত গত সপ্তাহ থেকে শুরু হয়েছে উৎসবের কেনাকাটা। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ফুটপাত থেকে শুরু করে অভিজাত বিপণিবিতানগুলোতে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় বেড়েছে। চৈত্রের প্রবল তাপ উপেক্ষা করে পরিবার-পরিজনের জন্য নতুন পোশাক, জুতা, প্রসাধনী কিনতে বিপণিবিতানগুলোতে ভিড় করছেন নানা বয়সী মানুষ। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র। ক্রেতা-বিক্রেতাদের দরদামে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলছে কেনাবেচা। ফুটপাত ও ভ্যানগাড়িতে অস্থায়ীভাবে বসা দোকানেও কেনাকাটা চলছে পুরোদমে। রাজধানীর পীর ইয়ামেনী মার্কেট, খদ্দর মার্কেট, শরীফ শপিং কমপ্লেক্স, ইসলামপুরের বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা পোশাকের দোকান, গুলিস্তানের জুতার মার্কেট, নিউমার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট, চাঁদনীচক মার্কেট, ফুলবাড়িয়া মার্কেট, বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটসহ রাজধানীর বিভিন্ন শপিংমল ছিল লোকে লোকারণ্য। মানুষ নিজেদের সাধ্যমতো প্রিয়জনদের জন্য কেনাকাটায় ব্যস্ত ছিলেন। এসব মার্কেটের ভেতরে ও আশপাশের রাস্তাগুলোতেও হাঁটার মতো অবস্থা ছিল না। সবখানেই ক্রেতাদের ভিড় ছিল। বিক্রেতারা বাহারি রঙের সব পোশাক সাজিয়ে রেখেছেন। কেউ পোশাক শরীরে ট্রায়াল দিচ্ছেন। কেউবা বাচ্চাদের পোশাক কেনায় ব্যস্ত। কেউবা শাড়ি, কসমেটিকস, গহনা, জুতার দোকানে ভিড় জমিয়েছেন। ছেলেদের পাঞ্জাবির দোকানগুলোতেও ছিল চোখে পড়ার মতো ভিড়। থেমে নেই কেউ, সবাই ছুটছেন পছন্দের পোশাকের সন্ধানে। ভিড়ের কারণে ক্রেতার সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলারও সুযোগ পাচ্ছেন না বিক্রেতারা। এর মধ্যেই পছন্দের কাপড় কিনছেন ক্রেতারা। ছেলেরা বেশি কিনছেন শার্ট, প্যান্ট, টি-শার্ট ও পাঞ্জাবি। আর তরুণী ও নারীরা কিনছেন শাড়ি, থ্রি-পিস ও ফ্রক। এ ছাড়া জুতার দোকানেও বিক্রি বেড়েছে অনেক। রাজধানীর পীর ইয়ামেনী মার্কেটের দোকানগুলোতে ছেলেদের জন্য নানা রঙের নানা ডিজাইনের বাহারি সব পাঞ্জাবি। এ ছাড়া মার্কেটটিতে পাওয়া যাচ্ছে নতুন নতুন কালেকশনের বাহারি কারুকাজ, হাতের নকশা, নানা রঙের কাতান, জামদানি, প্রিন্টের বাহারি শাড়িসহ বিভিন্ন ধরনের পোশাক। নতুন সাজে সেজেছে দোকানগুলোও। ক্রেতারা বলেন, এই পীর ইয়ামেনী মার্কেটটিতে এক জায়গাতেই শাড়ি ও পাঞ্জাবি পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে ফুলবাড়িয়া মার্কেটে জুতার দোকানগুলোতে ভিড় করছে মানুষ। এখানে নারী ও পুরুষদের সব রকম জুতা পাওয়া যাচ্ছে পাইকারি ও খুচরা দামে। নিউ মার্কেট, গাউছিয়া, চাঁদনীচক, ধানমণ্ডি হকার্স মার্কেটে নারী-পুরুষ ও শিশুদের সব রকম পোশাক এবং সব রকম প্রসাধনী পাওয়া যাচ্ছে। নিউ মার্কেটের ভেতর একটি দোকানের সামনে ফুটপাতের একটি দোকান থেকে শিশু সন্তানের জন্য পোশাক কিনছেন আরিফ। তিনি বলেন, মূলত আজকে পরিবারের জন্য ঈদের কেনাকাটা করতে বের হয়েছি। দেশের বাড়িতে যাব তাই পরে আর সময় পাব না। শুক্রবার ছুটির দিন, এই সুযোগে আগেভাগেই কেনাকাটা করতে আসলাম। বাজারে সব কিছুর দাম বেশি তারপরও চেষ্টা করছি সাধ্যের মধ্যে পরিবারের সবার জন্য কিছু কিনতে। নিউমার্কেটের পোশাক ব্যবসায়ী আল আমিন বলেন, ঈদের বেচাবিক্রি মোটামুটি হচ্ছে। তবে আমাদের গত করোনার ও তার পরবর্তী বছরগুলোতে যে লোকসান, তা কাটিয়ে ওঠার মতো নয়। তবে আশা করছি, এ বছর নতুন করে লোকসানে পড়তে হবে না। গাউছিয়া ও চাঁদনীচকের সামনের রাস্তায় ফুটপাতে বিক্রি হচ্ছে নারীদের সাজসজ্জার অলংকার। সেখানে গিয়ে দেখা যায় নারীদের ভিড়। কলেজ শিক্ষার্থী তাবাসুম মিম একটি দোকানে কানের দুল দেখছেন। তিনি কালবেলাকে বলেন, রোববার বাড়ি যাব। কলেজে তেমন ক্লাসও হচ্ছে না। তাই বাড়ি চলে যাচ্ছি। তার আগে কিছু জিনিসপত্র কিনতে আসলাম নিজের ও ছোট বোনের জন্য। ঈদের দিন সবাই মিলে আনন্দ করি নতুন পোশাক পরি, সাজসজ্জা করি। বাজারে সব কিছুর দাম এত বেশি, তারপরও নিজের টিউশনির টাকায় ছোট বোন ও আব্বা-আম্মার জন্য কিছু কিনতে পারছি, এই আনন্দ অনেক। ইসলামপুরে দুপুরে পাইকারি ও খুচরা ক্রেতাদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। ইসলামপুরে পাইকারি ও খুচরা থ্রি-পিস এবং প্রিন্ট শাড়ি বিক্রি করে নূর টেক্সটাইল। এ প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ হাবিব বলেন, ঈদ উপলক্ষে বিক্রি শুরু হয়েছে। পাইকারি ও খুচরা বিক্রি সব ভালো। ক্রেতাদের ভিড়ও চোখে পড়ছে। আশা করি, এ বছর আশানুরূপ বিক্রি হবে। ইসলামপুরে সোনারগাঁ শাড়ি বিতানে শাড়ি দেখছে নিতু আহম্মেদ ও তার স্বামী আসিফ আহম্মেদ। নিতু কালবেলাকে বলেন, নিজের জন্য, শাশুড়ি ও আমার মায়ের জন্য শাড়ি কিনতে এসেছি; কিন্তু এ বছর শাড়ির দাম গতবারের তুলনায় বেশি। দেখছি দরদামে পড়লে এখান থেকেই তিনটি শাড়ি নিয়ে যাব। এ বছর ঈদ উপলক্ষে বড় ছুটি পেয়েছি তাই এবার গ্রামের বাড়িতে যাব পরিবারের সঙ্গে ঈদ পালন করতে পারব।
৩০ মার্চ, ২০২৪

পোশাকের দাম বেড়েছে ২৫-৫০% পর্যন্ত / মূল্যস্ফীতির দ্বিমুখী চাপে ঈদবাজার
নতুন পোশাকে ঈদের খুশি ভাগাভাগির রেওয়াজ দীর্ঘকালের। বাংলাদেশে এটি পরিণত হয়েছে সামাজিক ঐতিহ্যে। ফলে প্রতি বছর পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের মনস্তুষ্টি ও সামাজিকতা রক্ষার চেষ্টা কমবেশি সব পরিবারেই থাকে। এবারও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ঈদের দিন যত ঘনিয়ে আসছে নতুন পোশাক কেনার তাগিদও ঘরে ঘরে ততই জোরালো হচ্ছে। বিভিন্ন মার্কেট, শপিংমল ও বিপণিবিতানে চোখ রাখলেই সেটি টের পাওয়া যায়। ঈদ এলে জামা-জুতা, খাদ্যসামগ্রী কেনাকাটার বাড়তি চাপ থাকাটা খুব স্বাভাবিক বিষয় হলেও এবার পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। নানা কারণে সময়টি খুব প্রতিকূল হয়ে উঠেছে। ফলে সীমিত আয়ের মানুষের কাছে এবার সামাজিকতা রক্ষার জন্য ঈদের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা যেন রীতিমতো আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। কারণ অন্যান্য ঈদে পোশাকসামগ্রীর দাম কিছুটা চড়া থাকলেও জীবনযাত্রার সার্বিক ব্যয় অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু এবার একদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার বাইরে, অন্যদিকে পোশাকসহ ঈদ সংশ্লিষ্ট পণ্যের দামও বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। ফলে এ বছর ঈদবাজার পড়েছে মূল্যস্ফীতির দ্বিমুখী চাপে। অর্থনীতিবিদদের মতে, বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ আমদানি নিয়ন্ত্রণ, ডলারের দামের অস্থিরতা, পণ্যভিত্তিক কারসাজি, সিন্ডিকেট রুখতে সরকারের কার্যকরী উদ্যোগের অভাব এবং আইনের শাসনের দুর্বলতাসহ নানা কারণে গত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে দেশ এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। যার প্রভাবে জীবনধারণে ব্যবহার্য সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম আকাশ ছুঁয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে মানুষের আয় না বেড়ে উল্টো অনেক ক্ষেত্রে সংকুচিত হয়েছে। অর্থনীতিতে নতুন কর্মসংস্থানের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। ফলে দীর্ঘদিন ধরেই আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মেলাতে মানুষের হিমশিম দশা। এ অবস্থায় অনেকের কাছেই সামাজিকতা রক্ষার নামে ঈদ কেনাকাটার চাপ নিঃসন্দেহে দীর্ঘ নিঃশ্বাসে পরিণত হয়েছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, ‘ঈদে সবাই আনন্দ করতে চায়। তবে এবার মানুষকে একটু বুঝেশুনেই আনন্দ উদযাপন করতে হবে। এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে মূল্যস্ফীতির চাপে ভুগছে ক্রেতা-ভোক্তা তথা দেশ। তদুপরি আয় বৈষম্যও মারাত্মকভাবে বেড়েছে। দেশের অর্ধেকের বেশি আয় মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের হাতে। এদের কেনাকাটাতে কোনো বাধা নেই। কারণ, এই অধিক আয়ের মানুষ তাদের ১০ শতাংশ ব্যয় কম করলেও সেটি মূল্যস্ফীতিতে খুব বড় প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু কম আয়ের ৯০ শতাংশ মানুষ যদি সামাজিকতা রক্ষার নামে একযোগে কেনাকাটায় যোগ দেয়, তাহলে সেটি হবে আগুনে ঘি ঢালার সমান, যা আগামীর মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে।’ তিনি মনে করেন, আমরা চাইলেই একটু সংযত হতে পারি। এতে নিজেরাও ভালো থাকব। অর্থনীতির জন্যও ভালো হবে। মূল্যস্ফীতির চাপও কিছুটা সহনীয় থাকবে। কিন্তু ভোক্তা হিসেবে যদি আমরা এর উল্টোটা করি অর্থাৎ যা আছে তার থেকেও বেশি কেনাকাটা করি—এতে অর্থনীতি সাময়িক চাঙ্গা হবে বটে; কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।’ এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘স্বল্প সংখ্যক মানুষের আয় বাড়লেও অধিকাংশ মানুষের আয় না বাড়ার কারণে দেশে যে বিরাট আয় বৈষম্য তৈরি হয়েছে, ঈদ উৎসব ঘিরে কেনাকাটায় সামাজিকতা রক্ষার যে টানাপোড়েন তারই বহিঃপ্রকাশ। এ কারণেই ঈদ সামনে রেখে প্রিয় সন্তানের হাতেও একটি সুন্দর পোশাক তুলে দিতে পারছে না অনেকে। এ অবস্থায় সরকারের উচিত হবে সব মানুষের আয়-রোজগার বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া। সেইসঙ্গে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে কার্যকর পদক্ষেপও নিতে হবে।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাধারণত প্রতিবছর ঈদে পোশাকে অতিরিক্ত মূল্য সংযোজন ঘটে ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ। তবে এবার সরেজমিন বাজার পরিস্থিতি বলছে, প্রতিটি ঈদ পোশাকের দাম সর্বনিম্ন ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত চড়েছে। অর্থাৎ এক হাজার টাকা দামের একটা পোশাক কিনতে আগের তুলনায় ক্রেতাকে এখন ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে। একইভাবে বেড়েছে খাদ্যসামগ্রীর দাম। গত দুই বছর ধরে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম বাড়তি। সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম ২০ থেকে ৪৫ শতাংশ এবং ক্ষেত্র ও পণ্যভেদে তার চেয়ে বেশি চড়েছে। তাতে জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। ভোগ্যপণ্যের পাশাপাশি তেল, সাবান, শ্যাম্পুর মতো নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দামও বেড়েছে। এ ছাড়া বাসাভাড়া, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যাতায়াতসহ প্রতিটি খাতেই জীবনযাত্রার খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে অনেকের খাদ্যাভ্যাসেও এসেছে পরিবর্তন। দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকা এসবের সামগ্রিক যোগফল বাজারে এখন দ্বিমুখী ঊর্ধ্বগতির মূল্যস্ফীতি তৈরি করেছে। দেশে বর্তমানে এই মূল্যস্ফীতির পারদ ৯ শতাংশের ওপরে ঘোরাফেরা করছে। এর অর্থ হচ্ছে, সামগ্রিকভাবে জীবনধারণ ব্যয় ৯ শতাংশ হারে বাড়ল। এর ফলে আয় নির্দিষ্ট থাকায় ক্রয়ক্ষমতা অনুরূপহারে কমে গেল, যা দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের আয়ে বড় রকমের চিড় ধরিয়েছে। দরিদ্রশ্রেণির মানুষের তো আরও ভয়াবহ দশা। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান জানান, মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনা জরুরি। অর্থাৎ উৎপাদন, চাহিদা, ঘাটতি, আমদানি কোন পর্যন্ত করতে হবে, কখন দরকার—এগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করে নীতি নির্ধারকরা কোথায় কখন কোন পণ্যের ঘাটতি হবে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। আবার বাজারে যে নজরদারি দরকার সেটা না থাকায় যেসব পণ্য উৎপাদক ও আমদানিকারক কম সেখানে দাম অনেক বেড়েছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এসব ক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থাপনার কার্যকরভাবে ভূমিকা রাখেনি বলেই দেশে মূল্যস্ফীতির আজকের পরিণতিতে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘খাদ্যনিরাপত্তা পরিসংখ্যান-২০২৩’-এর চূড়ান্ত জরিপ প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে মোট পরিবার বা খানার সংখ্যা ৪ কোটি ১০ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ২৬ শতাংশ পরিবার তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে ঋণ করতে বাধ্য হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ঈদবাজারে এখন তারই প্রভাব পড়েছে। উচ্চবিত্তরা এই ধাক্কা সামলাতেও পারলেও সমাজের সবচেয়ে বড় শ্রেণি মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের কাতারে যারা পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি—যাদের আয় অপরিবর্তিত, কিন্তু মূল্যস্ফীতির চাপে অনুরূপহারে ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে; তাদেরই এখন ঈদবাজার কেনাকাটায় এই ‘কুল রাখি না শ্যাম রাখি’ অবস্থা তৈরি হয়েছে। ঈদের পোশাকের দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দীন কালবেলাকে জানান, ‘যেহেতু এবার মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ এমনিতেই খারাপ অবস্থায় আছে, তার ওপর অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে এখনো বোনাস হয় নাই, তাই এবার ঈদ বিক্রির ভলিউম খুব বেশি বড় হবে না। তবে পোশাকের দাম নিয়ে কিছু বলা মুশকিল। কারণ কম দামেরও আছে আবার বেশি দামেরও আছে। যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী কেনাকাটা করবে। এখানে কোনো জোর নেই। কারণ ব্যবসায়ীরা তো কারও পকেট থেকে জোর করে পণ্য নিচ্ছে না। তারা পণ্য দিয়েই দাম নিচ্ছে।’ কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া বলেন, ‘বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার কিছু পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল। কিন্তু সেটি কার্যকর হয়নি। বাজারের এই অস্থিরতার জন্যে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দায়ী। এভাবে বিভিন্ন পণ্যে বাড়তি মূল্য দেওয়ার কারণেই মানুষের ব্যয় ধারণসীমার বাইরে চলে গেছে। এতে বিদ্যমান বাজার ব্যবস্থায় ভোক্তা তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই সিন্ডিকেট ভেঙে ভোক্তাদের স্বস্তি নিশ্চিত করতে সরকারকেই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।’ এদিকে বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় এখন বেচাকেনা খানিকটা বাড়লেও অন্যান্য বছরের ঈদের বাজার পরিস্থিতি যেমন জমজমাট থাকে এবার এখন পর্যন্ত তা দেখা যাচ্ছে না। যমুনা ফিউচার পার্ক, বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্সসহ রাজধানীর অন্যান্য শপিংমলে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ক্রেতার আনাগোনা কম। এর পরিবর্তে তুলনামূলক কম দামের নিউমার্কেট, মৌচাকসহ এই জাতীয় মার্কেটে ক্রেতার আনাগোনা বেড়েছে। কিন্তু এখানে এসেও পোশাকের দাম শুনে হতাশ ক্রেতারা। বাধ্য হয়ে অনেকে মার্কেট ছেড়ে নেমে আসছেন ফুটপাতে। যেখানে দরদাম করে সাধ্যের মধ্যে পরিবার ও স্বজনের মনোতুষ্টির জন্য চেষ্টা করছেন নতুন পোশাক কেনার। এতেও জমছে না বেচাকেনা। তার প্রমাণ মেলে মৌচাকের পাইকারি ব্যবসায়ী ইউনূছ আলীর কথায়। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘রোজায় আমাদের সবচেয়ে বেশি বিক্রির টার্গেট থাকে। কিন্তু গতবারের তুলনায় এবার ২৫-৩০ শতাংশ বিক্রি কমে গেছে।’ আর খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদের কেনাকাটা এখনো তেমন শুরু হয়নি। যারা আসছেন তারাও দেখে চলে যাচ্ছেন। তবে আগামী মাসের শুরুতে বেতন-বোনাস পাওয়ার পর কেনাকাটা বাড়বে—এমন প্রত্যাশা করেই বসে আছেন তারা। গুলিস্তানের ফুটপাত থেকে ছেলের জন্য পাঞ্জাবি পছন্দ করতে এসেছিলেন বাহাউদ্দিন নামের একজন ক্রেতা। তিনি বলেন, গতবছর আড়ং থেকে দুই ছেলেকে পাঞ্জাবি কিনে দিয়েছিলাম। কিন্তু এবার জিনিসপত্রের মাত্রাতিরিক্ত দামে হাতে খুব বেশি টাকা নেই; কিন্তু ঈদে নতুন পাঞ্জাবি না দিলেও মনটা খারাপ হয়ে যাবে। তাই এবার এখান থেকেই কিনে দিচ্ছি।
২৫ মার্চ, ২০২৪
X