বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টা, চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল এলাকার আকাশে উড়ছিল বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান ইয়াক-১৩০। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই সেই বিমানের পেছনে জ্বলে ওঠে আগুন। মুহূর্তেই বিধ্বস্ত হয়ে কর্ণফুলী নদীতে পড়ে যায় বিমানটি। বোট ক্লাবসহ আশপাশে শোনা যায় বিকট শব্দ। আতঙ্কে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। এ ঘটনার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে।
দুর্ঘটনা যেখানে ঘটে তার পার্শ্ববর্তী বোট ক্লাব থেকে ভিডিওটি করা হয়েছে বলে ধারণ করা হচ্ছে। ভিডিওটিতে দেখা গেছে, প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমানটি উড্ডয়নের পর মাঝ আকাশে কয়েকটা চক্কর দেয়। এর কিছুক্ষণ পরই আগুন ধরে যায় বিমানটির পেছনের অংশে। এরপর বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে খাড়াভাবে কর্ণফুলী নদীতে পড়ে যায়।
এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে বোট ক্লাবে উপস্থিত সবাই। কয়েকজনকে বলতে শোনা যায়, হায় হায়রে, বিমানটিতে আগুন ধরে গেছে। আগুন ধরে গেছে। এরই মধ্যে ভিডিওটিতে ধরা পড়ে ভিন্ন দৃশ্য, দুর্ঘটনার সামান্য আগে প্যারাশুট দিয়ে নিরপদে নেমে যান বিমানের পাইলট ও কো-পাইলট।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, বিমানবাহিনীর ইয়াক-১৩০ প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমানটি ‘যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে’ দুর্ঘটনায় পড়ে। দুর্ঘটনার পর ওই দুজনকে উদ্ধার করে জহুরুল হক ঘাঁটির মেডিকেলে নেওয়া হয়। সেখানে দুই ঘণ্টা পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান পাইলট স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদ। আহত অপর বৈমানিক উইং কমান্ডার সুহান চিকিৎসাধীন সেখানে।
বেঁচেও বাঁচল না আসিম জাওয়াদ বিমান বিধ্বস্তের আগে নিরাপদেই প্যারাশুট দিয়ে নেমে পড়েন পাইলট স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদ। কিন্তু সাহসী এই বীরকে বাঁচানো যায়নি। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন তাসলিম আহমেদ বলেন, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিমানবাহিনীর জহুরুল হক ঘাঁটি থেকে উড্ডয়নের পর বিমানটি দুর্ঘটনায় পড়ে। এ সময় বিমানটিতে আগুন ধরে যায়। বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার আগে পাইলট ও কো-পাইলট প্যারাশুট দিয়ে নেমে আসেন।
পতেঙ্গা থানার ওসি কবীরুল ইসলাম বলেন, প্রশিক্ষণ উড়োজাহাজে আগুন লাগার পর দুজন বৈমানিক প্যারাশুট দিয়ে নেমে আসেন। এ সময় কর্ণফুলী নদী থেকে তাদের উদ্ধার করে বিএনএস পতেঙ্গা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুপুর ১২টার দিকে স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদের মৃত্যু হয়।
জানা যায়, স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদ মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া থানার গোপালপুর গ্রামের ড. আমান উল্লাহ ও নীলুফা আক্তারের ছেলে। তিনি সাভার ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০০৭ সালে এসএসসি ও ২০০৯ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। পরে ২০১০ সালে বাংলাদেশ এয়ারফোর্স একাডেমিতে যোগদান করেন। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে পাইলট অফিসার হিসেবে কমিশন লাভ করেন।
আসিম জাওয়াদ নিজের ট্রেনিং জীবনে সব বিষয়ের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য পেয়েছেন গৌরবমণ্ডিত ‘সোর্ড অফ অনার’। সাভার ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এখন পর্যন্ত তিনিই একমাত্র ‘সোর্ড অফ অনার’ বিজয়ী। ফ্লাইং ইনস্ট্রাক্টরস কোর্সে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য পেয়েছেন ‘মফিজ ট্রফি’। এ ছাড়া তার দায়িত্বশীলতা ও কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার জন্য প্রশংসা পেয়েছেন চিফ অফ এয়ার স্টাফ থেকে।
তিনি PT-6 , L-39ZA , F-7MB, F-BG1 ইত্যাদি বিমান চালিয়েছেন। তিনি F-7MG1- এর অপারেশনাল পাইলট ও এলিমেন্ট লিডার ছিলেন। ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে জাতিসংঘের মিশনে তিনি নিয়োজিত ছিলেন। বিভিন্ন কোর্সের তাগিদে ভ্রমণ করেছেন চীন, ভারত, তুরস্ক ও পাকিস্তানে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিয়োজিত ছিলেন ফ্লাইং ইনস্ট্রাক্টর’স স্কুল অব বিএএফ-এ স্টাফ ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে। তার আত্মার মাগফিরাত কামনা ও স্বজনদের ধৈর্য ধারণ করার তওফিক দিন আল্লাহ তায়ালা।
বাংলাদেশে এর আগে ২০১৭ সালের ১১ জুলাই চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় এবং একই বছরের ২৭ ডিসেম্বর কক্সবাজারের মহেশখালীতে বিধ্বস্থ হয়েছিল বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান।
এলাকায় আতঙ্ক, উদ্ধারে কাজ চলমান সকালে সন্তান, স্বামীসহ বোট ক্লাবে ঘুরতে এসেছিল সাহানা আফরিন নামে এক নারী। তিনি কালবেলাকে বলেন, চোখের সামনে এত বড় দুর্ঘটনা দেখে আতকে উঠেছিলাম। কিছু বোঝার আগেই হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়ে তা পানিতে ডুবে যায়।
কাজী হুমায়ূন কবির বলেন, এই ঘটনা সারাজীন স্মৃতি হয়ে থাকবে। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি কখনোই হইনি।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) বন্দর জোনের উপ-কমিশনার শাকিলা সোলতানা কালবেলাকে বলেন, জহুরুল হক ঘাঁটি থেকে বিমানবাহিনীর ইয়াক-১৩০ ট্রেনিং ফাইটার বিমানটি পতেঙ্গা এলাকায় বোট ক্লাবের ওপর দিয়ে উড্ডয়নরত অবস্থায় হঠাৎ পেছনের দিকে আগুন দেখা যায়। এরপর বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে পানিতে পড়ে। সেটি খুঁজতে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর টাগবোটসহ ডুবুরি, ফায়ার ফাইটার, পুলিশ, বন্দরে অবস্থানরত জাহাজের নাবিকরা কাজ করছেন। নৌ-বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করছি বিধ্বস্ত বিমানটি উদ্ধার করতে।
এদিকে বিধ্বস্ত বিমানটি উদ্ধারে কর্ণফুলীতে অভিযান চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুকও। তিনি বলেন, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী বিধ্বস্ত বিমান উদ্ধারে অভিযান চালাচ্ছে। বন্দর কর্তৃপক্ষও প্রয়োজনীয় নৌযান প্রস্তুত রেখেছে, যাতে দ্রুত সহযোগিতা করা যায়। দুর্ঘটনার কারণে বন্দরে জাহাজ চলাচলে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
বিমান বিদ্ধস্তের ঘটনা এবারই নতুন নয় এর আগে ২০১৫ সালের জুনে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফ-৭ যুদ্ধবিমান বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ঘাঁটি জহুরুল হক থেকে উড্ডয়নের পর সাগরে বিধ্বস্ত হয়। নিখোঁজ পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তাহমিদের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
২০১১ সালের ১০ অক্টোবর বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয়। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মুনতাসিন বিমান থেকে বের হতে পারেন।
২০১০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পতেঙ্গা বোট ক্লাবের কাছে একটি বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান কর্ণফুলী নদীতে বিধ্বস্ত হয়। পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আহমেদ সানজিদ বেঁচে যান।
মন্তব্য করুন