গণপিটুনি ও চিড়িয়াখানার বাসিন্দারা
ইংরেজিতে বলে Lynching, আমরা বাংলায় বলি গণপিটুনি বা গণপিটুনিতে হত্যা। এক কথায় অপরাধী অথবা নিরপরাধী কাউকে আইনবহির্ভূতভাবে একদল মানুষের দ্বারা পিটিয়ে হত্যা হলো গণপিটুনি। এ গণপিটুনি শুধু একটি হত্যাকাণ্ডবিষয়ক শব্দই নয়—মানব সমাজের অন্ধকার দিক, মানুষের ঘৃণা, ক্রোধ ও অবিচারের অধ্যায়কে পরিচয় করিয়ে দেয়। তুরস্কের লেখক মেহমেত মুরাত ইলদান দুঃখ করে বলেছেন, ‘যে সমাজ গণপিটুনি দিয়ে একজন মানুষকে হত্যা করে, সেই সমাজের জন্য প্রয়োজন একটি বড় চিড়িয়াখানা এবং অবশ্যই তা পশুর জন্য নয়, ওই সমাজের মানুষগুলো বাস করবে সেই চিড়িয়াখানায়।’ এই ধরাধামে যত ধরনের হত্যাকাণ্ড আছে তার মধ্যে সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম হলো এ গণপিটুনি। এক বা একাধিক মানুষকে মাটিতে ফেলে হাতের ভারী লাঠি, রড, বাঁশ দিয়ে একদল মানুষ পেটাতে পেটাতে মৃত্যু নিশ্চিত করে। যখন গায়ে সজোরে বাড়িগুলো পড়ে, তখন ভিকটিমের শরীরের অভ্যন্তরের বিভিন্ন অঙ্গ চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে থাকে। কোনো একটি বাড়ি গিয়ে পড়ে চোখে, কোনো বাড়ি গিয়ে পড়ে মুখে, কোনোটা বুক, তলপেট বা হাঁটুতে। একজন বা একাধিক ব্যক্তিকে যখন একদল ক্ষিপ্ত মানুষ নির্বিচারে পেটাচ্ছে, তখন ভিকটিমের পুরোপুরি জ্ঞান থাকে এবং প্রতিটি আঘাতের ব্যথা তাকে অনুভব করতে হয়। তার চেয়েও মর্মান্তিক বিষয় হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গণপিটুনির শিকার মানুষটি দেখা যায় হয় নিরীহ-নির্দোষ অথবা যে দোষে সে অভিযুক্ত, তা হয়তো আইনের দৃষ্টিতে বড়জোর তিন মাসের কারাভোগের উপযুক্ত। কিন্তু একদল মানুষ বিবেক, আইন, মমতা সবকিছু ত্যাগ করে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে বিষধর সাপ হত্যার মতো বেধড়ক পিটিয়ে মানব সন্তানকে মেরে ফেলে। অধিকন্তু মৃত্যুমুখে পতিত মানুষটি জেনে যায়, তাকে একটি সমাজ নিষ্ঠুরভাবে মেরে ফেলল! তাই মেহমেত মুরাত ইলদানের কথাটাই বারবার মনে হয়।
গণপিটুনির ইতিহাসে সর্বাধিকসংখ্যক নিহতের ঘটনার পেছনে রয়েছে জাত, ধর্ম অথবা বর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দি অ্যাডভান্সমেন্ট অব কালার্ড পিপল বা এনএএসিপির হিসাব অনুযায়ী, ১৮৮২ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে গণপিটুনিতে হত্যার রেকর্ড হয়েছে ৪ হাজার ৭৭৩টি। এর মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি কৃষ্ণাঙ্গ, ১০ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ গণপিটুনিতে নিহতের শিকার হয়েছে এ ধরনের মৃত্যুতে বাধা প্রদানের জন্য। বাকিরা মেক্সিকো অথবা ইউরোপ থেকে আসা ভিন্ন জাতি হওয়ার কারণে। আবার দেখতে সবাই শ্বেতাঙ্গ হলেও সবাইকে শ্বেতাঙ্গ মনে করা হতো না। যেমন আমেরিকার গৃহযুদ্ধের আগে-পরে ইতালিয়ানদের শ্বেতাঙ্গ মনে করা হতো না। আমেরিকার ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর ওই সময়কে বলা হতো লিঞ্চিং এরা বা গণপিটুনির যুগ। ইউরোপেও একসময় গণপিটুনি দিয়ে মানুষ হত্যার রেওয়াজ ছিল। বিশেষ করে মধ্যযুগে ডাইনি আখ্যায়িত করে যে কোনো বাড়ির যে কোনো মেয়েকে একজন মানুষ যদি বলত সে ডাইনি, তাহলেই হয়ে গেল। বিশেষ করে চার্চের কেউ বললে তো কথাই নেই। অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ করতে না পেরে, অথবা ধর্ষণের পর দায় লুকানোর জন্য ‘ডাইনি’ বলে অভিযুক্ত করা হয়েছে। সেই সময় পূর্ব ইউরোপে ইহুদিদের কথায় কথায় হত্যা করা হতো গণপিটুনিতে। এজন্য সংগঠিত দল ছিল এ হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্য। ইউরোপে জাতিগত সংঘাত ছিল তীব্র এবং অনেক জাতি কাছাকাছি বসবাস করত। ফলে প্রতিশোধপরায়ণ এক জাতির মধ্যে আরেক জাতির কোনো ব্যক্তির সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটলে পিটিয়ে হত্যার কালচার ছিল।
ইউরোপ আমেরিকায় এসব এখন ইতিহাস। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন সভ্য হয়ে উঠতে থাকে, অর্থনীতি বিকশিত হয়, সমাজ আলোকিত হতে থাকে, চার্চের প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে—তখন সমাজ নতুন করে গড়ে ওঠে। গণপিটুনির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন হয়, তহবিল সংগ্রহ করা হয়। তারপরও যে কদাচিৎ দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেনি, তা নয়। আমেরিকায় আশির দশকের শুরুতেই এমন একটি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। তবে এখন, বিশেষ করে শেষ পাঁচ-ছয় দশকে ইউরোপ-আমেরিকায় কেউ ভাবতেই পারে না যে একজন মানুষ যত বড় অন্যায়কারীই হোক, তাকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা যায়! এ সংস্কৃতি তাদের কাছে অপরিচিত হয়ে গেছে।
অতি দুঃখের বিষয়, একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করে আমরা এক-পঞ্চমাংশ সময় পার করে দিয়েছি। আজও গণপিটুনি আমাদের কালচারের অংশ হয়ে আছে। এখানে আইন কাজ করেনি, মানবতা কাজ করেনি, শিক্ষা কাজ করেনি। এ গণপিটুনির প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশ ও পাকিস্তানেই সর্বাধিক লক্ষ করা যায়। ভারতেও এ প্রবণতা আছে। তবে সেখানে গণপিটুনি বিষয়ে আইন সংশোধন করা হচ্ছে বারবার। ভারতে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ ২০১৯ সালে মন্তব্য করেছেন, ‘জনগণের বিচারকে কখনোই আইনসিদ্ধ করা যায় না। শক্ত হাতেই এ প্রবণতা রক্ষা করতে হবে।’ ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এ বছর জুলাই মাসে লোকসভার একটি বিলের আলোকে রাজ্য সরকারগুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন, গণপিটুনিতে অভিযুক্তকে প্রমাণসাপেক্ষ কমপক্ষে সাত বছরের কারাদণ্ড প্রদান করতে। অনেকে আইনের শাসনের অভাবকেই মূলত দায়ী করে থাকেন। তা আংশিক সত্য। তবে মানবতাবোধ ও কমনসেন্স না থাকলে আইন দিয়ে সবকিছু হয় না। মনে আছে, ২০১১ সালে শবেকদরের রাতে ঢাকার ছয় শিক্ষার্থী তরুণ-তারুণ্যের খেয়ালে ভোররাতে আমিনবাজার এলাকায় গেলে তাদের ডাকাত সন্দেহে মাইকে ঘোষণা দিয়ে সারা গ্রামের মানুষ এসে পিটিয়ে হত্যা করে। আমি বহুকাল ভেবে পাইনি, নিরস্ত্র ছেলেগুলোকে দেখে এলাকার কোনো মানুষের একবার মনে হলো না যে, পেটানো বন্ধ করে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখি! সেই ছেলেরা চিৎকার করে বলছিল, আমরা ছাত্র আমরা ডাকাত না! কেউ শোনেনি! এই তো ২০১৯ সালের ২০ জুলাই বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আসেন তাসলিমা আক্তার রেনু নামে দুই সন্তানের মা, তার সন্তানদের ভর্তির ব্যাপারে খোঁজ নিতে। তখন পদ্মা সেতুতে ‘শিশুর মাথা লাগবে’ বলে এক আজগুবি প্রচার চলছিল দেশে। সন্দেহের বশবর্তী হয়ে প্রধান শিক্ষকের কক্ষ থেকে বের করে নিয়ে পিটিয়ে এই মাকে হত্যা করে কয়েকশ মানুষ জড়ো হয়ে। ৪০০ থেকে ৫০০ লোকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গণপিটুনিতে দেশে ৮০০ মানুষ নিহত হয়েছে! প্রাসঙ্গিক একটি কথা না বললেই নয়। একসময়, বিশেষ করে প্রাচীন ও মধ্যযুগে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করতে মানুষের রক্ত ব্যবহার করার কুসংস্কার ছিল, যাকে ব্লাড স্যাক্রিফাইস বলা হয়। বিভিন্ন জনপদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও কুসংস্কার থেকে এর উৎপত্তি হয়েছিল। মায়া, অ্যাজটেক থেকে শুরু করে আফ্রিকা এশিয়া সর্বত্র দেখা গেছে। সেই প্রাচীন বিশ্বাস আজ কোনো জনপদে নেই। পদ্মা সেতুতে ব্লাড স্যাক্রিফাইসের গল্প যখন তৈরি হয় তখন দেখেছি, অসংখ্য মানুষ তা বিশ্বাসে নিয়েছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পাস অথবা পড়ুয়া মানুষকেও বিশ্বাস করতে দেখেছি। তাই এ সমাজ থেকে অন্ধকার কতটা কেটেছে, তা নিয়ে আমরা বিশেষভাবে সন্দিহান। আজও পত্রপত্রিকা খুললে আমরা বহু ধরনের গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা দেখতে পাই। প্রায়ই কাউকে না কাউকে চোর সন্দেহে, ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে হত্যার শিকার হতে দেখা যায়। যে সমাজে ব্যক্তিভাবনার চেয়ে কালেকটিভ ভাবনা বেশি প্রাধান্য পায়, সেই সমাজে মব সাইকোলজি প্রাধান্য পায়। ব্যক্তিভাবনা তৈরি হতে শিক্ষা ও কমনসেন্সের প্রয়োজন হয়। মানুষ ভাবে, অন্য দশজন যখন একটি লোককে পিটিয়ে মারছে, তাহলে এটাই সঠিক। সেই ভাবনা থেকে সেও যোগ দেয়। দ্বিতীয়ত, গণপিটুনিতে হত্যার বিচার এসব দেশে খুব একটা জোরের সঙ্গে আমলে নেওয়া হয় না। খুব কমই বিচার হতে দেখা যায়। এটিও উৎসাহিত করে। সর্বশেষ ২৮ অক্টোবর একজন পুলিশকে যে নিষ্ঠুরভাবে গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা সারা দেশ টেলিভিশনের পর্দায় দেখল, সেটা অন্ধকার চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ। কে বা কোন দল করেছে সেটা আমাদের প্রশ্ন নয়, করেছে হোমোজেনিয়াস জাতির একটি অংশ। এরা ভুলে গিয়েছিল পুলিশের দায়িত্ব পালনের কথা। পুলিশ সদস্যও এ দেশেরই একজন মানুষ। এমনও তো হতে পারত যে, ওই পুলিশ সদস্যকে যারা মেরেছে, মনে মনে সে তাদেরই একজন সমর্থক? সে শুধু তার প্রতি নির্দেশ পালনে ব্যস্ত ছিল। পুলিশকে তো তার ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশ পালন করতে হয়। অথচ পিটিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হলো। কেউ সে কথা ভাবল না। আজও আমাদের এমন দৃশ্য দেখতে হয়! তাই এ সমাজ কতটা এগিয়েছে, কতটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য প্রস্তুত হয়েছে, কতটা মানবিক উন্নয়ন ঘটেছে এই জনপদের—সে প্রশ্ন মোটেই অবান্তর নয়।
লেখক : সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক
৩১ অক্টোবর, ২০২৩