অর্থ নিয়ে দুই গাড়ি চালককে প্রশ্নপত্র দেন ডিজিএম
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের তৎকালীন উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মেজর তাইজ ইবনে আনোয়ার গোপনে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ছবি নিজের মোবাইলে তুলে নেন। পরে ফাঁস করা এ প্রশ্নপত্র প্রিন্ট করে অর্থের বিনিময়ে দুই গাড়িচালককে দেন। তারা আবার অন্য আসামিদের কাছে প্রশ্নপত্র বিক্রি করেন। রাজধানীর বিমানবন্দর থানায় নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় করা মামলার অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদনে এমন তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. ফজলুর রহমান কালবেলাকে বলেন, মামলাটিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপরাধের কোনো উপাদান ছিল না। আমরা সব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে পেনাল কোডের কয়েকটি ধারায় ৩০ আসামিকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দিয়েছি। আসামিরা ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র প্রিন্ট করে অন্যদের কাছে বিক্রি করেছে।
২০২২ সালের ২৬ অক্টোবর প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়। তদন্ত শেষে গত বছরের ২২ জুন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের পরিদর্শক আলমগীর হোসেন পাটোয়ারী আদালতে চার্জশিট জমা দেন। পরে গত বছরের ৭ আগস্ট ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এএম জুলফিকার হায়াত এ মামলার চার্জশিট আমলে গ্রহণ না করে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্ত শেষে গত ২২ এপ্রিল
গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. ফজলুর রহমান বিমানের তৎকালীন ডিজিএম মেজর তাইজ ইবনে আনোয়ারসহ ৩০ জনকে অভিযুক্ত করে অধিকতর চার্জশিট দাখিল করেন। তবে মামলার ঘটনা ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় না পড়ায় পেনাল কোডের ৪২০/৪০৩/৪০৬/৪১১/১০৯ ধারায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে।
চার্জশিটভুক্ত অন্য আসামিরা হলেন—বিমানের শিডিউলিং সুপারভাইজার মাহবুব আলম শরীফ, সিকিউরিটি গার্ড আইউব উদ্দিন, এমটি অপারেটর মহসিন আলী, মিজানুর রহমান, ফারুক হোসেন, নজরুল ইসলাম, ফিরোজ আলম, জাহাঙ্গীর আলম, মো. মাসুদ, মো. মাহবুব আলী, এনামুল হক, মাহফুজুল আলম, ট্রাফিক হেলপার আল আমিন, আ. মালেক, আলমগীর হোসেন, গাড়িচালক আব্দুল্লাহ শেখ, সাজ্জাদুল ইসলাম, এমএলএসএস তাপস কুমার মণ্ডল, জাহিদ হাসান, হারুন অর রশিদ, সমাজু ওরফে সোবাহান, জাকির হোসেন, বিএফসিসি অপারেটর সুলতান হোসেন, মুরাদ শেখ ওরফে মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ বেতারের গাড়িচালক ফারুক হোসেন, জুয়েল মিয়া, রাজিব মোল্লা, অফিস সহায়ক আওলাদ হোসেন ও হেলপার জাবেদ হোসেন।
অধিকতর চার্জশিটে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের ১৯ অক্টোবর আনোয়ারসহ নিয়োগের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটির চার সদস্য বিমানের জিএসই পদসহ অন্য পদের লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরির কাজ শুরু করেন। ওইদিন বিমানের বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ট্রেনিং সেন্টারের প্রিন্সিপাল নাজমুল হুদা ও ইঞ্জিনিয়ার কায়সার জামান নিজেদের অংশের প্রশ্নপত্র পেনড্রাইভে নিয়ে আসেন। তার কিছু সময় পরে আনোয়ার জিএমের (অ্যাডমিন) রুমে আসেন। তারা প্রশ্নপত্র সেট করার পর মেজর তাইজ ইবনে আনোয়ারকে এর ভুলত্রুটি সংশোধনের জন্য দেখতে বলেন। তখন আনোয়ার বলেন, ল্যাপটপের স্ক্রিনে দেখতে সমস্যা হচ্ছে বলে প্রিন্ট কপি চান। তাকে প্রিন্ট কপি দেওয়া হলে তিনি ২০-২৫ মিনিট ধরে সোফায় বসে চেকব্যাক করেন। প্রশ্নপত্র চেকব্যাকের সময় মেজর আনোয়ার গোপনে মোবাইল ফোনে প্রশ্নটির ছবি তুলে নেন। পরে তিনি প্রশ্নের প্রিন্টকপি আসামি গাড়িচালক মাসুদ ও জাহাঙ্গীর আলমকে অর্থের বিনিময়ে সরবরাহ করেন। আসামি জাহাঙ্গীর ও মাসুদ অর্থের বিনিময়ে অন্য আসামিদের কাছে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগপত্রের প্রশ্নপত্র বিক্রি করেন। মেজর আনোয়ার যে প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন, সেটির কপি জাহাঙ্গীর আলম, হারুন অর রশিদ, মাহফুজুল আলম ও আওলাদ হোসেনের কাছে থেকে উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া প্রশ্নটির ছবি আসামি জাহাঙ্গীর, মাসুদ, হারুন, এনামুল, মাহফুজুল, জাহিদ, জাবেদেরও মোবাইল ফোনে পাওয়া যায়। এ ছাড়া ২০২২ সালের ২০ অক্টোবর সকালে বিমানের প্রধান কার্যালয়ে জুনিয়র অপারেটর (জিএসই) ক্যাজুয়াল পদের প্রশ্নপত্র ফটোকপির সময় এর ছবি তুলে নেন এমএলএসএস জাহিদ হাসান। পরে তা আওয়াদ ও সমাজুকে সরবরাহ করেন।
অধিকতর চার্জশিটে আরও উল্লেখ করা হয়, আসামি জাহাঙ্গীর, আওলাদ ও মাসুদ তাদের জবানবন্দিতে সুনির্দিষ্টভাবে ঘটনা সংক্রান্তে আসামি তাইজ ইবনে আনোয়ারের সম্পৃক্ততা উল্লেখ করেছেন। দুই গাড়িচালক জাহাঙ্গীর ও মাসুদের সঙ্গে আনোয়ারের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ক্রয়/বিক্রয় সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগের তথ্য রয়েছে। আসামি জাহাঙ্গীরের কাছে থেকে তিনটি ডায়েরি উদ্ধার করা হয়। যেখানে বিমানের নিয়োগ পরীক্ষায় চাকরি দেওয়ার নামে যে টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে তার তথ্য রয়েছে। এ ছাড়া আসামি জাহাঙ্গীর, মাসুদ ও আনোয়ার নিজেদের মধ্যে এসব টাকা বণ্টন করে নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
১০ মে, ২০২৪