বিশ্ববাণিজ্যে দেশের প্রধান গেটওয়ে চট্টগ্রাম বন্দর
বন্দর বিশ্ববাণিজ্যে বাংলাদেশের প্রধান গেটওয়ে হিসেবে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিশন ২০২১ ও ২০৪১ অর্জনসহ এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে চট্টগ্রাম বন্দর বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে বদ্ধপরিকর। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায়, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় বন্দরে সার্বিক সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করা হচ্ছে। এতে চট্টগ্রাম বন্দর দেশের সমুদ্রপথে বহির্বাণিজ্য সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলেও জানান বন্দর চেয়ারম্যান। গতকাল মঙ্গলবার বন্দর ভবনে আয়োজিত পরিচিতি সভায় বন্দরের চলমান কাজসহ নানা বিষয় তুলে ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেন নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল।
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়ে এই প্রথম গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ প্রবাহ। চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে দেশের মোট বাণিজ্যের ৯২ শতাংশ এবং কনটেইনারজাত পণ্যের ৯৮ শতাংশ পরিবাহিত হয়ে থাকে। দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের সিংহভাগই সামাল দিচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। ১৮৮৭ সালে পোর্ট কমিশনার, ১৯৬০ সালে পোর্ট ট্রাস্ট আর স্বাধীনতার পর ১৯৭৬ সালে এই বন্দর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নামে যাত্রা করে এখন বিশ্ববাণিজ্যে বাংলাদেশের প্রধান গেটওয়ে হিসেবে কাজ করছে। বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় ৯২ শতাংশ পণ্য পরিবাহিত হয় এই বন্দর দিয়ে। দেশের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য চাহিদা, আঞ্চলিক যোগাযোগের ভৌগোলিক অবস্থানগত গুরুত্ব এবং বন্দরকেন্দ্রিক উন্নয়ন চিন্তা চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব বাড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত। সরকারও চট্টগ্রাম বন্দরের ধারাবাহিক উন্নয়নে তৎপর।
নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল বলেন, বন্দরে ১০ মিটার ড্রাফট ও ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যের জাহাজ ভেড়ানো, ইউরোপের সঙ্গে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর উন্নয়ন প্রকল্প, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ, বহির্নোঙরের আওতা বৃদ্ধি, ভিটিএমআইএস, ডিজিটালাইজেশন, কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের অত্যাধুনিক কি সাইড গ্যান্ট্রি ক্রেন সংযোজনের মতো উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়েছে গত এক যুগে। আমাদের লক্ষ্য এখন আঞ্চলিক পণ্য পরিবহনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়া। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর বিশ্ববাণিজ্যে বাংলাদেশের প্রধান গেটওয়ে হিসেবে কাজ করছে। দেশের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য চাহিদা, আঞ্চলিক যোগাযোগের ভৌগোলিক অবস্থানগত গুরুত্ব এবং বন্দর কেন্দ্রিক উন্নয়ন চিন্তা চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব বাড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত। সরকারও চট্টগ্রাম বন্দরের ধারাবাহিক উন্নয়নে তৎপর।
বন্দর চেয়ারম্যান আরও বলেন, কভিড অতিমারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতির প্রত্যাশিত গতিকে মন্থর করলেও চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে তেমন প্রভাব ফেলেনি; বরং কার্গো হ্যান্ডলিং এবং আয় বেড়েছে। জুন মাসে এ বন্দর দিয়ে ৫০ শতাংশ রপ্তানি বেড়েছে, যার ৮৪ শতাংশ তৈরি পোশাক। বন্দরের কাজ সেবা দেওয়া। চট্টগ্রাম বন্দরে দিন নেই, রাত নেই, শুক্রবার ছুটির দিনও কাজ করে। ২৪ ঘণ্টা সাত দিন সচল থাকে। আমাদের বন্দর সারা বিশ্বে সমাদৃত। বিভিন্ন দেশে ব্যাপক বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করছে। আগামী তিন বছরে ৫-৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হবে বলে আশা করি। একই সঙ্গে নতুন প্রযুক্তি নিয়ে আসবে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো।
নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান আরও বলেন, জাহাজ আসার এক থেকে দুই দিনের মধ্যে জেটিতে ভিড়ছে, ক্ষেত্রবিশেষে অন-অ্যারাইভাল বার্থিং প্রদান করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরে ২০২২-২৩ অর্থবছরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ৩০ লাখ ৭ হাজার ৩৪৪ টিইইউএস। জেনারেল কার্গো ওঠানামা হয়েছে ১১ কোটি ৮২ লাখ ৯৬ হাজার ৭৪৩ টন। জাহাজ হ্যান্ডলিং হয়েছে ৪২৫৩টি। ক্রমবর্ধমান হ্যান্ডলিং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়ন শুরু করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দরের কার্যক্রমের সঙ্গে সহায়ক অন্যান্য সংস্থা বা এজেন্সি যেমন শুল্ক বিভাগ, ব্যাংক, শিপিং এজেন্টরা আন্তঃসমন্বয়ের মাধ্যমে ২৪১৫৭ কার্যক্রম সম্পাদন করছে। তা ছাড়া, চট্টগ্রাম কাস্টমসের রাজস্ব আদায়ে গত বছরের তুলনায় প্রায় ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পেছনে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের নিরবচ্ছিন্ন কর্মতৎপরতা ও দক্ষতা।
বন্দরসহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়নের কথা জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, সরকারের নানামুখী উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য আমদানিকৃত পণ্য দ্রুততর খালাস ও রপ্তানিযোগ্য পণ্য দ্রুত জাহাজীকরণে ভবিষ্যৎ চাহিদাকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ স্বল্প এবং মধ্যমেয়াদি কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং সুবিধাদি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নতুন নতুন টার্মিনাল নির্মাণ করছে। এরই মধ্যে ৫৮৪ মিটার দীর্ঘ জেটিসহ পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। বর্তমান ও ভবিষ্যতে কনটেইনার, কার্গো ও জাহাজ হ্যান্ডলিং নিরবচ্ছিন্ন রাখার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন হেভি লিফট জেটি, বে-টার্মিনাল এবং কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলায় ‘মাতারবাড়ী পোর্ট ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক প্রকল্পগুলোর কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে।
এ ছাড়া সক্ষমতা বৃদ্ধির পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০২২ সালে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শেষ করেছে বন্দর। ১ হাজার ২২৯ কোটি টাকা নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত টার্মিনালে তিনটি কনটেইনার জেটি ও একটি তেল খালাসের বিশেষায়িত জেটি রয়েছে। বছরে প্রায় সাড়ে চার লাখ টিইইউস কনটেইনার পরিবহন সক্ষমতা রয়েছে এই টার্মিনালের। তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালে ১৬০ মিটার দৈর্ঘ্য আর সাড়ে ৭ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানো যেত। বর্তমানে সার্ভে রিপোর্টের ভিত্তিতে চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে ১০ শিটার ড্রাফট ও ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যের জাহাজ ভেড়ানোর মধ্য দিয়ে নতুন এক মাইলফলক অর্জন করে বন্দর। অপেক্ষাকৃত বড় ও বেশি ধারণক্ষমতার জাহাজ আসার সুযোগ উন্মোচিত হওয়ায় পরিবহন ব্যয় সাশ্রয়ের পথ তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, ডিজিটালাইজেশনে একটি অধিকতর দক্ষ ও ডিজিটালাইজড বন্দরে রূপান্তরের লক্ষ্যে ৫০টি মডিউল তৈরি করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ সেন্ট্রাল ডাটাবেস, ওয়েব পোর্টাল ও আইটি অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে একটি পেপারলেস বন্দরের পথে হাঁটছে বন্দর।
ডিরেক্ট শিপিং-এর কথা বলে তিনি জানান, দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮১ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে। এসব পোশাকের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলো। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পোশাকবাহী জাহাজ সরাসরি এসব দেশে যেতে পারার সুযোগ না থাকায় ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর, যেমন—সিঙ্গাপুর বন্দর, কলম্বো বন্দর ও পোর্ট ক্যালাং হয়ে যেত। ফলে সময় ও খরচ দুটোই বেশি লাগত চট্টগ্রাম বন্দর এ অসুবিধা দূর করতে শিপিং এজেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরাসরি জাহাজ চলাচল চালুর তাগিদ দেয়। এর আগে ২০২২ সালের ৭ এপ্রিল এমভি সোঙ্গা চিতা জাহাজ ৯৫২ টিইইউ পোশাকবাহী কনটেইনার নিয়ে ইতালির রেভেনা বন্দরের উদ্দেশে যাত্রা শুরুর মাধ্যমে এ মাইলফলক অর্জন করে চট্টগ্রাম বন্দর। এরই ধারাবাহিকতায় আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে।
অত্যাধুনিক ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের কথা জানিয়ে বন্দর চেয়ারম্যান আরও বলেন, জাহাজ আগমনের সংখ্যা, লাইটার ভেসেলের কার্যক্রম বৃদ্ধি, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর বাস্তবায়নকে সামনে রেখে বহির্নোঙরের আওতা ৬২ নটিক্যাল মাইলে উন্নীত করা হয়েছে। সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রয়েছে অত্যাধুনিক ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (ভিটিএমআইএস)। বর্ধিত এলাকাকে ডিজিটাল টাইডাল নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে লজিস্টিকস সক্ষমতাও বাড়ানো হয়েছে।
নিরাপদ বন্দরের প্রশ্নে চেয়ারম্যান বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর একটি আইএসপিএস কমপ্লায়েন্ট বন্দর। চট্টগ্রাম বন্দরের সংরক্ষিত ও সংলগ্ন এলাকার প্রায় ৯৮ শতাংশ এখন সিসিটিভি মনিংটরিয়ের আওতায়। অত্যাধুনিক সিসিটিভি কন্ট্রোল সেন্টার থেকে সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হচ্ছে। বন্দরের প্রবেশের প্রতিটি প্রবেশ পথে আজাক্সেস কন্ট্রোল রয়েছে। অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে বন্দরের নিজস্ব ফায়ার ইউনিটে রয়েছে ফায়ার ফাইটিং ফোম টেন্ডার, রেসকিউ ভেহিকেল, রিকভারি ভেহিক্যাল। করোনার ধাক্কা এবং ইউক্রেন যুদ্ধ সামলে ২০২৩ সালে এ তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দর ৬৭তম স্থানে অবস্থান করছে।
আগামী ডিসেম্বরে বন্দরের নতুন কেমিক্যাল শেড চালু করা সম্ভব হবে জানিয়ে নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল বলেন, পিসিটি পরীক্ষামূলক চলছে। বে-টার্মিনাল ও ব্রেক ওয়াটারের ডিজাইনের কাজ চলছে। প্রশস্ত চ্যানেলে ১২-১৩ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ২৪ ঘণ্টা অপারেশন করা সম্ভব হবে। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রথম জেটি নির্মাণের কাজ শুরু হবে। ১০-১২ হাজার কনটেইনার নিয়ে জাহাজ ভিড়তে পারবে। বড় জাহাজে পণ্য আনা হলে ভোক্তা পর্যায়ে সুবিধা পাবে বলে জানান তিনি। পরিচিতি সভায় উপস্থিত ছিলেন বন্দরের সদস্য মো. শহীদুল আলম, পরিচালক মো. মমিনুর রশিদ, সচিব মো. ওমর ফারুক প্রমুখ।
২৩ আগস্ট, ২০২৩