বিবিতে হ্যাকার সিদ্ধ, পুঁজিবাজারে জুয়াড়ি
সাংবাদিক প্রবেশ নিষিদ্ধ করে কী ফল পেলে বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসি, ডিএসই? সাংবাদিক রোখার বুদ্ধিটির আয়োজক এ তিন সংস্থার ভেতরের সব নয়ছয় কি শেষতক আড়াল থাকল? ভারতীয় গণমাধ্যম খবর দিয়েছে নতুন করে বিশাল অঙ্কের টাকা হ্যাকিংয়ের খবর। বাংলাদেশ ব্যাংক এ সংবাদের প্রতিবাদ করেছে বিবৃতির মাধ্যমে। বলছে, খবরটি ভুয়া। নিউইয়র্ক ফেডের সঙ্গে লেনদেনে নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে বর্তমানে তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা নীতি চালু রয়েছে উল্লেখ করার মাঝেই বাংলাদেশ ব্যাংকে ছুটে যান ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন তিনি। পিটার হাসের সেখানে ছুটে যাওয়া, গভর্নরের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকের খবরও চাপা থাকেনি।
ঘটনার পরম্পরায় অনেকটা ২০১৬ সালের পুনরাবৃত্তি। সেই খবরও লুকিয়ে রাখা যায়নি। তাও এসেছিল বাইরের দেশ ফিলিপাইনের মিডিয়া থেকে। তখনো জোর প্রতিবাদ করে বলা হয়েছিল, এটি আস্ত ভুয়া-ফেক খবর। দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। এসব বলার কয়েক দিন পর স্বীকার করা হয়। তখনকার গভর্নর ড. আতিয়ার রহমান পদত্যাগও করেন। এবার এমন এক সময়ে এ খবর এসেছে যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নিট রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। ডলারের দাম বাড়ানোয় নতুন করে অস্থিরতা তো আছেই। সেইসঙ্গে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে হাহাকার। অবস্থা সত্যিই এমন হাহাকারময় হয়ে থাকলে গোটা দুনিয়া এখন বাংলাদেশকে পেতে চায় কেন? অভাবী-দুর্দশাগ্রস্ত গেরস্তের উঠানে তো বিড়াল-কুকুরও ঘোরে না। বাংলাদেশের অবস্থা ভিন্ন।
প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র ভারত থেকে আটলান্টিকের ওপারের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তানও আমাদের আয়-উন্নতিতে আফসোস করে। প্রশংসাও করে। রাত পোহালেই এখানে আয় বাড়ে। অজান্তেই বড়লোক হয়ে যায়। পাকিস্তানের এতে গা জ্বলবেই। স্মার্ট থেকে এখন ওভার স্মার্ট অতিক্রম দেখে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফও বন্ধুত্ব পাতছে। দ্বিতীয় ঋণের কিস্তি দ্বিগুণ করেছে। রিজার্ভ রাখার মাত্রা কমিয়ে দিয়েছে। আর কী-কত দেবে? প্রতিদানে আমরাও আইএমএফের কথা রাখছি। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করেছি। ডলারের দাম বাড়িয়েছি। ঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক করে দিয়েছি। এখন ব্যাংকগুলো যে কোনো হারে শিল্প-ব্যবসার ওপরে সুদ চার্জ করতে পারবে। দেওয়া-নেওয়ার এ সওদাগরিতে পুঁজিবাদ জিন্দাবাদ, ব্যবসায়ী লাভবান, যায়-যাক গরিবের যায় প্রাণ। এ দৃষ্টে সরকারের আহ্বান—‘সবাই মিলে সঞ্চয় করি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলি।’ আর কী চাই?
এরপরও ব্যাংকগুলো কেন ল্যাটকা কান্দাকাটি করে? কেন সেখানে নাই-নাই হাহাকার? দেশের অবস্থা কি এত খারাপ। কারও অজানা নয় যে, আমানত প্রবাহ কমলে ব্যাংকের চালিকাশক্তি কমে যায়। ব্যাংকের সবচেয়ে স্থিতিশীল আমানত হলো সঞ্চয়ী আমানত। আর সবচেয়ে অবহেলিত সঞ্চয়ী আমানত এবং তাদের মালিকরা। ব্যাংকগুলো সঞ্চয়ী আমানত দিয়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করলেও সবচেয়ে কম মুনাফা দেয় সঞ্চয়ী হিসাবে। এমনিতেই সঞ্চয়ী হিসাবে সাধারণত মুনাফার হার ৩-৪-এর বেশি নয়। তার ওপর কত যে অজুহাত। মাসের ৮ তারিখের পর যত জমাই হোক, তা হিসাবে আনে না। কিন্তু টাকা ওঠানোর বেলায় মাসের শেষ দিন পর্যন্ত হিসাবে আনে। আবার মোট আমানতের ২৫ শতাংশের বেশি তুললে সে মাসে মুনাফা দেবে না ব্যাংক, সপ্তাহে দুবারের বেশি টাকা তুললে মুনাফা দেবে না। হিসাবে থাকা অর্থ ঠিকই কাজে লাগাবে। এরপর আছে এসএমএস চার্জ, চেক বইয়ের দাম আদায়, হিসাব মেইনটেনেন্স চার্জ, স্টেটমেন্টের জন্য চার্জ, আবগারি শুল্ক আদায়সহ বিভিন্ন প্রকার ঘোষিত-অঘোষিত চার্জ। সাধারণ সঞ্চয়ী হিসাবধারীদের কজনে তা জানে?
চারদিকে জনে জনে মানুষ স্মার্ট থেকে ওভার স্মার্ট হচ্ছে। কিছু লোক এখনো আনস্মার্ট-লেবেনডিস হয়ে থাকলেও ব্যাংকগুলো ওভার স্মার্ট। একসময় সঞ্চয়ী হিসাবের চেকের কোনো মূল্য আদায় করা হতো না। স্টেটমেন্টের জন্য কোনো চার্জ আদায় করা হতো না । এখন প্রতি পাতার জন্য প্রায় বারো টাকা আদায় করা হয়। জানে কজনে? মেসেজ দেওয়া নিয়েও কিছু কায়কারবার আছে। মেসেজ দেওয়া ব্যাংকের দায়িত্ব। কিন্তু এর জন্যও বছরে দুবার দুইশ টাকার বেশি আদায় করা হচ্ছে। বছরে দুবার অ্যাকাউন্ট মেইনটেনেন্স চার্জও আছে। সামান্য মুনাফার ওপর ১০-১৫ হারে উৎসে কর। আছে আবগারি শুল্কও। ভাবা যায় কত স্মার্ট ব্যাংকগুলো? ‘লেজে-মগজে’ কত বুদ্ধি তাদের?
অব্যবস্থাপনা, অবিশ্বাস ও অনাস্থার বহুমাত্রিক সংক্রমণ রাজনীতি মাড়িয়ে অর্থনীতিসহ সবখানেই। রিজার্ভ, ঋণ ও মূল্যস্ফীতির সূচক গোপন রাখা যাচ্ছে না। এরপরও একই কথা বারবার বলে-বলিয়ে মানুষকে বোকা বানিয়ে রাখার চেষ্টায় কোনো কমতি-ঘাটতি নেই। রাজনীতিকরা অর্থনীতি-গণমাধ্যমসহ সবাইকে গৃহভৃত্য না হলেও হুকুমের আজ্ঞাবহ বানাতে গিয়ে গোলমাল আরও পাকাচ্ছেন। দায় যথারীতি সরকারের ঘাড়ে জট বাঁধছে। সরকারকে দায় নেওয়া বা দায় স্বীকার করে ব্যবস্থা নেওয়ার পথে যেতে দিচ্ছে না নয়-ছয়ের হোতারা। এদের কানাডায় বেগমপাড়া গড়া, ইস্তাম্বুলে-দুবাইতে বাড়ি কেনা, আমেরিকা-মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর বা পানামার মতো দেশগুলোতে অফশোর বিনিয়োগ আটকানো কিন্তু রোখা যাচ্ছে না। যত সহজে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক রুখে দেওয়া গেছে।
করোনা, শীত, গরম, নানা অজুহাতের সঙ্গে বিশ্ব পরিস্থিতি শুনিয়ে ঘুম পাড়ানিতে ফেলা যাচ্ছে। চোর-জোচ্চোর, পাচারকারী কিন্তু ঘুমায় না। ঘুম পাড়ায় নানা বাহানায়। এসবের মাঝেই রাশিয়া-ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ আরেকটা ঘা বসিয়ে দিয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারসংকট, সুদের হার বৃদ্ধি ও জ্বালানিসংকট জাত ও পেশাদার ব্যবসায়ীদের হিমশিমে ফেলেছে। অজাত-অপেশাদারদের কথা আলাদা। এফবিসিসিআইসহ শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ ব্যাংককেও দুষেছেন। বলেছেন, তারা আর পেরে উঠছেন না। অনেকে লোকসানের ঘানি টানছেন। কারও কারও কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, বন্ধের অপেক্ষায় আরও অনেক কারখানা। এমন সময় সুদের হার বাড়িয়ে ব্যবসাকে আরও কঠিন করে তোলা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে যে, সুদহার ১৪ শতাংশের ওপরে উঠবে না। আর ডলারের দাম ১১৭ টাকার আশপাশে থাকবে। ডিসেম্বরের মধ্যে সংকট কেটে যাবে বলে আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। এসব আশ্বাস তারা কতটা বিশ্বাস করেছেন সেই হালনাগাদ তথ্য নেই।
ব্যাংকের পর অর্থনীতির আরেক বড় খাত পুঁজিবাজার। অর্থ ও বিনিয়োগসংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এ শাখাটিতে রীতিমতো আনলিমিটেড ঠকবাজি-জোচ্চুরি। বিনিয়োগকারীদের নিঃস্ব করার নিষ্ঠুরতা। পুঁজি ক্ষয়ের বর্বরতা। ছেড়ে দে মা কান্দি বাঁচির অবস্থা নেই। পুঁজি বাজারের লুটেরাদের সিনা টানটান। বাজার ব্যবস্থাপকদের সব দুর্বলতা তাদের মুখস্থ। সেখানে তাদের এক অভয়ারণ্য। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার হ্যাকের খবরকে কাজে লাগিয়ে শেয়ারের বড় পতন ঘটানোর কাজটিও তারা সেরে নিচ্ছে। পুঁজিবাজারের শুদ্ধতা নষ্ট হয়ে গেছে আরও আগেই। জুয়াড়ি চক্র নানা ছুঁতায় পুঁজি চেটেপুটে খেতে পারঙ্গম। তারা ছুঁতা পয়দা করতেও জানে। মাত্রাতিরিক্ত ঋণনির্ভরতা ও দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির খাদে পড়া এ নাচুনি বুড়িদের ঢোলে আরও বাড়ি মেরেছে। পরিস্থিতির বাস্তবতায় টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন, সুদহার বাজার ভিত্তিককরণ ও নীতিসুদ হার ৫০ পয়েন্ট বেসিস বাড়িয়ে আরও আট শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এখানে বাধ্যবাধকতার বিষয়আসয় রয়েছে। আইএমএফ থেকে পরবর্তী ঋণের কিস্তি ছাড় করানো জরুরি। আইএমএফ ছাড়াও সরকারের ওপর বহিঃস্থ আরও নানামুখী চাপ রয়েছে। অর্থনৈতিক চাপগুলো আইএমএফ চাপাচ্ছে সরকারের ঘাড়ে। সরকার চাপায় জনগণের ওপর। দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজ লুটেরাদের ঘাড়ে চাপাতে পারে না।
পুঁজিবাজারের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণ, প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন সংস্থা হলো বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-বিএসইসি। এ সংস্থা থেকে অতি সম্প্রতি আরও একটি দুর্নীতি ও লুটেরাবান্ধব ফর্মুলা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে পুঁজিবাজারের ওপর। তিন-দশ নামের ফর্মুলাটি কারসাজির আরেক সহায়ক গাইড। এরই মধ্যে উল্লিখিত তিন-দশ ফর্মুলা পুঁজিবাজারের নিত্য লেনদেনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। সার্বিক বাজার চিত্র আরও এলোমেলো করে দিয়েছে। এ ফর্মুলার সাহায্যে একটি চক্র, প্রতিদিন বাছাইকৃত মৌল ভিত্তি সম্পন্ন শেয়ারগুলোর দরপতন ঘটিয়ে মোটাতাজা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে কয়েকটি বড় প্রাতিষ্ঠানিক ব্রোকার হাউসের খেলোয়াড়রা। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারী। আরও পতন আতঙ্কে অনেক বিনিয়োগকারী হাতের শেয়ার ছেড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের এ সর্বনাশের মধ্যে কারও পৌষ মাস যাচ্ছে। পুঁজির এ নিরাপত্তাহীনতায় নতুন কাঙ্ক্ষিত ক্রেতার আগমন বা সমাগম আশা করা কঠিন।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
১৮ মে, ২০২৪