বিশেষ সাক্ষাৎকারে খুশী কবির / নারীর অধিকার খর্ব করে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়
নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় তৃণমূলে কাজ করে যাচ্ছেন মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির। দুঃস্থ নারীদের কল্যাণে সমন্বয়ক হিসেবে বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ‘নিজেরা করি’-তে যোগ দেন। নারীর বর্তমান অবস্থান, ক্ষমতায়ন, সম-অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ নানা বিষয় নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন তিনি-  কালবেলা: স্বাধীনতার বায়ান্ন বছরে বাংলাদেশে নারীর অগ্রগতি কতটা হলো? খুশী কবির: শুধুমাত্র বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই যুগ যুগ ধরে নারীর অবদান অনেক। ঘরে, কৃষিতে, অফিস আদালতে, কলকারখানা— সব জায়গায় নারীর অবদান রয়েছে। উৎপাদনমুখী যে কোনো কাজে নারী এবং পুরুষ যেই অংশগ্রহণ করুক সকলেরই অবদান রয়েছে। কিন্তু সাধারণত সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে মূল্যায়নে নারীর অবদানকে সামনে নিয়ে আসা হয় না। নারীর অবদানকে উপেক্ষা করা হয়। শত বছর ধরে এটাই আমরা দেখেছি।  বিশেষ করে একজন নারী যখন বাইরের কাজ করে অর্থ উপার্জন করছেন না বা তার ঘরের কাজকে অর্থনৈতিকভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। নারীর ঘরের কাজের যে একটি অর্থনৈতিক মূল্যায়ন রয়েছে সেটা অর্থনীতিবিদরা এতদিন গ্রহণ করেননি। তবে এখন কিছু আধুনিক অর্থনীতিবিদ সারা বিশ্ব জুড়েই নারীর এই ঘরের কাজকে অর্থনৈতিকভাবে মূল্যায়নের কথা বলছেন। তারা দেশের জিডিপি হিসাব করার ক্ষেত্রেও এটাকে হিসাব করছেন। নারীর এই ঘরের কাজকে সেবামূলক খাতের মধ্যে ধরা হচ্ছে।  একজন নারীর কাজ পরিবারের সদস্যদের সামনে খাবার তুলে দেওয়া। পরিবারের উপার্জনকারী পুরুষ সদস্য ঘরে চাল নিয়ে আসলো কি আসলো না তার উপর নির্ভর করে একজন নারী বসে থাকতে পারেন না। তাকে চুলা জ্বালাতেই হয়। নারী বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ করেন, হাঁস মুরগি পালন করেন, রান্নার কাঠ জোগাড় করেন। এই সবকিছুর একটি অর্থনৈতিক ভ্যালু রয়েছে। এই ভ্যালু অবশ্যই মূল্যায়ন করতে হবে।  ঘরের সকল কাজ চিরকাল নারীরাই করেছেন। এদেশে বহু আগে থেকেই নারীরা কৃষি কাজে অংশগ্রহণ করেছেন। ফসল লাগানো থেকে শুরু করে ফসল তোলা, প্রক্রিয়াকরণ এবং সংরক্ষণ সকল কাজেই নারীর অংশগ্রহণ রয়েছে। বিশেষ করে ফসল তোলা এবং সংরক্ষণের কাজ প্রায় সম্পূর্ণটাই নারীরাই করে থাকেন। গত ২০-৩০ বছরে দেখা গেছে, নারীরা পুরুষের পাশাপাশি কৃষিতে শ্রমিক হিসেবেও কাজ করছেন। কিন্তু সেখানে নারীরা অনেক কম মজুরি পাচ্ছেন। একজন পুরুষ শ্রমিক ৫০০ টাকা মজুরি পেলে একজন নারী শ্রমিক মজুরি পান ৩৫০ টাকা। সুতরাং নারীরা তাদের কাজের অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে মূল্যায়িত হচ্ছেন না। আমাদের সমাজে নারীকে পুরুষের সমানভাবে দেখা হয় না।  কালবেলা: আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হচ্ছি। আমাদের জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ নারী। নারীদের ক্ষমতায়ন না করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা কতটা সম্ভব? খুশী কবির: আমি যদি শুধুমাত্র অবকাঠামো এবং গড় আয়কে উন্নয়ন হিসেবে দেখি সেটা এক ধরনের হিসাব। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন দেশের রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো বলে কোনো কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। এরপর বন্যা এবং পরবর্তীতে রাজনৈতিক সংকট। সব মিলে সে সময় দারিদ্র্যের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। সেই অবস্থা থেকে বাংলাদেশ আজকের এই জায়গায় এসেছে। মানুষের ঘরে এখন অন্তত দুইবার চুলা জ্বলে। কিন্তু একই সঙ্গে দেশে ধনী এবং গরিবের বৈষম্য অনেক বেড়ে গেছে। আমরা গড় যে মাথাপিছু আয় দেখছি সেটা দিয়ে দেশের মানব উন্নয়ন বিচার করা যাবে না। মাথাপিছু আয় একজন মানুষের হাজার কোটি টাকা এবং আরেকজন মানুষ ১০০ টাকার মালিক এই দুটিকে গড় করে দেখানো হচ্ছে। এভাবে দেখলে মাথাপিছু আয় অনেক মনে হয়, সকল মানুষের অনেক আয় আছে বলে মনে হয়। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি খুব একটা সুখকর নয়। বিপুল মানুষের আয় এখনো গড় আয়ের চেয়ে কম।  ধনী ও গরীবের ব্যবধান অনেক বেড়ে গেলে সেখানে শোষণ বেড়ে যায়। আমি যদি নিজেকে উন্নত হচ্ছি বলে দাবি করি তাহলে দেশের সকল মানুষের উন্নতির কথা চিন্তা করতে হবে। আমি যদি উন্নত হচ্ছি বলে মনে করি তাহলে নারীদের অংশগ্রহণও স্বীকার করতে হবে।  নারীদেরকে কর্ম ক্ষেত্রে নিয়ে আসার ব্যাপারে গার্মেন্ট শিল্প বড় ভূমিকা রেখেছে সত্য। কিন্তু গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরিতে তাদেরকে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। নারীদের কম মূল্যে কাজ করানো হচ্ছে। অর্থাৎ সস্তা শ্রমের জন্য নারীদের ব্যবহার করা হচ্ছে। আমরা উন্নত হচ্ছি কিন্তু শুধু গড় হিসাব দেখিয়ে উন্নয়ন হওয়া এবং সত্যিকারের মানব উন্নয়ন করা এক বিষয় নয়। উন্নয়ন মানে সকলের উন্নয়ন। মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকার সকলেই যাতে ভালোভাবে পূরণ করতে পারে সেটাই উন্নয়ন।  দেশের জনসংখ্যার ৫০ শতাংশই নারী। নারীরা ঘরের কাজ করছেন পাশাপাশি পুরুষের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বাহিরের কাজও করছেন। কৃষি, শিল্প, সেবা খাত ও অফিস আদালত সকল ক্ষেত্রেই নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। এই সকল উৎপাদনমুখী কাজে নারী অংশগ্রহণ করেছে বলেই আমাদের অগ্রগতি দ্রুততর হয়েছে। নারীরা যদি আরও বেশি সংখ্যায় কর্ম ক্ষেত্রে আসেন তাহলে দেশের উন্নয়ন আরো ত্বরান্বিত এবং শক্তিশালী হবে। তাই নারীদেরকে বাদ দিয়ে কোনোভাবেই টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।  কালবেলা: বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছে ৫২ বছর হলো। এর ৩০ বছরের বেশি সময় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন নারী। এরপরেও নারীর অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়নি কেন?  খুশী কবির: অনেক বছর ধরে আমাদের দেশে নারী সরকার প্রধান দায়িত্ব পালন করছেন। এত বছর একটানা নারী প্রধানমন্ত্রী পৃথিবীর ইতিহাসে কমই আছে। তবে আমি ব্যক্তিকে দিয়ে একটি গোটা জাতিকে মূল্যায়ন করতে পারি না। ব্যক্তি আমাদের সামনে একটি উদাহরণ হিসেবে আসেন। একটি রোল মডেল হিসেবে আসেন। রোল মডেল মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে শেখায়। একজন নারী প্রধানমন্ত্রীকে দেখে একটি ছোট শিশু নারী কি করতে পারেন সেটা শিখতে পারে। কিন্তু গোটা ব্যবস্থা এবং চিন্তাধারা কোনো কিছু পরিবর্তন না করে শুধু একজন নারী সরকার প্রধানকে দিয়ে মূল্যায়ন করতে পারবো না। পরিবার থেকে শুরু করে গোটা সমাজ ব্যবস্থা নারীকে সুযোগ দিচ্ছে না।  কালবেলা: বিদ্যমান সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কী?  খুশী কবির: পুরুষদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার সবার আগে। নারী-পুরুষের লিঙ্গগত পার্থক্য ছাড়া, অন্য কোনো পার্থক্য আমার চোখে পড়ে না। আর যা পার্থক্য দেখেন, সেটা সমাজের সৃষ্টি। সমাজই চোখে আঙুল দিয়ে নারী আর পুরুষের আলাদা বৈশিষ্ট্য তৈরি করে বিভেদ সৃষ্টি করছে। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রীসহ অনেক উচ্চ পদে এখন নারীরা কাজ করছেন, ফলে নারীর ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের সময় হয়েছে। কালবেলা: শুধু কী পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি বা মানসিকতা পরিবর্তনের মাধ্যমে এই সমস্য থেকে উত্তরণ সম্ভব বলে মনে হয় আপনার? খুশী কবির: না, তেমনটা আমি মনে করি না। পুরুষের মানসিকতার সাথে সাথে নারীদেরও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। আমি অনেকের সাথেই কথা বলি। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বা কর্মজীবী নারীরও পরিবার থেকে বিয়ের ব্যাপারে চাপ থাকে। নারী বিদেশ থেকেও যদি উচ্চ শিক্ষা নিয়ে আসে কিংবা যতই মুক্তমনা পরিবারে বেড়ে উঠুক না কেন, একটা স্টেজের পরে তাকে বিয়ের জন্য নানাবিধ চাপ প্রয়োগ করা হয়। কালবেলা এ সময়ে এসেও নারীর স্বাধীনতাকে ভালো চোখে না দেখার কারণগুলো কী? খুশী কবির: এখন সমাজ যদি মনে করে, একজন নারীর স্বাধীনভাবে চলাচল করা উচিত না বা ভালো না, তবে তো আমি বলবো- আমাদের টোটাল সমাজ ব্যবস্থাই নারীকে ভয় পায়, নারীর স্বাধীনতাকে তারা ভয় পায়। নারীর স্বাধীনতাকে ভয় পায় বলেই এইসব প্রতিবন্ধকতা সমাজেরই সৃষ্টি। নারী স্বাধীনভাবে চলাচল করলে কিংবা স্বাধীনতা উপভোগ করলে, পুরুষের সম মর্যাদার হয়ে যাবে, এটাতেই তাদের ভয়। তারা কোনো অবস্থাতেই নারীকে পুরুষের সমকক্ষ হতে দেবে না। কালবেলা: একজন পুরুষ দিন হোক বা রাত, যে কোনো সময় রাস্তায় একা চলাফেরা করতে পারছে, কিন্তু একজন নারীর ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হচ্ছে না... খুশী কবির: মূল ভয়টা কী আসলে? নারীকে ধর্ষণ করা হবে? কিংবা অপহরণ করা হবে, তাই তো? এখন একজন পুরুষ যখন রাতের বেলায় বাইরে থাকে; সে যদি ছিনতাই, ডাকাতি বা খুন করতেও বাইরে অবস্থান করে, তাকে কিন্তু প্রমাণ করতে হয় না, সে ভালো কী খারাপ! তার চরিত্র নিয়েও কেউ প্রশ্ন করে না, যতই সে খারাপ কাজ করুক না কেন।  কিন্তু একই ঘটনা যদি একজন নারীর ক্ষেত্রে ঘটে! জরুরি কাজে হোক কিংবা ঘুরতেই বাইরে বের হোক, কেন একজন নারীকে তার চারিত্রিক সনদ দেখাতে হবে? কেন তাকে প্রমাণ করতে হবে- সে ভালো নাকি মন্দ? আপনার নিশ্চয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোমানা মঞ্জুরের ঘটনা মনে আছে? তার স্বামী যখন চোখ উপড়ে ফেললো, মিডিয়ায় সে খবরের চেয়ে বেশি ফলাও করে প্রচার করলো- রোমানার বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কথা। আবার তার পরিবারও কিন্তু এটা ডিফেন্ড করার জন্য সবাইকে বুঝাতে চেষ্টা করলো- সে বেশ ধার্মিক মেয়ে, ভালো মেয়ে। ভালো-মন্দ প্রমাণ করতে হবে কেন? তার সঙ্গে একটা অমার্জনীয় অন্যায় করা হয়েছে। একজন পুরুষ হত্যা হলে বা তাকে কেউ হত্যার চেষ্টা করলে কি প্রমাণ করতে হয়- সে ভালো ছিল না কি মন্দ? নারীকে কেন করতে হবে? অপরাধী যেই হোক, সে তো অপরাধী-ই। ভিক্টিমাইজ যে হয়েছে, সে ভালো নাকি মন্দ এটা তো মূল বিষয় হওয়ার কথা না। এই মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। কালবেলা: কোন জায়গাটায় নজর দিতে হবে বলে মনে করেন?  খুশী কবির: প্রথমেই আমাদেরকে পরিবারের ভেতরে নজর দিতে হবে। এরপর নজর দিতে হবে সমাজে। আমাদের ভালো কিছু আইন রয়েছে। কিন্তু সে সকল আইনের প্রয়োগ একদমই নেই। এছাড়া আইনকে ব্যাখ্যা করার মধ্যে অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ: যখন ১৯৮৪ সালে ভূমি সংস্কার আইন করা হয় তখন খাস জমি বিতরণের ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা তৈরি করা হয়েছিল। সেই নীতিমালায় বলা হয়েছে একজন নারী তখনই জমি পাবেন যদি তার একটি সক্ষম পুত্র সন্তান থাকে। একটি সক্ষম পুত্র সন্তান থাকার শর্ত দেওয়া হয়েছে। তাহলে যাদের সক্ষম পুত্র সন্তান নাই তাদের কী হবে? এভাবে বৈষম্য করা হয়েছে।  ধর্মীয় দিক থেকেও নারীদেরকে এক ধরনের বৈষম্যের মধ্যে রাখা হয়। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ইউরোপ বা ফিলিপাইন এক এক দেশে এক একটি ধর্মীয় মানুষ সংখ্যাগুরু। সব দেশেই প্রায় একই অবস্থা লক্ষণীয়। যারা ধর্ম প্রচার করছেন তারা এক ধরনের পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা পোষণ করেন।  যেহেতু রাষ্ট্র পিতৃতান্ত্রিক সুতরাং রাষ্ট্রের চিন্তার মধ্যে রয়েছে নারীকে দমিয়ে রাখা। ধর্ম যেভাবে প্রচারণা চালানো হয় সেটাও সাংঘাতিকভাবে পিতৃতান্ত্রিক, আমাদের আইনগুলো পিতৃতান্ত্রিক। সবকিছুই পিতৃতান্ত্রিক হওয়ার কারণে নারীরা উঠে আসতে পারেন না। এর মধ্য থেকে যে নারীরা উঠে আসেন তাকে প্রমাণ করতে হয় যে তিনি একজন পুরুষের থেকেও বেশি। সুতরাং পরিবর্তনটা করতে হবে একদম গোড়া থেকেই। পরিবার থেকে এই পরিবর্তনটা শুরু হওয়া উচিত।  কালবেলা: আমাদের দেশ নারীবান্ধব হয়ে উঠতে পারেনি কেন? খুশী কবির: পরিবর্তন আনতে পারিনি কারণ আমাদের দেশে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। ১৯৭২ সালে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে বাতিল করা হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে আবার এই দলগুলোকে রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর থেকে সকল দলই মনে করে ধর্মকে ব্যবহার করতে হবে তা না হলে জনগণ তাকে গ্রহণ করবে না। ফলে মূলত এই ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে জড়িয়ে ফেলার কারণে আমরা বাংলাদেশকে নারীবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে পারিনি।  ধর্মীয় কারণ ছাড়াও বিভিন্ন আইনের মধ্যেও নারীর প্রতি বৈষম্য রাখা হয়েছে। যেমন খাস জমি বণ্টনের ক্ষেত্রে। নারীরা পাসপোর্ট করতে, জমি কিনতে বা একটি ফ্যাক্টরি তৈরি করতে, কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করতে— যেকোনো কাজেই একজন পুরুষকে গ্যারান্টার হতে হবে। এটা অবশ্যই নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ।  কালবেলা: যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী। কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা বা সহযোগিতা পুরুষদেরকেই দেওয়া হয়। এ বিষয়ে আপনার মত কী? খুশী কবির: মানুষ মনে করে, নারী যখন কাজ করেন বা উপার্জন করেন সেটা সাবসিডিয়ারি। নারীকে পুরুষের সহযোগী হিসেবে দেখা হয়। অর্থাৎ পরিবারের পুরুষ সদস্যের আয় ভালোভাবে সংসার চলছে না তাই পরিবারের নারী সদস্যের আয়কে পরিপূরক হিসেবে দেখা হয়। আলাদা সত্তা হিসেবে দেখা হয় না। নারীকে শুধুমাত্র পরিবারের সদস্য হিসেবে দেখা হয়। যে কারণে প্রণোদনা, সহযোগিতা বা অন্যান্য ক্ষেত্রে নারীকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। যখন খাস জমি দেওয়া হয় তখন স্বামী এবং স্ত্রী উভয়ের নামেই রেজিস্ট্রি হয়। কিন্তু স্বামী সেটাকে দেখেন, ওই নারী তার স্ত্রী বলেই জমিটা পেয়েছে। নারী একজন নাগরিক হিসেবে বা একক সত্তা হিসেবে জমি পাননি। আমরা যদি নারীদেরকে এবং নারীদের কাজকে আলাদা ব্যক্তি সত্তা হিসেবে দেখতে না পারি তাহলে পরিবর্তন আসবে না।  কালবেলা: দেশের নারীর ক্ষমতায়নের দিকটাকে কীভাবে দেখছেন? খুশী কবির: আগেই তো বলেছি- কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীরা বেশ এগিয়ে গেছে, অনেকেই নিজের অনেক ভালো অবস্থান তৈরি করেছে। আপনি ২০-২৫ বছর আগের কথাও যদি ভাবেন, নারীদের অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হতো। ঘর থেকে বের হতে পারতো না, পড়াশোনাও একটা স্টেজ পরে বন্ধ করে দিতে হতো। আর এখন খোঁজ নিলে জানতে পারবেন- প্রাথমিক শিক্ষায় ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা বেশি, লেখাপড়াতেও মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় ভালো ফলাফল করছে। এখন যে প্রতিবন্ধকতাগুলো আছে, ভবিষ্যতে আমাদের নারীরা এগুলো অতিক্রম করে আরো এগিয়ে যাবে বলে আশা করি। কালবেলা: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সম্পদের উপর নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার অগ্রগতি কতটা? খুশী কবির: অনেক বড় প্রতিষ্ঠানের সিইও বা চেয়ারম্যান নারী রয়েছেন। কিন্তু তার হাতে কোনো ক্ষমতা নেই। তাকে শুধুমাত্র লোক দেখানো সিইও বা চেয়ারম্যান বানিয়ে রাখা হয়েছে। ধনিক শ্রেণীর অনেকে স্ত্রীর নামে বাড়ি বা সম্পদ বানাচ্ছে। কিন্তু সেই সম্পদে স্ত্রীর আধিপত্য নেই। আমি এমন অনেক ধনী পরিবারের নারীকে চিনি, যারা অনেক অত্যাচারের সম্মুখীন হন। কিন্তু তারা কথা বলেন না এবং ওই পরিবার ছেড়ে চলেও আসেন না। আমি অনেককে জিজ্ঞেস করেছি, সম্পদের মালিকানা রয়েছে তার নামে তাহলে সে পরিবার ছেড়ে দিচ্ছে না কেন। অত্যাচার সহ্য করে পরিবার আঁকড়ে ধরে আছে কেন? তারা কেউ পরিবার ছাড়তে কোনোভাবেই রাজি নয়। তারা কম্প্রোমাইজ করেন, নিজে সহ্য করেন। কিন্তু পরিবার থেকে বের হতে পারেন না কারণ তাদের সাহস নেই। কারণ তারা জানেন, সমাজ তাকে গ্রহণ করবে না, সমাজ তাকে সেভাবে সাপোর্ট দেবে না।  কালবেলা: কর্মক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা বাড়ছে বলছেন কিন্তু নারীর কর্ম পরিবেশ কি বন্ধুত্বপূর্ণ হয়েছে? খুশী কবির: না, এখনো সেই প্র্যাক্টিস আমাদের গড়ে উঠেনি। সে জন্যই তো বারবার বলছি, আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন সবার আগে জরুরি। প্রতিটা প্রতিষ্ঠানের উচিত তার নারী কর্মীদের যৌন নিপীড়ন বা হয়রানি রোধ করার জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক কমিটি গঠন করা। শুধু প্রতিষ্ঠানের নয়, প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকেও এক-দুই জন সদস্য সেখানে থাকতে পারে, নিরপেক্ষ জাজমেন্টের জন্য। এসব নীতিমালা কিন্তু আছে, কিন্তু কয়জন সেটা মেনে চলে? আবার দেখবেন যৌন হয়রানের শিকার কোনো নারী কর্মী যদি প্রতিষ্ঠানের কাছে অভিযোগ করতে যায়, অনেক ক্ষেত্রে ভিক্টিমকেও বাজে ভাবে দেখা হয়। ফলে এসব ক্ষেত্রে আমাদের এখনো আরো অনেক কাজ করা বাকি। পুরুষদের সহযোগিতা ছাড়া যেমন এগুলো করা সম্ভব  না, পুরুষদের মানসিকতাও আমাদেরই পরিবর্তন করতে হবে। কালবেলা: শহরে, নাকি গ্রামাঞ্চলে নারীরা বেশি নির্যাতিত হচ্ছেন?  খুশী কবির: আমাকে এই প্রশ্ন অনেকেই করে, আমি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই গ্রামের নারীদের সাথে কাজ করা শুরু করেছি, তাদের কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। গ্রামে তো মানুষের বেড়ার-টিনের ঘর, আর ঘরগুলো কাছাকাছি হওয়ার কারণে, কোনো ঘটনা ঘটলে সবাই জানাজানি হয়ে যায়। আমি যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় কোনো গ্রাম্য সালিশে নারীর উপস্থিতির অধিকার ছিল না। বিচার যেটা করা হতো সেটাও এক তরফা। এখন তো এসব পরিবর্তন হয়েছে, সালিশে নারীরা উপস্থিত থাকে, কথা বলে। এ দিক দিয়ে বিবেচনা করলে নারী সচেতনতা বেড়েছে। তবে যে পরিমাণ নির্যাতন তার উপর হচ্ছে, এটা হয়ত আগে ছিল না। আগের নির্যাতনগুলো অন্য রকম ছিল- একঘরে করে রাখা হতো, জোর করে সব কিছু চাপিয়ে দেওয়া হতো। আর এখন নারীকে জোর করে ধর্ষণ করা হচ্ছে, সেটার আবার ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে বা ছেড়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মানসিক নির্যাতন করা হচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীর এ সময়ে এসে এগুলো ঘটনা আমাদের সমস্ত অবদানকে পেছনে নিয়ে যাচ্ছে। শহুরে নারীরা যে নির্যাতিত হচ্ছে না, তা কিন্তু না। কিন্তু সামাজিক ভয়ে, লোক লজ্জার ভয়ে,আর স্ট্যাটাসের কথা ভেবে শহুরে নারীরা খুব কমই এসব নিয়ে কথা বলেন। তাদের উচিত এগুলো বিষয়ে প্রতিবাদ করা, নতুবা তাদের সাথে গ্রামের অসহায় ওই নারীদের কি পার্থক্য থাকলো? তাও তো গ্রামের নারীরা প্রতিবাদ করছে, চিৎকার চেঁচামেচি, ঝগড়াঝাঁটি করছে, স্বামী-শ্বশুর বাড়ির ক্টু কথা, অপমান সহ্য করেও গ্রাম্য সালিশের শরণাপন্ন হচ্ছে, শহুরে নারীরা কিন্তু সেটা খুব একটা করছেন না। কালবেলা: নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে কঠোর আইন থাকলেও, যৌতুকের দাবি, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, হত্যা- এসব ঘটনা অহরহ ঘটছে কেন?  খুশী কবির: রাষ্ট্র যদি আইন করে থাকে, তবে তার দায়িত্ব হচ্ছে সেটা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা। কিন্তু রাষ্ট্র কি তা করছে? নারী নির্যাতন বন্ধে যে সকল আইন বা নীতিমালা হয়েছে, দুঃখজনক হলেও সত্য- এগুলো বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর ভূমিকায় নেওয়া হচ্ছে না। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই কিন্তু নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করেছে এবং করছে অনেক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে পচাঁত্তুরের পরে যখন জাতিসংঘ নারী দিবস পালন করা শুরু করলো, নারী দশক পালন করলো এর পর নারীদের জন্য বিশেষ কিছু উদ্যোগ নিলো যেমন প্লাটফর্ম ফর এ্যাকশনস নেয়া শুরু করলো তখন তৈরি হতে শুরু করলো নারী উন্নয়ন নীতি। জাতিসংঘ তার সদস্যভুক্ত সব দেশে থেকে নারীদের জন্য অবস্থান, উন্নয়ন পরিকল্পনা আহ্বান করা শুরু করে। তো জাতিসংঘ অনেক ইফোর্ট দিয়েছে নারীর উন্নয়নে, সেই সুরে বাংলাদেশও তাঁর উন্নয়ন পরিকল্পনায় নারীদের অগ্রাধিকার দিয়েছে । স্যোশাল ডেভলপমেন্ট গোল-এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা কিন্তু তখনি নির্ধারণ করে সরকার। নারীর সমতাকে বিষয়ে সরকার বেশ গুরুত্ব দিয়েছে। সমসতা ছাড়াও আরও অনেকগুলো বিষয় আছে যেগুলোর মধ্যে নারীর মর্যাদা, নারীর নিরাপত্তাসহ সবকিছু। আমরা সবাই এসব ইস্যু নিয়ে কাজ করার কথা বলছি কিন্তু প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্রটা দেখতে পাই। ঘরের ভেতরে, পরিবারে সমাজে, কর্মক্ষেত্রেই নারীর প্রতি সহিংসতাটা কিন্তু বেড়েই চলেছে। সেই মেয়ে হোক বিধবা বা সিঙ্গেল অথবা তালাকপ্রাপ্তা, সন্তানসহ কিংবা সন্তানছাড়া, ছাত্রী কি ছাত্রী না, বোরখা পড়ে কি বোরখা পড়ে না- সকলেই কিন্তু সহিংসতার শিকার হচ্ছে। বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি সেটাকেই সহিংসতা বৃদ্ধির মূল কারণ বলে মনে করি আমি। নারীদের জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল আছে। তারপরও এমন কিছু মান্ধাতা আমলের আইন আমাদের এখনও আছে যার পরিবর্তন করা সময়ের দাবি। অথচ সেই একই ধরনের আইন কিন্তু পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে পরিবর্তন করে সময়োপযোগী করা হয়েছে। ফলে কি হয়েছে, অপরাধ ঘটছে, অপরাধী ধরাও পড়ছে কিন্তু আইনের ফাঁকফোকর বেয়ে তারা বের হয়ে যাচ্ছে। যেকারণে অপরাধ কমছেই না। বিশেষ করে নারীর প্রতি সহিংসতার অপরাধ। কালবেলা: নারীর অধিকার সমুন্নত এবং দেশকে আরো নারীবান্ধব দেশ হিসেবে গড়তে আপনার পরামর্শ কী?  খুশী কবির: প্রথমত, সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারীদের অধিকার যাতে খর্ব করা না হয় সেই বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। আইনগুলো সংশোধন করতে হবে এবং নারীবান্ধব করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনতে হবে। ছোটকাল থেকেই বাচ্চাদেরকে শেখাতে হবে নারী-পুরুষ সকলে সমান। এটা ছেলেদের কাজ এটা মেয়েদের কাজ এভাবে কোনো বৈষম্য শেখানো যাবে না। পুরুষদেরকে তাদের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের উত্তরাধিকার আইনটা সম্পূর্ণ পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের সংবিধান বলে যে নারীদের সবদিকেই সমান অধিকার হতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশেও সমান অধিকার দেয়া আছে। কিন্তু আমাদের দেশে এখনও পারিবারিক আইন ধর্ম দ্বারা পরিচালিত। এর পরিবর্তন হওয়া জরুরি। পারিবারিক আইনে আছে উত্তরাধিকার, অভিভাবকত্ব, ভরণ-পোষণ আর আছে তালাকের বিষয়টা। এই সব জায়গায় ধর্মীয় বিধিনিষেধকেই আইন হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। একজন নারী অধিকার কর্মী হিসেবেই নয়, মানুষ হিসেবেও পরিবর্তন প্রত্যাশা করি। শ্রুতলিখন: মুজাহিদুল ইসলাম 
০৪ মে, ২০২৪
X