জলদস্যুর কবলে বাংলাদেশি জাহাজ, ২৩ নাবিক জিম্মি
আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার পথে ভারত মহাসাগরে জলদস্যুর কবলে পড়েছে বাংলাদেশি পতাকাবাহী একটি জাহাজ। এমভি আবদুল্লাহ নামের ওই জাহাজে ২৩ জন বাংলাদেশি নাবিক ছিলেন, তারা সবাই জিম্মি দশায় পড়েছেন বলে জানা গেছে। গতকাল মঙ্গলবার উপকূল থেকে ৪৫০ নটিক্যাল মাইল দূরে থাকা কয়লাবাহী জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নেয় সোমালীয় জলদস্যুরা। কেএসআরএম গ্রুপের মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের জাহাজটি নৌপথে পণ্য পরিবহন করে। জাহাজের ক্যাপ্টেনের নাম আব্দুর রশিদ। জাহাজটিতে প্রায় ৫০ জন সশস্ত্র জলদস্যু অবস্থান করছে বলে জিম্মি ক্রুরা তাদের প্রতিষ্ঠানকে জানিয়েছেন। জিম্মি হওয়া ক্রুরা হলেন ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ, চিফ অফিসার মোহাম্মদ আতিকুল্লাহ খান, দ্বিতীয় কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম চৌধুরী, তৃতীয় কর্মকর্তা মো. তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট মো. সাব্বির হোসেন, প্রধান প্রকৌশলী এএসএম সাইদুজ্জামান, দ্বিতীয় প্রকৌশলী মো. তৌফিকুল ইসলাম, তৃতীয় প্রকৌশলী মো. রোকন উদ্দিন, চতুর্থ প্রকৌশলী তানভীর আহমদ, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহিম খলিল উল্লাহ, এবি মো. আনোয়ারুল হক, এবি মো. আসিফুর রহমান, এবি সাজ্জাদ হোসেন, ওএস জয় মাহমুদ, ওএস মো. নাজমুল হক, ওএস আইনুল হক, অয়েলার মোহাম্মদ শামসউদ্দিন, মো. আলী হোসেন, ফায়ারম্যান মোশারফ হোসেন শাকিল, চিফ কুক মো. শফিকুল ইসলাম, জিএস মো. নূর উদ্দিন ও ফিটার মো. সালেহ আহমেদ। তাদের মধ্যে ১১ জন চট্টগ্রামের ও দুজন নোয়াখালীর। বাকিরা ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, নওগাঁ, খুলনা, নেত্রকোণা, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, বরিশালের। আরেকটি কোম্পানির জাহাজে কর্মরত চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর এলাকার আরমান হোসেন বাবু নামের একজনের কাছে অডিওবার্তায় এক নাবিক (নাম জানা সম্ভব হয়নি) বলেছেন, ‘আমাদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে ডাকাতরা (জলদস্যু)। আমি ওয়াশরুম থেকে ভয়েস দিচ্ছি। ওরা সাত-আটজন আছে। আমাদের ওদের ডেরায় নিয়ে যাবে। ওদের সবার কাছে গান (অস্ত্র) আছে।’ অডিওবার্তায় আরও বলা হয়, ‘আমরা মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে দুবাইয়ের পথে যাচ্ছিলাম। ওরা (জলদস্যু) দুই মাস আগে ইরানি একটি ফিশিং বোট আটক করেছিল। ওটা আমাদের জাহাজের সঙ্গে বর্তমানে বাঁধা আছে। ওটা থেকেই মূলত জলদস্যুরা আমাদের আক্রমণ করে। ওই ফিশিং বোটটা ওরা হয়তো ছেড়ে দেবে। ওই বোটের জন্য আমরা ডিজেল দিলাম। আমাদের নিয়ে ওরা হয়তো ওদের আস্তানায় চলে যাবে।’ বিষয়টি নিশ্চিত করে কেএসআরএমের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘জাহাজটি মোজাম্বিক থেকে দুবাই যাওয়ার পথে আক্রমণের শিকার হয়েছে। সোমালীয় জলদস্যুরা তাদের নেটওয়ার্ক বাড়াচ্ছে। দুই দিন আগে এমভি আবদুল্লাহর গতিপথ পরিবর্তন করে সোমালিয়ার দিকে ঘুরিয়ে নেয় জলদস্যুরা। তবে ২৩ ক্রু জাহাজের কেবিনের ভেতরে নিরাপদে আছেন বলে জানতে পেরেছি। আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি।’ এসআর শিপিংয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মেহরুল করিম বলেন, দুপুর দেড়টার (গতকাল) দিকে তাদের কাছে একটি বার্তা পাঠায় জলদস্যুরা। জলদস্যুরা কোনো ধরনের মুক্তিপণের ব্যাপারে এখনো তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। তবে ২৩ জন নাবিকের সবাই নিরাপদে আছেন বলে তারা জানিয়েছেন। আমরা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, ‘ঘটনাটি সোমালিয়ান উপকূলের প্রায় ৫০০ নটিক্যাল মাইল দূরে ঘটেছে। প্রথমে জাহাজের ক্যাপ্টেন আমাদের জলদস্যুদের আক্রমণের কথা জানান। আমরা তাকে যে কোনো মূল্যে তাদের ঠেকানোর নির্দেশ দিই। ১৫ মিনিট পর ক্যাপ্টেন একটি ইমেইল পাঠান, যেখানে তিনি জানান, জলদস্যুরা জাহাজের দখল নিয়েছে।’ জাহাজটি ৫৮ হাজার মেট্রিক টন কয়লা বহন করছিল বলে জানান তিনি। এসআর শিপিং দেশের অন্যতম বৃহত্তম শিপিং কোম্পানি। তারা সমুদ্রগামী বাণিজ্য জাহাজ পরিচালনা করে। ৪৫ হাজার ৬৫৩ ডেডওয়েট টন (ডিডব্লিউটি) ওজনের বাল্ক ক্যারিয়ার এমভি আবদুল্লাহর মোট দৈর্ঘ্য (এলওএ) ১৮৫ দশমিক ৭৪ মিটার এবং প্রস্থ ৩০ দশমিক ৪ মিটার। এর আগে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন এমভি জাহান মনি জাহাজ ছিনতাই করেছিল সোমালীয় জলদস্যুরা। ওই জাহাজের ২৫ ক্রু এবং প্রধান কর্মকর্তার স্ত্রী জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয়েছিলেন। প্রায় ১০০ দিন জিম্মি থাকার পর তাদের উদ্ধার করা হয়। ভারতীয় উপকূল থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরের লাক্ষা দ্বীপপুঞ্জ থেকে সুয়েজখাল হয়ে সিঙ্গাপুর থেকে ইউরোপগামী জাহাজটি হামলার শিকার হয়। ১০০ দিন জিম্মি থাকার পর নাবিকরা মুক্তি পান। চলতি বছরের জানুয়ারিতেই দুই দিনের ব্যবধানে দক্ষিণ আরব সাগরে সোমালিয়ার সশস্ত্র জলদস্যুরা ইরানের পতাকাবাহী মাছ ধরার ‘এফভি আল নাঈমি’ ও ‘এফভি ইমান’ নামে দুটি জাহাজে আক্রমণ চালিয়েছিল। আল নাঈমির ১৯ পাকিস্তানি ক্রুকে জিম্মি করা হয় তখন। এমভি ইমানে জিম্মি হয়েছিল ১৭ ইরানি ক্রু। ভারতের নৌবাহিনীর রণতরী ‘আইএনএস সুমিত্রা’ জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে থাকা জাহাজ দুটির গতিপথ রুদ্ধ করে দেয় এবং জিম্মিদের মুক্তি দিতে জলদস্যুদের বাধ্য করে।
১৩ মার্চ, ২০২৪
X