পরিবেশ রক্ষায় ইসলামের তাগিদ
পৃথিবীতে মানুষ যেসব বিরূপ পরিবেশ ও পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়, তার প্রধানতম কারণ ব্যক্তিগত বা সম্মিলিত পাপ। মানুষের উপর্যুপরি পাপের ভারে প্রকৃতি আজ ভারসাম্য হারিয়ে বিরূপ আচরণ করছে মানুষের সঙ্গে। শীতের মৌসুমে পরিবেশ শীতল হচ্ছে না, কিন্তু যখন শীত নামছে সেটা মানুষের শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। বৃষ্টির মৌসুমে বৃষ্টি হচ্ছে না, কিন্তু যখন বৃষ্টি হচ্ছে, সব প্লাবিত করে দিচ্ছে। গ্রীষ্মে গরমের স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক থাকছে না, বরং প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে মানুষ ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত। পরিবেশের এ বিরূপ আচরণ মানুষের পাপের ফসল। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে, ফলে তাদের কোনো কোনো অপকর্মের শাস্তি তিনি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ (সুরা রোম, আয়াত : ৪১)
কিন্তু মানুষ নিজের সাময়িক স্বার্থ পূরণে পরিবেশের ওপর নির্মম অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। গাছগাছালি ও প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করে চলেছে অবলীলায়। এসবের অবশ্যম্ভাবী ক্ষতির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে পৃথিবীর জলবায়ুতে। পৃথিবীর তাপমাত্রা অধিক পরিমাণে বাড়ছে, জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। পৃথিবীর সব অঞ্চলেই খরা, বন্যা ও পশুপাখির বিলুপ্তি ঘটছে। একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবী অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জনের জন্য নির্বিচারে বনজঙ্গলের কাঠ কেটে বিক্রি করছে এবং পাহাড় কেটে ধ্বংস করছে। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্ট করছে এবং এতে জনগণ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে; এমনকি পরিবেশ বিপর্যয়ে শত শত লোক মৃত্যুবরণ করছে। আসলে আল্লাহতায়ালা তার সৃষ্টিজগতে সবকিছু সৃষ্টি করেছেন পরিমিতরূপে আর এতে রেখেছেন প্রাকৃতিক ভারসাম্য। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেককে পরিমিত করেছেন যথাযথ অনুপাতে।’ (সুরা আল-ফোরকান, আয়াত : ২)
ইসলামে যেমন ইবাদতের তাৎপর্য রয়েছে, তেমনি রয়েছে পরিবেশের গুরুত্ব। কোন পরিবেশে বসবাস করলে মানুষের সুবিধা হবে বা মানুষ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে পারবে, ইসলাম তা সুনিশ্চিত করেছে। আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে, যেমন—গাছপালা, বাড়িঘর, মাটি, পানি, বায়ু, জীবজন্তু, পশুপাখি, রাস্তাঘাট, নদীনালা, পাহাড়-পর্বত, যানবাহন, কলকারখানা ইত্যাদি নিয়েই পরিবেশ। এগুলো সবই মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। এরশাদ হচ্ছে—‘আমি পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছি এবং এতে পর্বতমালা সৃষ্টি করেছি। আমি পৃথিবীতে প্রতিটি বস্তু সুপরিমিতভাবে সৃষ্টি করেছি। এতে তোমাদের জন্য জীবিকার ব্যবস্থা করেছি। আর তোমরা যাদের জীবিকাদাতা নও, তাদের জন্যও। প্রতিটি বস্তু ভান্ডার আমার কাছে রয়েছে। আমি তা প্রয়োজনীয় পরিমাণে সরবরাহ করে থাকি। আমি বৃষ্টিগর্ভ বায়ু প্রেরণ করি। এরপর আকাশ থেকে মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করি। তা তোমাদের পান করতে দিই। এর ভান্ডার তোমাদের কাছে নেই।’ (সুরা হিজর : ১৯-২২)
মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টিজীবের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান খুব দরকার। এগুলোর বিনাশ বা ক্ষতিসাধন করা হলে প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হয়। অথচ ইসলাম তার অনুসারীদের সামগ্রিকভাবে সৌন্দর্যমণ্ডিত দেখতে চায়। তাই স্বাস্থ্যসম্মত পরিচ্ছন্ন পরিবেশ এবং উন্নত জীবনমান পদ্ধতি একে অন্যের পরিপূরক। পৃথিবীর মানুষকে গাছপালা ও পাহাড়-পর্বতকে ধ্বংস না করার জন্য সতর্কবাণী দিয়ে পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে—‘তিনিই আল্লাহ, যিনি বায়ু প্রেরণ করেন। এরপর তা (বায়ু) মেঘমালাকে সঞ্চালিত করে। অতঃপর তিনি (আল্লাহ) মেঘমালাকে যেভাবে ইচ্ছে আকাশে ছড়িয়ে দেন এবং তাকে (মেঘমালাকে) স্তরে স্তরে রাখেন। এরপর তুমি দেখতে পাও যে, তার মধ্য থেকে বৃষ্টিধারা নির্গত হয়। তিনি (আল্লাহ) তার বান্দাদের মধ্যে যাদের ইচ্ছে তা (বৃষ্টি) পৌঁছান; তখন তারা আনন্দিত হয়।’ (সুরা রোম : ৩৮)
যেখানে-সেখানে, উন্মুক্ত স্থানে ময়লা-আবর্জনা, কফ, থুতু ও মলত্যাগে পরিবেশ দূষিত হয়ে স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করে। নোংরা ও দূষণযুক্ত পরিবেশ রোগব্যাধির প্রধান কারণ। তাই এসব দূষণযুক্ত পরিবেশের কবল থেকে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখলে মারাত্মক ও সংক্রামক রোগব্যাধি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে এসব নোংরা পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখার ওপরই নির্ভর করে জনস্বাস্থ্যের সফলতা। তাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষা ও দূষণ প্রতিরোধে সবার যথোচিত দায়িত্ব পালন করা উচিত। যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা নিক্ষেপ ও রুচিহীনতা পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ। অথচ ইসলাম এটাকে নিষিদ্ধ করেছে। সুস্থতা, সৌন্দর্য, মননশীলতা, উৎকর্ষ ও সমৃদ্ধির কথা বলে ইসলাম। সুতরাং ময়লা-আবর্জনা দিয়ে পরিবেশ দূষিত করা ঠিক নয়। নবী (সা.) সাবধান করে বলেছেন—‘তোমরা তোমাদের আঙিনাকে পরিচ্ছন্ন রাখো।’ (তিরমিজি : ২৭৯৯)। পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতার ব্যাপারে রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইমানের অঙ্গ।’ (মুসলিম : ২২৩)
সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য চাই সুস্থ মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ। অনুকূল ও সুন্দর পরিবেশ ছাড়া কোনো জীবের অস্তিত্ব দীর্ঘ হতে পারে না। বনভূমি ও বন্য পশুপাখি আল্লাহতায়ালার দান ও প্রকৃতির শোভাবর্ধক। রাসুল (সা.) প্রকৃতি-পরিবেশ সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশেষভাবে দিকনির্দেশনা আরোপ করেছেন। তাই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থ-সুন্দর জীবনযাপনের জন্য অবশ্যই ইসলামের আলোকে পরিবেশ সংরক্ষণে বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন করা বাঞ্ছনীয়। পরিবেশ সংরক্ষণ ও তাপমাত্রা কমানোর জন্য বন-জঙ্গল ও গাছপালা অতীব প্রয়োজনীয়, যা মানুষ নির্বিচারে ধ্বংসে মেতেছে। অথচ প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে ইসলামের আরেকটি মৌলিক নীতি হলো, প্রকৃতির অন্যান্য সৃষ্টির কোনোরূপ ধ্বংস, বিনাশ, অপচয় বা অপব্যবহার করা যাবে না। প্রত্যেকটি সৃষ্টি কোনো না কোনোভাবে মানুষ অথবা অন্য কোনো সৃষ্টিকে সেবাদান করে। পরিবেশ ধ্বংসের যে কোনো ধরনের উদ্যোগ বা চেষ্টা মানুষসহ অন্যান্য সৃষ্টিকে আল্লাহ প্রদত্ত সেবা থেকে বঞ্চিত করার শামিল। বিনা প্রয়োজনে অযৌক্তিকভাবে কোনো সেবা থেকে বঞ্চিত করার কোনো নৈতিক অধিকার মানবজাতিকে প্রদান করা হয়নি। প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয়, বিনাশ অথবা অপরিমিত ব্যবহার কোনোটিই ইসলামের দৃষ্টিতে সমর্থনযোগ্য নয়। ইসলাম পরিবেশ সংকটের অবসান প্রত্যাশা করে।
পরিবেশ ও প্রকৃতির বিপর্যয় রোধে বৃক্ষকর্তনের পরিবর্তে বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন জরুরি। ইসলাম বৃক্ষরোপণে বিপুলভাবে উৎসাহিত করে। যদি জানা যায় যে আগামীকাল কেয়ামত, তথাপিও আজ যদি কারও হাতে কোনো বীজ বা চারাগাছ থাকে, তবে তা বপন করে দিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ কতিপয় বনখেকো মানুষ যে কী পরিমাণে বনভূমি উজাড় করেছেন, তার হিসাব করলে উদ্বিগ্ন হতে হয়। এমনকি এসব কাজে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরও জড়িত থাকার খবর শোনা যায়। অথচ অনর্থক গাছ কাটা ও বন উজাড় করাকে ইসলামে শরিয়ত গর্হিত কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রাস্তাঘাটে বা মাঠে-ময়দানে যেসব বৃক্ষমালা ছায়া দেয়, যেখানে মানুষ বা পশু বিশ্রাম নেয়, এমন গাছকে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেটে ফেলা অত্যন্ত জঘন্য অপকর্ম। যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে তার কোনো ফায়দা ছাড়া গাছ নিধন করেছে, যার নিচে পথিক ও পশু আশ্রয় নেয়, তার শাস্তি সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে অকারণে একটি কুলগাছও কেটেছে, তাকে আল্লাহ মাথা নিচু করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।’ (আবু দাউদ)
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষ গাছ থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং সেই অক্সিজেনে বেঁচে থাকে। তেমনি প্রশ্বাসের সঙ্গে মানুষ যে কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করে তা গ্রহণ করে গাছ বেঁচে থাকে। এজন্য পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গাছ অপরিহার্য। গাছ আল্লাহতায়ালার গুণগান করে। তার ধ্যানে সর্বদা মত্ত থাকে, সিজদা করে। পরিপূর্ণভাবে প্রভুর হুকুম মেনে চলে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তুমি কি দেখো না, আল্লাহকে সিজদা করে যা কিছু আকাশমণ্ডলীতে ও পৃথিবীতে, সূর্য, চন্দ্র নক্ষত্রমণ্ডলী, পর্বতরাজি ও বৃক্ষলতা, জীবজন্তু ও মানুষের মধ্যে অনেকে।’ ইসলামের দৃষ্টিতে গাছ লাগানোকে ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যদি কোনো মুসলিম বৃক্ষ রোপণ করে অথবা ক্ষেতে ফসল বোনে, মানুষ কিংবা চতুষ্পদ প্রাণী খায়, তাহলে তা তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে।’ (বোখারি : ২৩২০)। কোনো ব্যক্তির লালন-পালনে বেড়ে ওঠা বৃক্ষ থেকে কেউ উপকৃত হলে তার সওয়াব ওই ব্যক্তির আমলনামায় লেখা হবে। লোকটি মারা গেলেও এর সওয়াব সে পাবে। নবীজি (সা.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি বৃক্ষরোপণ করে তা ফলদার হওয়া পর্যন্ত তার পরিচর্যা ও সংরক্ষণে ধৈর্য ধারণ করে, তার প্রতিটি ফল যা নষ্ট হয়, তার বিনিময়ে আল্লাহ পাক তাকে সদকার নেকি দেবেন।’ (মুসনদে আহমদ : ১৬৭০২)।
আসলে পরিবেশ নির্দিষ্ট কোনো দেশ বা জাতির সম্পদ নয়, পরিবেশ সবার সম্পদ এবং এর বিপর্যয় নির্দিষ্ট কোনো এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং মানবজাতির বিপর্যয় হিসেবে গণ্য হয়। তাই পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। তা না হলে মানুষকে হাশরের ময়দানে আল্লাহর দরবারে আসামির কাঠগড়ায় জবাবদিহির জন্য দাঁড়াতে হবে। আগামী প্রজন্মের জন্য দূষণমুক্ত পরিবেশ গঠনে বিশ্বব্যাপী পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, দাবদাহ ও তাপপ্রবাহ থেকে বাঁচতে হলে প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষরোপণ ও সবুজ বনায়ন করা প্রয়োজন। তাই দেশের মানুষের উচিত যে কাজে জাতির ক্ষতি হয়, দেশের সর্বনাশ হয়, তা থেকে অবশ্যই বিরত থাকা। মানুষের অন্যায় অপকর্ম থেকে ফিরে এসে পৃথিবীকে বিপদমুক্ত ও নিরাপদ পরিবেশ বজায় রাখা একান্ত প্রয়োজন।
লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ
০৩ মে, ২০২৪