ফায়ার সার্ভিসের দাবি / সীতাকুণ্ড ও মিরসরাইয়ের পর্যটন স্পট যেন মৃত্যুকূপ
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও মিরসরাইয়ে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেছে একাধিক ঝরনা। এর সঙ্গে সীতাকুণ্ড উপকূলে রয়েছে সমুদ্রসৈকত। অনেকে একা, বন্ধু-বান্ধব কিংবা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেড়াতে আসেন পর্যটন স্পটগুলোতে। কিন্তু প্রকৃতির রূপ উপভোগ করতে এসে কেউ কেউ ফিরছেন দুর্ঘটনার বিষাদ অভিজ্ঞতা নিয়ে। কেউ কেউ পাড়ি দিচ্ছেন না ফেরার জগতে। পর্যটন স্পটগুলো পরিণত হয়েছে মৃত্যুকূপে। মিরসরাইয়ের পর্যটন কেন্দ্রে গত ৬ বছরে ১৬ পর্যটক মারা গেছেন। আর সীতাকুণ্ডে চলতি বছরই প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচ পর্যটক। অথচ পর্যটকের সুরক্ষায় তেমন ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। ফায়ার সার্ভিস বলছে, স্পটের বিপজ্জনক স্থানগুলো সম্পর্কে পর্যটকদের না জানা ও খামখেয়ালিপনায় ঘটছে এসব দুর্ঘটনা। জানা গেছে, মিরসরাই ও সীতাকুণ্ডের খইয়াছড়া, নাপিত্তাছড়া, সহস্রধারা, সুপ্তধারা, বাড়বকুণ্ড ঝরনা, বাওয়াছড়া, রূপসী, ঝরঝরি, বোয়ালিয়া, হরিণাকুণ্ড ও সোনাইছড়ি ঝরনা নজর কেড়েছে ভ্রমণপিপাসুদের। সেইসঙ্গে মিরসরাইয়ের মহামায়া লেক, সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া এবং গুলিয়াখালী সমুদ্রসৈকতে প্রতিনিয়ত ভিড় করেন ভ্রমণপিপাসুরা। কিন্তু এসব স্থানে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। আনন্দ করতে এসে লাশ হয়ে ফিরতে হচ্ছে অনেককে। পর্যটকরা বলছেন, স্পটগুলোর ইজারাদাররা এসব মৃত্যুর দায় এড়াতে পারেন না। ইজারাদাররা শুধু কাউন্টার থেকে টিকিট দেন; কিন্তু রাস্তাঘাটের তেমন কোনো সংস্কার করেন না। যেসব স্থান ঝুঁকিপূর্ণ সেসব স্থানে সচেতনতা কিংবা নিষেধ করতে ইজারাদারদের কোনো লোক থাকে না। স্পটগুলোতে পর্যটকরা কেন মারা যাচ্ছে—এ বিষয়ে মিরসরাই ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার ইমাম হোসেন পাটোয়ারী বলেন, বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে পর্যটকদের অসাবধানতার কারণে। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে ভারি বৃষ্টি হলে। বিপজ্জনক স্থানে উঠতে গিয়েই বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে। এসব বিপজ্জনক স্থান চিহ্নিত করে ব্যানার বা চিহ্ন দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল, কিছু স্থানে বাস্তবায়ন করা হলেও বেশিরভাগ স্থানে এখনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, মিরসরাইয়ে গত ৬ বছরে বিভিন্ন পর্যটন স্পটে মারা গেছেন কমপক্ষে ১৬ জন। আহত হয়েছেন শতাধিক। এর মধ্যে গত ২ জুলাই বড় কমলদহ রূপসী ঝরনার কূপে ডুবে মারা গেছেন দুই বন্ধু। এর আগে ২০২২ সালের ১৯ জুন নাপিত্তাছড়া ঝরনায় তৌফিক আহম্মেদ তারেক, মাসুদ আহম্মেদ তানভীর, ইশতিয়াকুর রহমানসহ তিনজন নিখোঁজ হন। ২০ জুন দুজনের ও ২১ জুন আরেকজনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ২০২০ ও ২০২১ সালে দুই বছরে করোনা মহামারির কারণে ঝরনাগুলোতে পর্যটকের যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। এর আগে ২০১৯ সালে মহামায়া লেক ও ঝরনায় মারা যান ছয়জন, ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর নাপিত্তাছরা ঝরনায় সাঁতার কাটার সময় চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর শিক্ষার্থী শাহাদাত হোসেন মামুন মারা যান। পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উত্তর বিভাগের মিরসরাই রেঞ্জ কর্মকর্তা শাহানশাহ নওশাদ বলেন, পর্যটন কেন্দ্রের বিপজ্জনক স্থান চিহ্নিত করে ব্যানার লাগানোর পরও সেগুলোকে পাত্তা না দিয়ে পর্যটকরা সেখানে চলে যান। টিকিট দেওয়ার সময় বিপজ্জনক স্থানগুলোতে না যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়। পর্যটকদের গাইড নিয়ে এসব স্থানে যেতে পরামর্শ দেওয়া হয়; কিন্তু পর্যটকরা উদাসীন থাকেন। তিনি আরও বলেন, রূপসী ঝরনার উপরের কূপটি আলাদা। এর উপরের সব ঝরনার পানি প্রবল বেগে এ কূপে এসে পড়ে। এর গভীরতাও অনেক। অনেকে এ কূপের গভীরতা ও আকার না জেনে লাফ দেয়। অন্যদিকে চলতি বছরে সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন পর্যটন স্পটে মারা গেছেন পাঁচ পর্যটক। গতকাল বুধবার বাঁশবাড়িয়া ঝরনায় ঘুরতে আসা এ কে এম নাইমুল হাসান নামে এক পর্যটক পানিতে ডুবে মারা যান। এর আগে ২৮ আগস্ট পাহাড়ি ঝরনা এলাকা থেকে সোহানুর রহমান নামে একজনের লাশ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ২৪ জুলাই বাঁশবাড়িয়া এলাকায় আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী সাগরে ডুবে মারা যান। গত ৫ জুলাই গুলিয়াখালী বিচে স্কুলছাত্র মেহেদী হাসান সাগরে নেমে মারা যান। সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা নুরুল আলম দুলাল কালবেলাকে বলেন, সাঁতার না জানা অনেকেই আসছেন সাগর এলাকার স্পটগুলোতে। এ কারণে মারা যাচ্ছে বেশি। এ ছাড়া পর্যটন এলাকাগুলোর ইজারাদারদেরও যথেষ্ট গাফিলতি রয়েছে। তারা সরকারি কোনো নির্দেশনা মানছেন না। পর্যটকদের লাইফ জ্যাকেটসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম সরবরাহ করার কথা থাকলেও তারা তা দিচ্ছেন না। পর্যটন এলাকাগুলোতে নেই ট্যুরিস্ট পুলিশ। চট্টগ্রাম উত্তর বিভাগের বারৈয়ারঢালা রেঞ্জ কর্মকর্তা এ কে এম আলতাফ হোসেন কালবেলাকে বলেন, কেন্দ্রগুলো ইজারা নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু নীতিমালা আছে পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়ে। কিন্তু ইজারাদারা তা মানছেন না। সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কে এম রফিকুল ইসলাম বলেন, স্পটগুলোতে পর্যটকদের নিরাপত্তায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। সাগর উপকূল ও ঝরনাগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ স্পট চিহ্নিত করে বিশেষ নজরদারিতে আনা হবে। ইজারাদাররা আইন না মানলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সহস্রধারা ঝরনার ইজারাদার এ এইচ এন্টারপ্রাইজের পরিচালক নাজমুল হাসান পিন্টু বলেন, বলব না পর্যটকদের শতভাগ নিরাপত্তা দিয়ে থাকি; কিন্তু সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। পর্যটকদের অনুরোধ করা হয় ট্যুরিস্ট গাইড সঙ্গে নিতে; কিন্তু অধিকাংশ পর্যটক সেটি নিতে চান না। আমাদের এখানে নিরাপত্তার জন্য লাইফ জ্যাকেট রাখা হয়েছে। এ ছাড়া আমরা এক বছরের জন্য মাত্র ইজারা পাই। ইজারা যদি দীর্ঘ সময়ের জন্য দেওয়া হতো, তাহলে নিরাপত্তার বিষয়ে আমরা আরও বিনিয়োগ করতে পারতাম।
০৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
X