স্বীকৃতি ছাড়াই বিদায় নিলেন বীরাঙ্গনা হাসিনা বানু
চিরবিদায় নিলেন পথে পথে ঘুরে বেড়ানো সেই চেনা-জানা ও প্রিয় মুখ বীরাঙ্গনা হাসিনা বানু ওরফে ইদু মাস্টারনি (৮৭)। মানসিক ভারসাম্যহীন এই মানুষটিকে চেনে না দিনাজপুর শহরে এমন মানুষ মেলা ভার। জন্ম সনদ ও এনআইডি না থাকায় মেলেনি কোনো প্রকার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। কিন্তু মৃত্যুতেও মিলল না রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি। দিনাজপুর শহরের পাক পাহাড়পুর মহল্লার ভাগিনা মনোয়ার আলী মানুর বাসায় দীর্ঘ এক মাস বিছানায় শয্যাশায়ী থাকার পরম গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাদ আসর জানাজা শেষে শেখ ফরিদপুর গোরস্তানে তাকে দাফন করা হয়। একমাত্র ছেলে মাহাবুব আলী স্বপন (৬৩) ঢাকা থেকে আসতে না পারায় জানাজা ও দাফনে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। তিনি মোবাইল ফোনে জানান, তার মা ২০২২ সালে সদর উপজেলায় একটি বাড়ির জন্য আবেদন করেছিলেন; কিন্তু কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। অবহেলায় অযত্নে তার মা এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। একাত্তরে সর্বস্ব হারানো এ শিক্ষিকা সবার কাছে ইদু মাস্টারনি বলে পরিচিত।
১৩ মার্চ, ২০২৪

জগন্নাথপুরের যুদ্ধাহত মনমোহিনী বীরাঙ্গনা স্বীকৃতি পাননি আজও
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে মুক্তিযুদ্ধের সময় গুলিতে আহত মনমোহিনী বিশ্বাস (৮৫) স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি পাননি। জীবনবাজি রেখেও পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে নিজের বাবা-মাকে রক্ষা করতে পারেননি মনমোহিনী বিশ্বাস। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মনমোহিনীর বাবা-মাকে গুলি করে হত্যা করে। বাবা-মাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেও গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন মনমোহিনী। এখন ও বুকে গুলির চিহ্ন রয়েছে। গুলি বুকে নিয়ে আজও মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পাওয়ার প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি না পাওয়া মনমোহিনী বিশ্বাস সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার পাইলগাঁও ইউনিয়নের হাড়গ্রাম গ্রামের বাসিন্দা।  একাত্তরে তার পিতা হরকুমার বিশ্বাস ও মাতা প্রফুল্ল বিশ্বাসকে স্থানীয় রাজাকারের সহযোগিতায় পাকবাহিনী গুলি করে হত্যা করে। তখন মনমোহিনীর বুকে গুলি লাগলে তিনিও আহত হন। স্হানীয় রাজাকাররা তাদের বাড়ি ও দখল করে নিয়ে যায়। মনমোহিনী বিশ্বাস স্বীকৃতি লাভের জন্য প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় বরাবরে লিখিত আবেদন দিয়ে আজও কোনো ফল পাননি। স্বাধীনতার ৫২ বছরেও মনমোহিনী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ও সম্মান না পাওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন এলাকার অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা। দীর্ঘদিন ধরে অনেক চেষ্টা-তদবির করেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় তার নাম লিপিবদ্ধ করা যায়নি। তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় তিনি বঞ্চিত রয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকেও। জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মুক্তিবাহিনীকে রান্না করে খাওয়ানো ও সহযোগিতা করার কারণে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় মনমোহিনীর বাবা-মাকে ভোররাতে গুলি করে হত্যা করা হয়। গুলিতে আহত হন মনমোহিনী নিজেও। স্থানীয় রাজাকাররা তাদের পরিবারের বাকি লোকদের হুমকি দিয়ে বাড়িঘর ছেড়ে চলে যেতে বলে। তারা ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে চলে যান। ফলে তাদের বাড়িঘর স্থানীয় রাজাকাররা দখল করে নেয়। মনমোহিনী আজও তার পরিবারের লোকজন নিয়ে পরের বাড়িতে থাকেন। নিজ গ্রামের মানুষসহ উপজেলার অন্য বীর মুক্তিযোদ্ধারা মনমোহিনী বিশ্বাসকে বীরাঙ্গনা বলে ডাকলেও কাগজে-কলমে তার স্বীকৃতি মেলেনি স্বাধীনতার ৫২ বছরেও। ৮৫ বছর বয়সী মনমোহিনী বিশ্বাস অলস সময়ে ঝাপসা চোখে এখন শুধু মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রোমন্থন করেন। তিনি মৃত্যুর আগে নিজের বীরাঙ্গনা স্বীকৃতি দেখে যেতে চান। জগন্নাথপুর উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল কাইয়ুম বলেন, হাড় গ্রামে পাকবাহিনী ভোররাতে হরকুমার বিশ্বাস ও প্রফুল্ল বিশ্বাসকে গুলি করে হত্যা করে। তাদের মেয়ে মনমোহিনী বিশ্বাসও গুলিবিদ্ধ হন। তাকে সরকার থেকে স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে। জগন্নাথপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম বলেন, মনমোহিনীর ঘটনা শুনে আজও কান্না আসে। তার বাবা-মাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তাকে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি দেওয়া উচিত আমি মনে করি। বীর মুক্তিযোদ্ধা রসরাজ বৈদ্য বলেন, মনমোহিনী বিশ্বাসের আরও আগে স্বীকৃতি পাওয়া উচিত ছিল। না পাওয়াটা দুঃখজনক। হাড় গ্রামের গোবিন্দ বিশ্বাস বলেন, আমার পাশের বাড়ির ঘটনা এটি। সেদিন মনমোহিনীর বাবা-মাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় মনমোহিনীও গুলিবিদ্ধ হন। অথচ সরকার থেকে আজ পর্যন্ত কোনো স্বীকৃতি পাননি তিনি। মনমোহিনী বিশ্বাসের ছেলে গোপাল বিশ্বাস বলেন, আমার মা মনমোহিনী বিশ্বাস মৃত্যুর আগে স্বীকৃতিটুকু দেখে যেতে চান।   মনমোহিনী বিশ্বাস বলেন, আমার বাবা-মাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আমিও গুলিবিদ্ধ হই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার আকুল আবেদন- আমার বয়স এখন ৮৫ বছর আর এই শেষ বয়সে ও মৃত্যুর আগে  আমি বীরাঙ্গনা স্বীকৃতি দেখে যেতে চাই। জগন্নাথপুর উপজেলার সচেতন নাগরিকরা বলছেন, যা প্রমাণাদি রয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই যে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া এখন মনমোহিনী বিশ্বাসের অধিকার। পাইলগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মকলেছর রহমান বলেন, আমার ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে। মনমোহিনী বিশ্বাস গুলি লেগে আহত হন। তিনি স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য।
০৭ ডিসেম্বর, ২০২৩
X