বৈদেশিক ঋণ বড় সংকট তৈরি করবে
বাংলাদেশের ঋণ ও পরিশোধের বাধ্যবাধকতা বাড়ছে। এ কারণে সরকার ক্রমাগত নতুন ঋণ নিতে বাধ্য করছে, যা আগামী দিনে বড় ধরনের সংকট তৈরি করবে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদ অর্খাৎ রাজস্ব আদায় বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে বলে জানিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে ‘বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ও ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা’ বিষয়ক আলোচনা সভায় তিনি এ তথ্য তুলে ধরেন। সিপিডি এবং দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এ সভার আয়োজন করে। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনের সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আসা রাজস্ব দিয়ে উন্নয়ন খরচের জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি ঋণ করেও ঋণ পরিশোধ করা হচ্ছে। কারণ, সরকার রাজস্ব বাজেটের যে হিসাব দেয়, তাতে শুধু সুদ বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেখানে ঋণের আসল পরিশোধ বাবদ বরাদ্দ থাকে না। এর অর্থ ঋণের বড় অংশ আমরা ঋণ করে পরিশোধ করছি। ২০২৩ সালের জুনে বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি বিদেশি ঋণ ছিল ৯৮ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, যা একই বছরের সেপ্টেম্বরে ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। বর্তমানে বিদেশি ঋণ-জিডিপি অনুপাত ২১ দশমিক ৬ শতাংশ তুলনামূলকভাবে বেশি নয়। তবে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঋণ পোর্টফোলিওর গঠন দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। রেয়াতি ঋণের অনুপাত কমছে, অন্যদিকে বাজারভিত্তিক ঋণের অংশ বাড়ছে। ঋণের শর্তাবলিও কঠোর হচ্ছে। বিশেষ করে জিডিপি, রাজস্ব আয়, রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সঙ্গে তুলনা করলে বৈদেশিক ঋণ ও ঋণ পরিশোধের দায়বদ্ধতা খুবই উদ্বেগের। কারণ বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম। তাই অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অভ্যন্তরীণ সম্পদের একটি ক্রমবর্ধমান অংশ দেশি ও বিদেশি ঋণের মূল ও সুদ পরিশোধে ব্যবহার হচ্ছে। অনুষ্ঠানে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বিদেশি ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে প্রতারণামূলক বাস্তবতার মধ্যে আছি। ঋণ নিয়ে অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নে এর প্রতিফলন নেই। শিক্ষা খাতে এখনো জিডিপির ২ শতাংশ এবং স্বাস্থ্য খাতে এক শতাংশের বেশি বিনিয়োগ বাড়াতে পারিনি। ঋণ নিয়ে এত প্রকল্প বাস্তবায়ন করার পরও সাধারণ মানুষ সুবিধা পাচ্ছে না। সম্প্রতি প্রকাশিত স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকসে বলা হয়েছে, মানুষের গড় আয়ু কমেছে, মৃত্যু হার বেড়েছে। আবার বেকারের সংখ্যাও বেড়েছে। ২৫ শতাংশ পরিবারকে ঋণ করে চলতে হয়। ভিন্ন চিত্র রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ব্যাংকের টাকা ফেরত দেওয়া হয় না। শেয়ারবাজারের মাধ্যমে মধ্যবিত্তের টাকা লুট হয়েছে। মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে একটি গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। মেগা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিরা বিদেশে টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। সিপিডির চেয়ারম্যান ও প্রবীণ অর্থনীবিদ প্রফেসর রেহমান সোবহান বলেন, দেশের মেগা অবকাঠামো প্রকল্পগুলো বিদেশি ঋণে করা হচ্ছে। এসব প্রকল্পে প্রয়োজনের চেয়ে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি ব্যয় হচ্ছে। এখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, প্রকল্পের খরচ বৃদ্ধি এবং ব্যবস্থাপনা বড় ইস্যু হয়ে যায়। তিনি বলেন, শ্রীলংকা স্বল্পকালীন ঋণের ফাঁদে পড়েছিল। রফতানি কমে আসায় এসব ঋণ যথাযথভাবে পরিশোধ করতে পারেনি দেশটি। আফ্রিকার কিছু দেশেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ এর চেয়ে অনেক ভালো অবস্থানে আছে। তবে, দেশে স্বল্পমেয়াদি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। তাই রফতানি বৃদ্ধি এবং বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ড. মশিউর রহমান বলেন, টাকার অবমূল্যায়ন ও মূল্যস্ফীতির বিষয়টাও গুরুত্বপূর্ণ। এক্সচেঞ্জ রেটটা শুধু আমাদের দেশে নয়, সব দেশেই হয়েছে। সাম্যবস্থায় যে এক্সচেঞ্জ রেট থাকা উচিত, সেখানে টাকাকে না রেখে আমরা অতিমূল্যায়িত করেছি। তিনি বলেন, ১০ টাকা বিনিয়োগ করে যদি এখন ১১ টাকার উৎপাদন করতে পারি, তাহলে সেটাকে এখন সাড়ে ১১ টাকায় বা ১২ টাকায় ওঠানোর চেষ্টা করতে হবে। সেজন্য বিনিয়োগও দরকার। শুধু ডেপ্রিসিয়েশন (টাকার অবমূল্যায়ন) দিয়ে রপ্তানি বাড়ানো যাবে না। সঙ্গে উৎপাদন সক্ষমতা ও বিনিয়োগও বাড়াতে হবে। যতদিন পর্যন্ত আমাদের অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ না বাড়ে, ততদিন পর্যন্ত বিদেশি ঋণ ও সহায়তার প্রয়োজন পড়বে। এগুলোর কোনোটিই খারাপ নয়। তবে এগুলো কোথায় যাচ্ছে, কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, কোন প্রকল্প করা হচ্ছে, সেই প্রকল্পের মান কী, সেগুলো বিবেচনার বিষয়। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, ড. সালেহউদ্দিন আহমেদসহ সংশ্লিষ্টরা বক্তব্য দেন।
০৫ এপ্রিল, ২০২৪

অতিরিক্ত বৈদেশিক ঋণ ও পুঁজিপাচার অর্থনীতিকে বিপদে ফেলেছে
নানাবিধ খামখেয়ালি প্রকল্পে যথাযথ ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’ ছাড়া বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের কারণে বাংলাদেশ অতি দ্রুত ‘উচ্চ ঋণগ্রস্ত দেশের কাতারে’ প্রবেশ করেছে। খবরে প্রকাশ, ২০২৩ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এর মানে সরকারি-বেসরকারি বিদেশি ঋণের বর্তমান স্থিতি দেশের মোট জিডিপির প্রায় ২৩ শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শেষে সরকারি-বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৪১ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। ওই পর্যায়ে বিদেশি ঋণ ছিল জিডিপির ১৫.৫ শতাংশ। ওই সময় বৈদেশিক ঋণের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯.৭ শতাংশ। এরপর থেকে বিদেশি ঋণ-গ্রহণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে উচ্চহারে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে ১৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরেও বৈদেশিক ঋণের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৬.৯ শতাংশ। সরকারি ঋণের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও এরপর দ্রুত বিদেশি ঋণ বাড়তে থাকে, পাঁচ বছরে বেসরকারি খাতের ঋণ ১২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ২৫ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছায়। ২০২৩ সালের জুনে বেসরকারি বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ২২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। উপরে বৈদেশিক ঋণের যে চিত্র দেওয়া হয়েছে সেটা বাংলাদেশ ব্যাংকের এতদ্সংক্রান্ত প্রক্ষেপণ ২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ছাড়িয়ে গেছে, কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘সর্বোচ্চ উচ্চাভিলাষী’ প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০২৩ সালের শেষে গিয়ে বৈদেশিক ঋণ হওয়ার কথা ছিল ৮১ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে তাদের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ৬৫ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২৩ সালের শেষে রক্ষণশীল হিসাবে ৬৭ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার, স্বাভাবিক হিসাবে ৭৬ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার এবং উচ্চাভিলাষী হিসেবে সর্বোচ্চ ৮১ বিলিয়ন ডলার হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল। এই প্রক্ষেপণ কতখানি সরলীকরণ ছিল সেটা সত্যিকার বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের পরিমাণ প্রমাণ করে দিয়েছে। তিন বছরের মধ্যেই বিদেশি ঋণকে ১০০ বিলিয়ন ডলারে উল্লম্ফন করানো হয়েছে। অর্থনীতি বিপদে পড়বে যখন ২০২৫ সাল থেকে এই ঋণগুলোর সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়ে যাবে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সরকারি প্রশাসন খাতে ব্যয়-বরাদ্দের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ ব্যয়-বরাদ্দ রাখতে হয়েছিল সরকারি ঋণের সুদ পরিশোধ খাতে, মোট ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঋণের সুদ পরিশোধ খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয়েছে ৯৪,০০০ কোটি টাকা। শুধু বৈদেশিক ঋণের সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ ২০২২-২৩ অর্থবছরের ২ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে হয়তো ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের এই উচ্চপ্রবৃদ্ধি ২০২৯ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। আরও দুঃখজনক হলো, এসব ঋণের অর্থে চলমান প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন যখন সম্পন্ন হবে তখন প্রকল্পগুলোর আয় থেকে ঋণের কিস্তির অতি সামান্য অংশ পরিশোধ করা সম্ভব হবে। বাকি অর্থ জনগণের ওপর দীর্ঘমেয়াদি বোঝা হিসেবে চেপে বসবে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ কিংবা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে এখনো ‘সফট লোন’ পাওয়া গেলে আমরা নিতে আগ্রহী হই, কিন্তু আমাদের বৈদেশিক ঋণের সিংহভাগই এখন ‘সাস্পায়ারস ক্রেডিট’। সাস্পায়ারস ক্রেডিটের অসুবিধে হলো জোগানদাতারা প্রকল্পের প্ল্যান্ট, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ঋণ হিসেবে দেওয়ার সময় প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজার দামের চাইতে অনেক বেশি দাম ধরে ঋণের পরিমাণকে বাড়িয়ে দেয়। উপরন্তু, সাপ্লায়ারস ক্রেডিটের সুদের হারও সফট লোনের সুদের হারের চাইতে বেশি, ঋণ পরিশোধের সময়সীমাও কম থাকে। আরও গুরুতর হলো, সাপ্লায়ারস ক্রেডিটে রাজনীতিবিদ, ঠিকাদার ব্যবসায়ী ও আমলাদের ‘মার্জিনের হার’ অনেক বেশি হয়ে থাকে।  চীন যেহেতু এখন তাদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উদারভাবে সাপ্লায়ারস ক্রেডিট দেওয়ার নীতি বাস্তবায়ন করছে তাই চীনের সাপ্লায়ারস ক্রেডিট পাওয়া অনেক সহজ হয়েছে। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত চীন থেকে মোট ১,৮৫৪ কোটি ডলার ঋণ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে গত দশ বছরে বাংলাদেশ চীন থেকে সাপ্লায়ারস ক্রেডিট নিয়ে মোট ১২টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে। চীনা সাপ্লায়ারস ক্রেডিটে যেসব মেগা-প্রকল্প এদেশে বাস্তবায়িত হয়েছে বা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে সেগুলো হলো পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-যশোর-পায়রা রেলপথ প্রকল্প, কর্নফুলী টানেল প্রকল্প এবং ঢাকা-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্প। জাপানের জাইকার সাপ্লায়ারস ক্রেডিটে অর্থায়িত যেসব মেগা-প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে বা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে সেগুলো হলো ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ি কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল, যমুনা রেলসেতু এবং চট্টগ্রাম আউটার রিং রোড। ঢাকা-যশোর রেলপথ এবং ঢাকা-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্প নিঃসন্দেহে নিকৃষ্ট প্রকল্প। কিন্তু, বাংলাদেশের নিকৃষ্টতম ‘সাপ্লায়ারস ক্রেডিট প্রকল্প’ ১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণে নির্মীয়মাণ রূপপুর প্রমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। এটি আন্তরিকভাবেই ‘সাদা হাতি প্রকল্প’। দুই ইউনিটের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের প্রাক্কলিত ব্যয় হবে ১৩৫০ কোটি ডলার। ইউনিট দুটোর কাজ শেষ হতে সময় লাগবে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। এই দুটো ইউনিট থেকে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রাক্কলিত নির্মাণ ব্যয় ১৩৫০ কোটি ডলারের মধ্যে ১২০০ কোটি ডলার ঋণ দেবে রাশিয়া, বাকি দেড়শ কোটি ডলার বাংলাদেশ ব্যয় করবে। রাশিয়ার ঋণের সুদের হার হবে ৪ শতাংশ, যা ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ২৮ বছরে বাংলাদেশকে সুদাসলে পরিশোধ করতে হবে। অনেকেরই জানা নেই, মাত্র ৬ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণে ভারতের তামিলনাড়ুর কুদান কুলামে ২০০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপিত হয়েছে কয়েক বছর আগে। অথচ, আমাদের ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের জন্য ১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণ নিতে হচ্ছে কেন? এত বেশি ‘ইনফ্লেটেড প্রজেক্ট কস্ট’ দেখিয়ে রাশিয়া কি বাংলাদেশের বন্ধুর পরিচয় দিয়েছে? বাংলাদেশ সরকারের কর্তাব্যক্তিদের উচ্চ-মার্জিন কি এর জন্য দায়ী? (অথচ, সৌরবিদ্যুতে রূপপুরের অর্ধেক খরচে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যেত)! স্বল্প-প্রয়োজনীয় প্রকল্পে যথাযথ ফিজিবিলিটি স্টাডি ছাড়া খামখেয়ালিভাবে বিনিয়োগের হিড়িকের ব্যাপারে আমি আপত্তি জানানোয় আমাকে ‘অর্বাচীন অর্থনীতিবিদ’ আখ্যা দিয়েছিল সরকারি দল। ২০২২ সালের মে মাসে জার্মান টিভি ডয়সে ভেলে আমাকে এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে বলায় আমি বলেছিলাম, ‘২০১২ সালে যখন বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বাতিল করেছিল তখন বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে আমিই প্রথম নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য সমর্থন জানিয়েছিলাম। আবার, বর্তমার সরকারের আমলে আমি ‘একুশে পদক’ নিয়েছি। এখন তারা আমাকে অর্বাচীন অর্থনীতিবিদ বলছেন! তা বলতেই পারেন, কিন্তু আমি আমার অবস্থান বদলাব না’। আমার এই সাবধান বাণীকে আমলে না নেওয়ার ফলে এখন যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দ্রুত পতনের ধারা আমাদের অর্থনীতিকে চরম টালমাটাল অবস্থায় নিয়ে গেছে তা সামাল দিতে পারছে না সরকার। দেশের ‘নিট রিজার্ভ’ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারেরও কম। রিজার্ভের এই পতনের ধারাকে অত্যন্ত বিপজ্জনক বলতেই হবে। কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গত দেড় বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের পতনকে থামাতে চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি, কারণ হুন্ডি ব্যবসা চাঙা হওয়ায় ফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে কর্তৃপক্ষ। গত আগস্টে ফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স আগের বছরের আগস্টের চাইতে ২১ শতাংশ কমে গেছে, সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছে ১৩৪ দশমিক ৩৬ কোটি ডলার, যা গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। নভেম্বরে রেমিট্যান্স ১৯৩ কোটি ডলারে পৌঁছালেও এই ধারা টেকসই হবে কি না বোঝা যাচ্ছে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিছুদিন আগে উচ্চকণ্ঠে বলেছেন রিজার্ভ নিয়ে দুঃশ্চিান্তার কিছুই নেই, আমাদের না কি  প্রায় ছয় মাসের আমদানি বিল পরিশোধের সক্ষমতা রয়েছে। এখন আইএমএফ বলছে, বাংলাদেশের রিজার্ভ প্রকৃতপক্ষে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত। দেশের এক কোটি পঞ্চান্ন লাখ মানুষ বিদেশে কর্মরত থাকলেও তাদের অধিকাংশই হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। ডলারের দাম নির্ধারণ বাজারের হাতে ছেড়ে দিলেই এই সমস্যার সমাধান মিলবে না, কারণ হুন্ডি ডলারের চাহিদা কাঠামো শক্তিশালী থাকলে বাজারে ডলারের দাম যতই থাকুক হুন্ডি পদ্ধতিতে ডলারের দাম তার চাইতে ৭/৮ টাকা বেশি পাওয়া যাবেই। দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচারকারিরাই এই হুন্ডি ডলারের চাহিদাকে শক্তিশালী রাখছে, যেজন্য দেশ থেকে বিদেশে পুঁজিপাচার এখন দেশের ‘এক নম্বর সমস্যায়’ পরিণত হয়েছে। সংখ্যায় দেশ থেকে পুঁজিপাচারকারী কয়েক হাজারের বেশি হবে না। বাংলাদেশি সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত, উচ্চ-বিত্তশালী ও ‘এলিট’ অংশে তাদের বেশিরভাগের অবস্থান। অর্থনৈতিক টানাপড়েনের কারণে তারা দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার করতে বাধ্য হচ্ছেন বলা যাবে না। এদেশে তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ‘এলিট’ গোষ্ঠীর মধ্যে অবস্থান সত্ত্বেও আরও বেশি সুখ-শান্তির আশায় তারা দেশত্যাগে উদ্যোগী হচ্ছেন। তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠই দুর্নীতিবাজ আমলা, ব্যবসায়ী-শিল্পপতি (উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গার্মেন্টস মালিক), প্রকৌশলী ও রাজনৈতিক নেতা। তাদের বেশিরভাগের বৈশিষ্ট্যগত ‘কমন ফ্যাক্টর’ হলো তাদের সিংহভাগ ‘কালো টাকার মালিক’, ভালোমানের শহুরে সম্পত্তির মালিক কিংবা শিল্প-কারখানা-ব্যবসায়ের মালিক হওয়ায় দেশের ব্যাংকঋণ পাওয়ার ক্ষমতা রাখেন। আমার সংবাদপত্রের কলামগুলোতে আমি তাদের ‘জাতির এক নম্বর দুশমন’ আখ্যায়িত করে চলেছি। আমি যাদের ‘জাতীয় দুশমন’ অভিহিত করছি তারা দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমকে অপব্যবহার করে ব্যাংকঋণ নিয়ে তা বছরের পর বছর ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচার করে চলেছে। তারা ব্যাংকগুলোর ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ হিসেবে ঋণ-লুটপাটকারীর ভূমিকা পালন করছে। তারা হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী। তারা ৫২ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ‘এক নম্বর সমস্যা’ দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের মাধ্যমে কালো টাকার মালিক হয়ে তাদের দুর্নীতি-লব্ধ ও লুণ্ঠনকৃত অর্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া কিংবা দুবাইয়ে পাচার করছে। এরাই কানাডার টরন্টোর বেগমপাড়া এবং মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম বানাচ্ছে। পুঁজিপাচারই অর্থনীতিকে টালমাটাল অবস্থায় নিয়ে গেছে। . লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি,  একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
১৯ ডিসেম্বর, ২০২৩
X