হানাদারমুক্ত বাংলাদেশে মুজিবনগর সরকার যেসব কাজ করেছিল
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের ছয় দিন পর (২২.১২.১৯৭১) মুজিবনগর সরকার ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত মুজিবনগর সরকারই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে। আলোচ্য প্রবন্ধে ১৭.১২.১৯৭১ থেকে ০৯.০১.১৯৭২ পর্যন্ত সময়কালে ওই সরকারের কার্যাবলি আলোচনা করা হয়েছে।  মুজিবনগর সরকার কেন ছয় দিন পর ঢাকায় আসে তার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। ঢাকায় তখন নিরাপত্তার আশঙ্কা ছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণের পূর্বে প্রায় ৬০/৭০ হাজার রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও বিহারিদের মধ্যে অস্ত্রশস্ত্র বিতরণ করেছিল। এদের চিহ্নিত করে নিবৃত্ত না করা পর্যন্ত ঢাকা শহর বিপদমুক্ত ছিল না। সে সময় ঢাকায় উপনীত ভারতীয় সামরিক কমান্ড কর্তৃক ঢাকা শহরের তথা বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিধান করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার ছিল।  তাছাড়া ১৬ ডিসেম্বর রাত থেকে ঢাকা শহরে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ পরিচয়ে অনেক যুবক চীনা একে৪৭ রাইফেল ও স্টেনগান হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তারা অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা ছিল না। পাকিস্তানি সৈন্য এবং সমর্থকদের ফেলে দেওয়া অস্ত্র এদের হাতে আসে।  ঢাকাবাসী এদের নাম দেয় ‘ষোড়শ বাহিনী’। এদের একটা অংশ মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের গাড়ি-বাড়ি, দোকানপাট ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি দখল করার কাজে ব্যস্ত হয়। সুযোগসন্ধানী ষোড়শ বাহিনীর (সিক্সটিনথ ডিভিশন নামেও পরিচিত) কার্যকলাপ কিছু কিছু মুক্তিযোদ্ধার মধ্যেও সংক্রমিত হয়। কে যে আসল মুক্তিযোদ্ধা, কে যে ষোড়শ বাহিনীর সদস্য তা শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। দল পরিবর্তনকারী রাজাকাররাও লুটপাটে অংশগ্রহণ করে। এমনি সময়ে ১৮ ডিসেম্বর রায়ের বাজারের কাটাসুর নামক ইটখোলায় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় দেশের প্রায় ২০০ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীর মৃতদেহ আবিষ্কৃত হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের প্রতি ক্রোধ, ঘৃণা ও প্রতিহিংসার সৃষ্টি হয়। ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটতে থাকে। এ সময় বিহারি অধ্যুষিত অঞ্চলের নিরাপত্তার দায়িত্বও ভারতীয় সেনাবাহিনীকে নিতে হয়। এসব বাস্তব সমস্যা ছাড়াও মুজিবনগর সরকার ভারত সরকারের সঙ্গে কিছু জরুরি বিষয়াদি আলোচনার জন্য কয়েকদিন কলকাতায় অবস্থানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রকে সচল করার মতো অর্থ, সম্পদ ও কারিগরি সহায়তার ব্যবস্থা না করে সরকারের ঢাকায় ফেরা সমীচীন ছিল না। মুজিবনগর সরকার ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সব প্রয়োজনীয় বিষয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে ও ভারতের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাভ করে। অবশেষে ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ মুজিবনগর সরকার ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করে। বিলম্বে ঢাকায় ফেরার কারণে মন্ত্রিসভা তীব্রভাবে সমালোচিত হয়।  ঢাকায় মুজিবনগর সরকারের দায়িত্ব  ১. মুজিবনগর সরকারের প্রধানতম দায়িত্ব ছিল বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনা;  ২. মুজিবনগর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হয় বেসামরিক প্রশাসনের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা;  ৩. গেরিলা যোদ্ধাদের নিরস্ত্রীকরণ করা; ৪. প্রায় এক লাখ ত্রিশ হাজার বিহারিকে নিরাপত্তা বিধান করা;  ৫. বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা;  ৬. আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করা;  ৭. যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন করা;  ৮. বিদেশি সাহায্য-সহায়তা লাভের ব্যবস্থা করা;  ৯. ভারতে অবস্থানগ্রহণকারী এক কোটি শরণার্থীকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।  মুজিবনগর সরকার ১৮ ডিসেম্বর মুখ্যসচিব রুহুল কুদ্দুসের নেতৃত্বে আটজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাকে ঢাকায় প্রেরণ করে। তারা হলেন— ১. মুখ্যসচিব : রুহুল কুদ্দুস;  ২. রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা : এ এফ এম এ ফতেহ;  ৩. সংস্থাপন সচিব : এম নূরুল কাদের;  ৪. পুলিশের মহাপরিচালক : এ খালেক;  ৫. সচিব, তথ্য ও বেতার : আনোয়ারুল হক খান;  ৬. সচিব, অর্থ :  এ কে জামান;  ৭. বেসামরিক বিমান চলাচল পরিচালক : উইং কমান্ডার মির্জা;  ৮. বন্দর, জাহাজ ও অভ্যন্তরীণ জলপথ পরিচালক :  কিউ এ বি এম রহমান। তারা ঢাকায় এসে গভর্নমেন্ট হাউসের নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেন বঙ্গভবন’। মিন্টো রোড ও হেয়ার রোডের সংযোগ স্থানে অবস্থিত স্টেট গেস্ট হাউসের নাম দেন ‘গণভবন’। পরে শেরেবাংলা নগরে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন নির্মাণ করে তার নাম দেওয়া হয় গণভবন এবং স্টেট গেস্ট হাউসের নাম হয় ‘সুগন্ধী’, যা বর্তমানে ‘ফরেন সার্ভিস ট্রেনিং একাডেমি’ নামে অভিহিত।  কলকাতায় মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী কার্যালয় চালু থাকে। মুজিবনগর সরকার ১৮ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠকে নিম্ন লিখিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে— (ক) বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো বিন্যস্ত করা ও সরকারি কর্মচারীদের পুনর্বিন্যাস করা;  (খ) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নামে অ্যাকাউন্ট খোলা;  (গ) কৃষি মন্ত্রণালয়ের বাজেট প্রণয়ন;  (ঘ) ঢাকা বেতার কেন্দ্র চালু করা;  (ঙ) ১৯ জেলায় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার নিয়োগ করা, সামরিক ও পুলিশবাহিনীর জন্য পোশাক নির্ধারণ;  (চ) গেরিলা বাহিনীর সদস্যদের মিলিশিয়া বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা;  (ছ) বাংলাদেশের জন্য পরবর্তী ১৫ দিনে প্রয়োজনীয় সামগ্রীর একটি তালিকা প্রণয়ন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিকট জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত (এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়); (জ) মাহবুব আলম চাষীকে পররাষ্ট্র সচিবের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় ও আবুল ফতেহকে নতুন পররাষ্ট্র সচিব নিয়োগ করা হয়।  মুজিবনগর সরকারের সদস্যরা ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর সকালে ভারতের সামরিক বিমান পরিবহনের সহায়তায় ঢাকায় ফিরে আসেন। সেদিন সরকারের কিছু নথিপত্র সঙ্গে আনা হয়। অবশিষ্ট নথিপত্র কয়েকজন কর্মচারীর হেফাজতে কলকাতার অস্থায়ী কার্যালয়ে রেখে আসা হয়। পরে সেগুলো ঢাকায় আনা হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ হেয়ার রোডে এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বঙ্গভবনে ওঠেন।  ২২ ডিসেম্বর বিমানবন্দরে ও ২৩ ডিসেম্বর ঢাকা সচিবালয়ে অফিসার ও কর্মচারীদের সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণা করেন যে সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই তিন মূল নীতির ওপর ভিত্তি করে দেশ পরিচালিত হবে। সমাবেশের বক্তৃতায় তিনি সরকারি প্রশাসনের সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করেন।  ২৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় স্বাধীন দেশের রাজধানী ঢাকায় সাবেক পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কেবিনেট রুমে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।   যেমন : (ক) রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলার প্রচলন ও মন্ত্রিসভার কার্যবিবরণী বাংলায় লেখা, সব সাইনবোর্ড, হোল্ডিং নম্বর, গাড়ির নম্বর ইত্যাদি বাংলায় লেখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়;  (খ) যেসব সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তান লেখা আছে তা অবিলম্বে পরিবর্তন করে ৫ বাংলাদেশ নাম প্রতিস্থাপন করা; স্টেট ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক নামে অভিহিত করা;  (গ) মুক্তি বাহিনীর সদস্যদের ‘জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনীতে আত্মীকরণের ব্যবস্থা করার জন্য ‘জাতীয় মিলিশিয়া বোর্ড’ গঠন করা;  (ঘ) শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে ঢাকায় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা, শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের আর্থিক সহযোগিতার জন্য শহিদ স্মৃতি ট্রাস্ট তহবিল গঠন, শহীদ মিনার পুনর্নির্মাণ প্রভৃতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়; (ঙ) মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের সম্মুখীন করার বিষয় আলোচিত হয় ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়;  (চ) জাতীয় কাউন্সিল গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়;  (ছ) বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়;  (জ) ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর যেসব পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে তা বাতিল করা ও সংক্ষিপ্ত এবং পরিবর্তিত সিলেবাসের ভিত্তিতে পুনরায় পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়;  (ঝ) সব পাটকল জাতীয়করণ করা ইত্যাদি।  ২৭ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করে আব্দুস সামাদ আজাদ, ফণীভূষণ মজুমদার, শেখ আবদুল আজিজ এবং জহুর আহমদ চৌধুরীকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।  ২৮ ডিসেম্বর অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বঙ্গভবনে শপথ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন এইচ টি ইমাম। ২৭ ও ২৯ ডিসেম্বর মন্ত্রীদের মধ্যে দপ্তর বণ্টন করা হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে খোন্দকার মোশতাক আহমদকে বাদ দেওয়া হয়, তবে তাকে মন্ত্রিসভায় বহাল রাখা হয়। ২৮ ডিসেম্বর নতুন মন্ত্রিসভার বৈঠকে ফোর্সেস অ্যাক্ট সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, বাংলাদেশের মুদ্রার নাম হবে টাকা। ওই বৈঠকে ১৯৭১-৭২ সেশনে আমন ধান ও চালের অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ অভিযান বিষয়ে আলোচনা করা হয়। ৩১ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার পরবর্তী বৈঠকে ‘ফুড করপোরেশন’ গঠন, পাটনীতি অনুমোদন, তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের তথ্য ব্যবস্থা অনুমোদন, জাতীয় মিলিশিয়া বোর্ড গঠন ও গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি বিষয়ে আলোচনা হয়। ওইদিন ব্যাংকগুলোতে প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়।  ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ব্যাংকগুলো স্বাভাবিক কাজকর্ম চালু করে। ব্যাংক ও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি জাতীয়করণ করা হয় ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি।  ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসে। মুজিবনগর সরকারের ঢাকায় আগমনের পর দিন (২৩.১২.১৯৭১) ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দূত মি. দুর্গাপ্রসাদ ধর (ডি পি ধর) ঢাকায় আগমন করেন ও ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করেন। ওই সময় তিনি ঢাকায় মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা ও বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলোচনা করেন। তিনি ২৩ তারিখেই ১৮ নম্বর সড়কে অবস্থিত অস্থায়ী আবাসস্থলে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। ডি পি ধরের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক বাণিজ্য সচল করা, অভ্যন্তরীণ পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করা, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করা প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করা হয়। ওই সময় ভারতীয় নৌবাহিনীর সহায়তায় চট্টগ্রাম বন্দর সচল করার লক্ষ্যে নিমজ্জিত নৌযান ও ভাসমান মাইন পরিষ্কার করার বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ফলে ১ জানুয়ারির মধ্যেই চট্টগ্রাম বন্দরের ৮০ ভাগ সচল হয় ও বন্দরটি ২০ ফিট গভীরতা সম্পন্ন জাহাজ চলাচলের উপযোগী হয়।  ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত ২৪৭টি ছোটো-বড়ো রেলওয়ে ব্রিজের মধ্যে ১৯৪টি রেলওয়ে ব্রিজের মেরামত সম্পন্ন করা হয় ও ২৩টি রুটে রেল সার্ভিস চালু হয়। ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম, সিলেট ও উত্তরবঙ্গের সড়ক যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি থেকে সব জেলার মধ্যে ডাক যোগাযোগ সচল করা হয়। ০৯.০১.১৯৭২ তারিখে রাষ্ট্রপতি কয়েকটি অধ্যাদেশ জারি করেন,  যেমন : (ক) অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ০১ (০৩.০১.১৯৭২)- এর মাধ্যমে বাংলাদেশে পরিত্যক্ত সব শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃত্ব ও ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণভার বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করে;  (খ) অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ০২ (০৪.০১.১৯৭২)-এর মাধ্যমে ‘এয়ার বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল আদেশ’ জারি করে ‘পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স’-কে ‘এয়ার বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল’ নামকরণ করা হয় ও পিআইএএর সব সম্পদ অধিগ্রহণ করা হয়;  (গ) রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ-০১ (০৩.০১.১৯৭২): ‘বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় সমন্বয়করণ অধ্যাদেশ-০১’। এ অধ্যাদেশের মাধ্যমে গভর্নর, পূর্ব পাকিস্তান এবং প্রাদেশিক সরকারের পরিবর্তে যথাক্রমে রাষ্ট্রপতি, বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ সরকার প্রতিস্থাপিত হয়।  (ঘ) প্রজ্ঞাপন জারি (০৬.০১.১৯৭২): রবিবারকে সাপ্তাহিক ছুটি হিসেবে ও অফিসের নতুন সময়সূচি ঘোষণা করা হয়।  এভাবে মুজিবনগর সরকার ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি এ ২৩ দিনে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করে, ঢাকার সঙ্গে জেলা শহরগুলোর যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে, শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রচলিত আর্থসামাজিক কাঠামোর সংস্কার সাধনের উদ্যোগ গ্রহণ করে ও সদ্য স্বাধীন দেশের জন্য কিছু মৌলিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, ব্যাবসাবাণিজ্য ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালু করার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং সর্বোপরি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ সৃষ্টি করে।   [সূত্র : ড. মো. মাহবুবুর রহমান, বঙ্গবন্ধুর শাসনামল ১৯৭২-১৯৭৫, ঢাকা : সুবর্ণ, ২০২২; এইচ টি ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১-৭৫, ঢাকা : হাক্কানী পাবলিশার্স, ২০১৩; মওদুদ আহমদ, বাংলাদেশ : শেখ মজিবুর রহমানের শাসনামল, ঢাকা : ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ১৯৮৩।] লেখক : ড. মো. মাহবুবর রহমান: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
১৬ ডিসেম্বর, ২০২৩
X